ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

অনির্দিষ্ট অবরোধে চলছে গুপ্তহত্যা

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ১৩ জুন ২০১৬

অনির্দিষ্ট অবরোধে চলছে গুপ্তহত্যা

বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের যারা বিস্তার ঘটিয়েছে, তারা তাদের সেই পথ থেকে সরে আসেনি। তাই দেড় বছর আগে তাদের ঘোষিত দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচী প্রত্যাহার করেনি। যে কর্মসূচী পালনে তারা যাত্রীবাহী চলন্ত বাসে পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ হত্যা করেছে। দগ্ধ করেছে বহুশত সাধারণ নিরীহ মানুষকে। টানা তিন মাস প্রকাশ্যে এই তৎপরতা চালিয়ে গণপ্রতিরোধের মুখে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। কিন্তু লক্ষ্য থেকে সরে আসেনি। তবে প্রকাশ্য হত্যা থেকে সরে এসে তারা এখন গুপ্তহত্যায় নেমেছে। এই হত্যাকা- যারা যে নামেই ঘটিয়ে আসুক না কেন, স্বার্থ তাদের একটাই বিএনপি-জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন। তাদের সেই এজেন্ডা তো সবারই জানা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি বানচাল, খালেদা ও তার পুত্রের দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহার এবং ক্ষমতাসীন সরকারকে হটিয়ে যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় যাওয়া। এ জন্য প্রয়োজনে তারা ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তা নিতেও কসুর করছে না। এমনিতেই তারা পাকিস্তান তথা পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে আসছে। লক্ষ্যপূরণে তারা জঙ্গী সংগঠন সৃষ্টি ও তাদের রাজনৈতিক মদদদানের কাজটিও করে আসছে। আর এ কারণেই সম্ভবত খুনীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি-জামায়াত জোট নেত্রী যে অবরোধের ঘোষণা দেন অনির্দিষ্টকালের জন্য, সে ঘোষণা তথা অবরোধ আজও প্রত্যাহার করেনি। অবরোধ ঘোষণার পাশাপাশি হরতাল কর্মসূচীও দিয়েছিলেন বিভিন্ন সময়ে। যে দেশের মানুষ পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে, আবার পাখির ডাকে জাগে, সেই দেশের মানুষকে পেট্রোলবোমা মেরে বাসে আগুন দিয়ে জীবন্ত হত্যা কিংবা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে যারা খুন করছে, তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর গণদাবি পূরণের গতি খুবই শ্লথ। বিচার না হবার সেই সুযোগ নিয়ে নৃশংসতায় ভর করে চালানো হচ্ছে গুপ্তহত্যা। ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের মাধ্যমে যারা মানুষকে জীবন্ত হত্যা করেছে, যারা হত্যার হুকুমদাতা, অর্থ যোগানদাতা, পরিকল্পনাকারী তাদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা হলে আইনের শাসন যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়, তেমনি মানুষ হত্যার এই নারকীয় তৎপরতাও বন্ধ হতে বাধ্য। মানুষের জীবন নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলছে, তাদের শক্ত হাতে দমন করা শুধু কথার কথা নয়, বাস্তবেও এর প্রয়োগ জরুরী। ঘাতকরা ঘোষণা দিয়ে, হুকুম দিয়ে অবরোধ, হরতাল ডেকে মারণঘাতী আঘাত হেনেছিল। চোরাগোপ্তা হামলায় তারা গত বছরের প্রথম তিন মাসে দেড় শতাধিক