ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জাকারিয়া স্বপন

রাজনীতি ও প্রযুক্তি

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ১৩ জুন ২০১৬

রাজনীতি ও প্রযুক্তি

কিছুদিন আগে প্রিয় একজন সিনিয়র সাংবাদিক ভাই বললেন, ‘হিলারি জিতলে বাংলাদেশের সমস্যা, আর ট্রাম্প জিতলে পুরো পৃথিবীর সমস্যা। প্রশ্ন হলো, আপনি কোনটা চান?’ কথাটা শুনে সবাই হেসে উঠলেন। যদিও কথাটা তিনি হাসতে হাসতে মজা করেই বললেন; কিন্তু কথাটার ভেতর আসলেই অনেক না-বলা সত্য কথা লুকিয়ে আছে। কোথায় আমেরিকা আর কোথায় বাংলাদেশ- ঠিক পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুটি দেশ। কিন্তু মানুষ কিভাবে লিংক করে ফেলছে। আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হবেন তা দেখার জন্য সবাই তাকিয়ে আছে। শেষতক পুরো বিশ্ব নিশ্চিত হয়েছে যে, আমেরিকার আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং হিলারি ক্লিনটন। দুই বড় দলের দুই প্রার্থিতা নিশ্চিত হয়েছে। প্রাথমিক প্রার্থী বাছাইপর্বে যে জল্পনা-কল্পনা ছিল, তার পরিসমাপ্তি হয়েছে। এখন শুরু হয়েছে ভোটের আসল লড়াই এবং বিশ্বের কার কি হিসাব-নিকাশ আছে, সেগুলো নিয়ে মানুষের কত রকমের আলাপ। চায়ের টেবিলের আলাপ শুনলে মনে হয় তারা আমাদের কত আপন; ওখানে কে প্রেসিডেন্ট হলো সেটা আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে। কিন্তু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কে হলো তা দিয়ে কি আসলেই অন্য মানুষের কিছু আসে যায়? আমেরিকা কি আগের মতো সেই ক্ষমতাশালী একটি দেশ? নাকি গোধূলির শেষ আলো গায়ে মেখে নিজের মহিমাকে তুলে ধরার চেষ্টা করছে মাত্র? সেই হিসাবের উত্তর আমরা পেয়ে যাব এ বছরই। তবে রাজনীতির সঙ্গে যে প্রযুক্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে সেটা গত সপ্তাহে আমরা আরও পরিষ্কারভাবে দেখতে পেয়েছি। হিলারির পক্ষে গুগল এটা একটা খুবই মজার বিষয় যে, বর্তমান সময়ের মানুষ ভোটের ব্যাপারে প্রযুক্তির ওপর অনেক বেশি নিভর্রশীল হয়ে পড়েছে এবং অনেক স্পর্শকাতরও হয়ে গেছে। অভিযোগ উঠেছে, গুগলের সার্চ ইঞ্জিন হিলারিকে সমর্থন করছে। কিভাবে? সোর্সফেড নামের একটি ইউটিউব ভিডিও চ্যানেল সেটাই ব্যাখ্যা করেছে। সেই ভিডিওটি গত শুক্রবার পর্যন্ত দেড় কোটিবার ফেসবুকে দেখা হয়েছে এবং ইউটিউবে দেখা হয়েছে ৩ লাখের মতো। তাহলে বুঝতেই পারছেন কি বিশাল পরিমাণে এটা ভাইরাল হয়েছে। গুগলের সার্চ ইঞ্জিনের একটি অটো-কমপ্লিট ফিচার রয়েছে, যেখানে আপনি কিছু টাইপ করলে গুগল পরের শব্দগুলো দেখিয়ে দেয়। ওই ভিডিওতে দাবি করা হয় যে, গুগলের সার্চ ইঞ্জিনে ‘হিলারি ক্লিনটন সি.আর.আই (ঐরষষধৎু ঈষরহঃড়হ পৎর) লিখলে সাজেশন হিসেবে চলে আসে ‘ঐরষষধৎু ঈষরহঃড়হ পৎরসব ৎবভড়ৎস’ এবং ‘ঐরষষধৎু ঈষরহঃড়হ পৎরংরং’. কিন্তু ইয়াহু কিংবা বিং-এ সার্চ করলে আসে ‘যরষষধৎু পষরহঃড়হ পৎরসবং’. অর্থাৎ গুগল হিলারি ক্লিনটনের ক্রাইম সংক্রান্ত সার্চগুলোকে সাজেশন হিসেবে দেখাচ্ছে না এবং দাবি করা হয়েছে যে, হিলারি ক্লিনটনের ক্রাইম রিফর্ম-এর চেয়ে তার নিজের ক্রাইমের সংবাদ অনেক বেশি হওয়ার কথা এবং এটা জনপ্রিয় সার্চে থাকার কথা। গুগল চালাকি করে হিলারিকে সমর্থন করছে। যেহেতু রাজনীতির গন্ধ রয়েছে এবং ভোটের বাজার তাই যে ভদ্রলোক এ ভিডিওটি তৈরি করে ছেড়েছেন তার সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন খোদ প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি চিৎকার করেই বললেন, গুগল যদি এভাবে সার্চে পক্ষপাতিত্ব করে থাকে তাহলে সেটা খুবই ন্যক্কারজনক। তিনি আমেরিকার একটি পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাতকারে বলেন, এটা খুবই অসততা। অবস্থা বেগতিক দেখে গুগলকে তার অবস্থান ব্যাখ্যা করতে হয়েছে। গুগল বলেছে, তাদের সার্চের অটোকমপ্লিট ফিচারটির এলগরিদম এমনই যে, সেখানে কোন মানুষ সম্পর্কে খারাপ কিছুকে দেখানো হয় না। সেটা হিলারি ক্লিনটন বলে কথা নয়, এটা যে কোন মানুষ সম্পর্কেই প্রযোজ্য। তারা বেশ কিছুকাল আগেই এই এলগরিদম পরিবর্তন করেছেন। কারণ এটা নিয়ে অনেক অভিযোগ এসেছিল। এখানে বলে রাখা ভাল যে, কিছুদিন আগেই গুগলের এ ধরনের সার্চ নিয়ে পুরো মিডিয়া জগত কেঁপে উঠেছিল। আপনি যদি গুগলে সার্চ করেন ‘থ্রি ব্লাক টিনএজার্স’ সেখানে দেখবেন কেমন সাংঘাতিক ধরনের অপরাধীর ছবি দেখানো হয়। পাশাপাশি যদি সার্চ করেন ‘থ্রি হোয়াইট টিনএজার্স’ সেখানে দেখানো হয় হাসিখুশি তরুণ-তরুণীদের। এটাও এক ধরনের বৈষম্য। এখন দেখার পালা গুগল ফেসবুকের মতো বড় মিডিয়াগুলো আসলেই কোন বৈষম্য দেখায় কিনা? ২৫ জুন বেসিস নির্বাচন বাংলাদেশের সফটওয়্যার খাতের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার এ্যান্ড সার্ভিসেসের (বেসিস) ২০১৬-১৯ মেয়াদে কার্যনির্বাহী কমিটি নির্বাচন নিয়েও ভোটের পালে হাওয়া লেগেছে। আগামী ২৫ জুন অনুষ্ঠিত হবে এ নির্বাচন। তাই এখন ভোট চাওয়ার মুখ্য সময়। এবারের নির্বাচনে দুটি প্যানেলে ১৮ জন ছাড়াও ৪ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন। তবে এখানেও বড় দুটি প্যানেলে বিভক্ত হয়েছে বেসিস নির্বাচন। এটি খুবই ভাল একটি সংবাদ। এতদিন প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যেত বেসিসের সভাপতির পদ। কিন্তু এবার একদিকে দাঁড়িয়ে আছেন আনন্দ কম্পিউটার্সের স্বত্বাধিকারী বেসিসের প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতি মোস্তাফা জব্বারের নেতৃত্বে ‘ডিজিটাল ব্রিগেড’ প্যানেল, অন্যদিকে মাইক্রোসফট বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোনিয়া বশিরের নেতৃত্বে রয়েছে ‘দ্য চেঞ্জ মেকারস’ প্যানেল। নির্বাচনী প্রচারে দুটি প্যানেলের প্রধানরাই বেসিস সদস্যদের ব্যবসা উন্নয়নের পাশাপাশি ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সরকারের সঙ্গে অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে জোর দিচ্ছেন। এ সম্পর্কে একটি জাতীয় দৈনিককে মোস্তাফা জব্বার বলেন, বেসিস সদস্য কোম্পানিগুলো যাতে সহজে সরকারী-বেসরকারী খাতের কাজ পায় এজন্য প্রয়োজনে সরকারী প্রকিউরমেন্ট নীতিমালা সংশোধনে কাজ করবেন তিনি। পাশাপাশি ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণেও বেসিসের প্রত্যক্ষ ভূমিকা জোরদারে মনোযোগ দেবেন। সোনিয়া বশিরের নেতৃত্বে প্যানেলের সেøাগান হচ্ছে ‘মেম্বার ফাস্ট’। বেসিস সদস্যদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তিতে গুরুত্ব দিতে চান তিনি। তিনি বলেন, দেশের আইসিটি শিল্পের অগ্রনায়ক বেসিস সদস্য কোম্পানিগুলো এখনও নানা সমস্যায় জর্জরিত। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে অংশীদারিত্বের পাশাপাশি বেসিস সদস্যদের উন্নয়নে কাজ করব। এবারের বেসিস নির্বাচনটি দেখার মতো হবে। আমি নিশ্চিত আমার মতো অনেকেই এ নির্বাচনের ফল দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন। তবে এটা যেহেতু পুরোটাই প্রযুক্তি খাতের মানুষ এবং তাদের নির্বাচন, তাই এখানে প্রযুক্তি চলে এসেছে প্রবলভাবে। যদিও ভোটারের সংখ্যা খুব কম, তবুও প্রচারের কমতি নেই কারও। এদের প্রচারের মূলত দুটি মাধ্যমÑ ১. খবরের কাগজ এবং অনলাইন পোর্টালগুলোতে নিজেদের নির্বাচনী প্রচার চালানো ও ২. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মূলত ফেসবুক। মিডিয়াগুলোর কাছে দু’জনই প্রিয়মুখ। মিডিয়ার সঙ্গে দু’জনেরই যোগাযোগ শক্ত। তাই মিডিয়া হয়ত কারও পক্ষ নিতে পারবে না। তবে ফেসবুকে বেশ জটিল ধরনের প্রচারণা চলে এসেছে। বর্তমান সময়ের একটি বড় ধাপ্পাবাজির প্রচারণা হলোÑ কোন অখ্যাত ইন্টারনেট সাইটে ইচ্ছেমতো একটি বানোয়াট রিপোর্ট প্রকাশ করা; তারপর সেই রিপোর্টটি ফেসবুকে শেয়ার করে পোস্ট করা, যেন সবার নজরে আসে। আর বাংলাদেশের মানুষও এমন, যে কোন মিথ্যা এবং গুজবের প্রতি আগ্রহ সীমাহীন। তারা কাদা নিয়ে খেলতে পছন্দ করে। এবারের এই বেসিস নির্বাচনকে ঘিরেও তেমন কিছু মিথ্যা প্রচারণা দেখা যাচ্ছে, যা এ শিল্পের জন্য মোটেও ভাল নয়। যারা এ কাজগুলো করছেন তাদের রুচিহীন বলা ছাড়া আমার আর কোন ভাষা নাই। আর রুচিহীনদের দ্বারা কখনই ভাল কিছু হতে পারে, তা আমি মনে করি না। ১৫ জুন জাকারবার্গ লাইভ ১৫ জুন ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা সিইও মার্ক জাকারবার্গ সরাসরি মানুষের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আয়োজন করেছেন। ‘ফেসবুক লাইভ’ নামে যে নতুন ফিচার যোগ করা হয়েছে তার মাধ্যমেই বিশ্বের তাবদ ফেসবুক ব্যবহারকারীর মুখোমুখি হবেন তিনি। অনুষ্ঠানটি সবার জন্য উন্মুক্ত। চাইলে কেউ বাংলাদেশ থেকেও তাকে প্রশ্ন করতে পারেন। সারা পৃথিবী থেকে মানুষ তাকে প্রশ্ন করবে। সেই ভিড়ে আপনি হয়ত সুযোগ নাও পেতে পারেন। যদি কোনমতে একবার সুযোগ পেয়ে যান তাহলে তাকে নিচের যে কোন একটি প্রশ্ন করতে পারেন। ১. বাংলাদেশে ফেসবুকের ‘ফ্রি বেসিকস’ সেবাটি বর্তমানে কাজ করে। দুটি মোবাইল কোম্পানি এ সেবা দিয়ে থাকে। কিন্তু ফেসবুক ড্রোন, উড়োজাহাজ ইত্যাদি বিষয়গুলো তৈরি করছে। ১৬ কোটি মানুষের দেশে বিনামূল্যে ইন্টারনেট সেবা দেয়ার জন্য বাংলাদেশের আকাশে এগুলো পাব কিনা? ২. উপরের প্রশ্নটি করার পর আরেকটি সুযোগ পেলে জিজ্ঞেস করতে পারেন, ভারতের কাঞ্চিধাম আশ্রমে গিয়ে তিনি কী কী শিখেছিলেন? ৩. এরপরও সুযোগ পেলে জিজ্ঞেস করতে পারেন, আমেরিকার নির্বাচনে কে জিতবে? হিলারি নাকি ট্রাম্প? তার কাছে তথ্য থাকার কথা। ফেসবুকে কে কোথায় লাইক দিচ্ছে এবং কী শেয়ার করছে তা থেকে তাদের বুঝতে পারার কথা নির্বাচনে কার পালে হাওয়া লাগছে বেশি। তবে এর উত্তর দিতে তিনি আমতা আমতা করতে থাকলে তাকে সম্পূরক একটি প্রশ্ন করা যেতে পারেÑ ‘হিলারি জিতলে বাংলাদেশের সমস্যা, আর ট্রাম্প জিতলে পুরো পৃথিবীর সমস্যা। প্রশ্ন হলো, আপনি কোন্্টা চান?’ আপনি চাইলে প্রশ্নগুলো নিচ থেকেও করতে পারেন। ১১ জুন, ২০১৬ লেখক : তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ [email protected]
×