ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঈদ সামনে রেখে বেড়েছে পণ্য পরিবহন ভাড়া

কার্যকরের সময় পার হয়েছে ২০ দিন আগে, কমেনি পরিবহন ভাড়া

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১৩ জুন ২০১৬

কার্যকরের সময় পার হয়েছে ২০ দিন আগে, কমেনি পরিবহন ভাড়া

রাজন ভট্টাচার্য ॥ কথা রাখেননি পরিবহন মালিকরা। কমেছে তেলের দাম। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার কর্তৃক নতুন ভাড়া কার্যকর শুরু হয় ২০ মে থেকে অথচ ২০ দিন পরেও দূরপাল্লার বাসভাড়া কমানো হয়নি। কমেনি পণ্যবাহী পরিবহনের ভাড়াও। অর্থাৎ সরকারের নির্দেশনা তোয়াক্কা করছেন না কেউ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঈদকে সামনে রেখে পণ্যবাহী পরিবহনের ভাড়া বরং বেড়েছে। এক্ষেত্রে অসহায় সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। এ নিয়ে যাত্রীসহ পণ্য আমদানির সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্টদের ক্ষেভের শেষ নেই। তবে মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারা বাসভাড়া কমানোর ব্যাপারে আন্তরিক। ৬৪ জেলার মধ্যে অনেক রুটেই ভাড়া কমেছে। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, সরকার নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর না হওয়ায় সম্প্রতি মালিক সমিতির সঙ্গে একটি বৈঠক হয়েছে। এতে মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে মালিক পক্ষের কাছে ভাড়া কার্যকর না করার জবাব চাওয়া হয়। জবাবে তারা বলেন, বেশিরভাগ রুটে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কম অনেক আগে থেকেই কম ভাড়া নেয়া হচ্ছে। তাই নতুন করে ভাড়া কমানো সম্ভব হচ্ছে না অথচ জনকণ্ঠের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশের বেশিরভাগ দূরপাল্লার রুটে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি আদায় করা হচ্ছে। মালিক সমিতির পক্ষ থেকে এ রকম খোঁড়া যুক্তি দেখানোর পর ভাড়া কার্যকর করার বিষয়ে পিছুটান দিয়েছে মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে আর কোন আলোচনা এখন নেই। যদিও সড়ক পরিবহন মন্ত্রী নতুন ভাড়া কার্যকর করার আগে মালিকদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ভাড়া কার্যকর না করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে অথচ হয়নি কিছুই। অবস্থা যা ছিল তাই আছে। মাঝখানে মানুষের পকেট থেকে যাচ্ছে বাড়তি অর্থ। যাত্রী অধিকার সংরক্ষণে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বলছেন, গেল ২৬ বছরে বাসভাড়া বেড়েছে পাঁচ গুণ। তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০০৩ সালের পর অন্তত পাঁচবার পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে। তেলের দাম কমায় ২০০৯ সাল থেকে তিনদফা ভাড়া কামানোর ঘোষণা দেয়া হলেও এর একটিও যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। শুক্র ও শনিবার রাজধানীর বিভিন্ন বাস টার্মিনালে ঘুরে ভাড়া কমানোর কোন তথ্য মেলেনি যাত্রীদের কাছ থেকে। সব যাত্রীই অভিযোগ করেছেন আগের ভাড়া আদায় করছে পরিবহন কোম্পানিগুলো। কোন বাস কাউন্টারের সামনে নতুন ভাড়ার তালিকা দেখা যায়নি। তবুও সন্তুষ্ট সরকারী মনিটরিং কমিটি। তারা বিআরটিএ ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়কে ভাড়া বাস্তবায়ন হওয়ার খবর সরবরাহ করছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, দেশের কোথাও বাস ভাড়া কমানোর খবর পাওয়া যায়নি। ভাড়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিআরটিএ সচিব শওকত আলী জনকণ্ঠ’কে বলেন, নতুন ভাড়া যেন যথাযথভাবে কার্যকর করা হয় সেজন্য আমরা তিনটি মনিটরিং টিম গঠন করেছি। গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাদ টার্মিনালে এসব টিম কাজ করছে বলে জানান তিনি। তালিকা অনুযায়ী যাত্রীদের থেকে ভাড়া নেয়া হচ্ছে কিনা, তা তদারকি করবেন মনিটরিং কমিটির সদস্যরা। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। দূরপাল্লার বাস ভাড়া কমানোর বিষয়ে জানতে চাইলে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক জনকণ্ঠ’কে বলেন, বাস ভাড়া কমাতে দু’দফা সময় দিয়েছিল সরকার। কিন্তু মালিক সমিতি সরকারের নির্দেশনা মানছে না। ভাড়া বাড়ে-কমে না ॥ পরিসংখ্যান বলছে, গেল ২৬ বছরে বাস ও মিনিবাসের ভাড়া বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ। মূলত ডিজেলের দাম বাড়ানোর কারণেই বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এ সময়ে ডিজেলের দামও বেড়েছে চার গুণ। ১৯৯০ সালে ডিজেলের দাম ছিল প্রতি লিটার ১৭ টাকা। ওই সময় বাসভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ছিল ৩২ পয়সা। এখন ডিজেলের দাম প্রতি লিটার ৬৫ টাকার বেশি। আর বাসভাড়া হয়েছে ১ টাকা ৪৫ পয়সা। বর্তমানে দেশের ৬০ ভাগ যানবাহন ডিজেল ও অকটেনে চালিত। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অনেক বেশি আদায় করা হচ্ছে যাত্রীদের কাছ থেকে। এছাড়া পাঁচ টাকা জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলে ১০ টাকা ভাড়া বাড়ানো হয়। আর পাঁচ টাকা তেলের দাম কমানো হলে ভাড়া কমে দুই টাকা। গেল ২৬ বছরে যতবার ভাড়া কমানো হয়েছে এর একবারও যাত্রীরা সুফল পাননি। প্রকৃত অর্থে ভাড়া কমানোর বিষয়টি ছিল কাগজে-কলমে। এতে লাভবান হয়েছে পরিবহন মালিকরাই। নীরবে পকেট কাটা গেছে যাত্রীদের। তাছাড়া ভাড়া কমানোর পর তা কার্যকর করতে কখনই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় আন্তরিক ভূমিকা পালন করেনি। ডিজেলের মূল্য লিটারপ্রতি ২০ টাকা হওয়ার পর ২০০৩ সালের ৯ মার্চ কিলোমিটারপ্রতি বাস ভাড়া বেড়ে দাঁড়ায় ৭২ পয়সা। ডিজেলের মূল্য লিটারপ্রতি ২৬ টাকা হওয়ার পর ২০০৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বাস ভাড়া বাড়িয়ে কিলোমিটারপ্রতি ৮০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। ২০০৮ সালে জুলাই মাসে জ্বালানি তেলের লিটারপ্রতি দাম হয় ৫৫ টাকা। তখন ফেরি ভাড়া বাদে কিলোমিটারপ্রতি বাস ভাড়া হয় এক টাকা পাঁচ পয়সা। একই বছরে তেলের দাম কমে লিটারপ্রতি হয় ৪৮ টাকা। তখন কোন ব্যয় বিশ্লেষণ না করেই লিটারপ্রতি সাত টাকা তেলের দাম কম হওয়ায় কিলোমিটারপ্রতি সাত পয়সা ভাড়া কমানো হয়। যা যথাযথ কার্যকর হয়নি। ২০০৯ সালের জ্বালানি তেলের দাম আরেকদফা কমে লিটারপ্রতি দাঁড়ায় ৪৪ টাকা। তখন চার পয়সা ভাড়া কমানো হয়। ২০১১ সালে লিটারপ্রতি তেলের দাম ৪৬ টাকা হওয়ায় প্রতি কিলোমিটারে বাস ভাড়া এক টাকা ১৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। একই বছরে আরেক দফা বাড়ে তেলের দাম। ২০১২ সালে ফের তেলের দাম বেড়ে লিটারপ্রতি হয় ৬১ টাকা। তখন কিলোমিটার প্রতি ভাড়া হয় এক টাকা ৩৫ পয়সা। এরপর ২০১৩ সালে তেলের দাম বৃদ্ধির পর আন্তঃজেলায় কিলোমিটারপ্রতি বাস ভাড়া এক টাকা ৪৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ৩ মে ডিজেলে চালিত দূরপাল্লার পরিবহনের ভাড়া ৩ পয়সা কমিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ঢাকা ও আশপাশের কয়েকটি জেলা এবং চট্টগ্রাম মহানগরী ব্যতীত আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার রুট পরিচালিত ডিজেলচালিত বাস ও মিনিবাসের ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ১ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে কমিয়ে ১ টাকা ৪২ পয়সা করা হলো। যা ১৫ মে থেকে কার্যকরের নির্দেশও দেয়া হয়। কিন্তু বাসমালিক সমিতি তা কার্যকর করেনি। দ্বিতীয় দফায় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে পাঁচদিন সময় বাড়ানো হয়, যা ২০ মে থেকে ভাড়া কমানোর কার্যকরের নির্দেশ দেয়া হয়। দ্বিতীয় পর্বে ভাড়া কমানোর দিনক্ষণ ঠিক করে দেয় সরকার। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন ঘটেনি। রাজধানীর কমলাপুর, কল্যাণপুর, গাবতলী সরেজমিনে দেখা গেছে সব ডিজেলচালিত দূরপাল্লার কাউন্টারে আগের ভাড়াই রাখা হচ্ছে। কোন কাউন্টারেই কোন ভাড়ার তালিকা টানানো হয়নি। দিনাজপুর হিলির যাত্রী জুয়েল রানার। তিনি জানান, হিলি থেকে ৪৫০ টাকা ভাড়া দিয়ে ঢাকায় এসেছেন। কল্যাণপুর এস আর প্লাস পরিবহনে তার কাছে ৪৫০ টাকাই রাখা হয়েছে। এসআর প্লাসের টিকেট মাস্টার জয়নাল মিয়া জানান, দূরত্ব অনুযায়ী এমনিতেই ভাড়া কম রাখা হয়। এছাড়া মালিক পক্ষ থেকে কোন নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। তাই আগের ভাড়া রাখা হচ্ছে। সায়েদাবাদ থেকে থেকে বৃহত্তর সিলেট ও চট্টগ্রামে চলা পরিবহনগুলো থেকে আগের ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। সুনামগঞ্জ থেকে আসা যাত্রী নিজাম জানান, আগে ভাড়া ছিল ৪৫০ টাকা। এখনও তাই। এক টাকাও ভাড়া কমেনি। সিলেট, হবিগঞ্জসহ আশপাশের সব জেলার চিত্র একই। গাবতলী বাসটার্মিনাল থেকে আন্তঃজেলা শহরে চলাচলকারী বিভিন্ন গণপরিবহনেও আগের ভাড়া রাখা হচ্ছে। মানিকগঞ্জের বালিরটেক যাত্রী সজল। তিনি জানান, গাবতলী থেকে বালিরটেক ভাড়া আগে ৭০ টাকাই রাখা হচ্ছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জনকণ্ঠ’কে বলেন, আমি যতদূর খবর পেয়েছি কিছু কিছু রুটে সরকার নির্ধারিত বাসভাড়া কার্যকর হয়েছে। আশাকরি পর্যায়ক্রমে সব রুটেই নতুন ভাড়া কার্যকর হবে।
×