মানুষকে জীবন্ত হত্যা করেছে। আগুন জ্বেলে, বোমা মেরে মানুষ হত্যা যে কত সহজ তা বিএনপি-জামায়াত জোট প্রমাণ করেছে। খালেদার ডাকা সেই অবরোধ আজও বহাল রয়েছে। আর এই অদৃশ্য অবরোধ বজায় রেখেই চলছে টার্গেট কিলিং, যা থেকে বিএনপি-জামায়াত ফায়দা ওঠাতে সচেষ্ট। বিদেশীদের কাছে বাংলাদেশকে জঙ্গী রাষ্ট্র প্রমাণ ও সরকার যে এসব দমনে ব্যর্থ তা প্রমাণে এখনও সক্রিয়। তারা ২০১৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত নাশকতা-সহিংসতাসহ গণহত্যা চালিয়েছে এবং এর জন্য অনুতপ্তও নয়। বরং সদর্পে রাজনৈতিক মঞ্চ দাবড়ে বেড়াচ্ছে। গলা হাঁকিয়ে বলছে এসব ঘটনার জন্য তারা দায়ী নয়। গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৯৩ দিনে মহাসড়ক, জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে বোমা হামলা ও যাত্রীবাহী যানবাহনে পেট্রোলবোমা মেরে পুড়িয়ে দিয়েছে। এই নাশকতাকারীরা একদিকে ধরা পড়ে; অন্যদিকে জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার সন্ত্রাসী তৎপরতা চালায়। এই তা-ব থেকে মানুষকে রক্ষা করার দায়িত্ব যাদের, তারা কাজে তত পারদর্শিতা প্রমাণ করতে পারেননি। তাই দিনের পর দিন তারা প্রকাশ্যে নাশকতা চালিয়েছিল, আর অসহায় মানুষ ভয়ের সংস্কৃতির ভেতরে সেঁধিয়ে আটকে ছিল। রাজনীতি ছেড়ে বিএনপি তাই সেই যে ২০১৩ সাল থেকে লাশনীতিতে নেমে পড়েছে, সেখান থেকে আজও সরে আসেনি। জ্বালাও পোড়াওয়ের মহাব্রতে পথে-প্রান্তরে, গ্রামে-গঞ্জে অরাজকতা, নৈরাজ্য, নৃশংসতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু জনগণের ঘৃণা ও প্রতিরোধের মুখে সে পথ ছেড়ে গুপ্তহত্যার পথ ধরেছে। একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে মানুষ হত্যার নৃশংসতায় যেভাবে মেতে উঠত, তাদের অনুসারী ও চেতনাধারীরা আগুনসন্ত্রাস চালিয়ে সেইভাবে মেতে উঠেছিল, কিন্তু পাকিস্তানী হানাদারদের মতো তাদেরও এক্ষেত্রে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। এই পথে বিদেশী শক্তির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। বরং নিন্দিত হয়েছে। তাই সেখান থেকে সরে এসে তারা ‘টার্গেট কিলিং’ তথা গুপ্তহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। দেশীদের পাশাপাশি বিদেশী হত্যায় নেমেছে। আর এক্ষেত্রে তারা এক ধরনের সফলই বলা যায়। তারা বিদেশীদের কাছে বাংলাদেশকে জঙ্গী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করার কাজে বেশ কিছুদূর এগোতে পেরেছে। তাই বিদেশীরা অবলীলায় বলছে, বাংলাদেশে আইএস আছে। কিন্তু বাস্তবে আইএস নয়, বরং রয়েছে আইএসআই। আর এই সত্যকে চাপা দেয়ার জন্য আইএস নামক জুজুর ভয় দেখাচ্ছে যারা, তাদের যে এক ধরনের হীন স্বার্থ রয়েছে তা সর্বজনবিদিত। কারণ বিভিন্ন দেশে তাদের ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালানো শুধু নয়, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও উগ্রপন্থার স্রষ্টাও তারা। মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তারা ইরাক ও লিবিয়ায় যা ঘটিয়েছে, তার মাসুল বিশ্ববাসীকে দিতে হচ্ছে। মনে হয়, আরও দিয়ে যেতে হবে। সেই তারাই ‘আইএস আছে, আইএস আছে বাংলাদেশে’ বলে একটা মিথ্যা আরোপ করে অন্যরকম উদ্দেশ্য যে হাসিল করতে চায়, সচেতন জনগণ তা উপলব্ধি করতে পারেন। মূলত বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেট বা আইএসের অনুপ্রবেশ ঘটতে হলে তা যে বিএনপি-জামায়াত জোটের হাত ধরেই হবেÑ সেটা বলাই বাহুল্য। এদের হাত ধরেই এদেশে আইএসআই নামক পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থাটি দীর্ঘদিন ধরে তৎপরতা চালাচ্ছে। ভারতের ৭টি রাজ্যে বিছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও সশস্ত্র হামলার জন্য আইএসআই তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে বাংলাদেশের মাটিতে খালেদা-নিজামী শাসনামলে। অবৈধ অস্ত্র আমদানির সঙ্গেও এরা জড়িত। ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা আজও ঝুলছে। কিন্তু এই অস্ত্র আমদানি ও সরবরাহের সঙ্গে জড়িতরা ভারতে জঙ্গী হামলা চালানোর জন্য তৎপর ছিল। সেই তারা বাংলাদেশে গুপ্তহত্যা, আগুন সন্ত্রাস চালাতে জঙ্গীবাদকে উস্কে দিয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে জঙ্গীদের সৃষ্টি, উত্থান ও বিস্তার ঘটেছে। জেনারেল জিয়ার সময় যাদের লিবিয়ায়, আফগানিস্তানে পাঠানো হয়েছিল, সেই প্রশিক্ষিতরা দেশে ফিরে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গী তৈরির কাজ চালিয়ে আসছিল। শায়খ আবদুর রহমান আফগান প্রশিক্ষিত এবং জেএমবি প্রধান ছিল। বিএনপির মন্ত্রী ও নেতাদের ছত্রছায়ায় তারা রাজশাহী অঞ্চলে জঙ্গী শাসন চালু করেছিল। তাদের ক’জনের বিচার ও শাস্তি হলেও প্রশিক্ষিত অনুসারীরা এখনও তৎপর। খালেদা-নিজামীর আমলেই পল্টন ময়দানে ধ্বনিত হয়েছিল তাদের জোটের শরিক দল জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদের লালনকারী নেতাদের কণ্ঠে ‘আমরা হব তালেবান/ বাংলা হবে আফগান।’ এরাই আদি অকৃত্রিম জঙ্গীবাদের ধারক-বাহক, খালেদা জোটের অপর শরিক দল প্রধান মুফতি ইজহারুদ্দিনের চট্টগ্রামের বাড়িতে অস্ত্রের কারখানা পাওয়া গেছে। তাকে গ্রেফতার করা হলেও আজও বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। খালেদার শাসনামলে বোমা হামলা সম্পর্কে কথা উঠলেই জামায়াতীরা বোমাবাজি ও জঙ্গী তৎপরতাকে মিডিয়ার সৃষ্টি বলে উড়িয়ে দিত। বাংলা ভাইয়ের জঙ্গী তৎপরতাকেও এরা অস্বীকার করে আসছিল। কিন্তু মিথ্যাচার দিয়ে তা ঢেকে রাখা যায়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল যারা, তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা চায় নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ও পাকিস্তানীমনাদের উত্থান ঘটিয়ে দেশটাকে তাদের কব্জায় নিতে। এই শক্তি তাদের বশংবাদদের বিচার ও শান্তিতে উদ্বিগ্ন এবং এর বিরুদ্ধে জাতিসংঘেও যেতে চায়। আর হেগে নালিশ জানিয়েও যুদ্ধাপরাধী রক্ষায় কোন লাভ হয়নি। বরং এরা যে অপরাধী তা আবারও প্রমাণিত হলো। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি ঠেকাতে বিশ্বের প্রায় সবশক্তি, এমনকি জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে ধরনা দিয়েও কোন অর্জন হয়নি। তবে অপপ্রচারে সফলতা পেয়েছে। তাদের নিয়োজিত লবিষ্টরা বিদেশে বাংলাদেশবিরোধী এমনকি যুদ্ধাপরাধ আদালতের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে মিথ্যাচার চালিয়ে বিদেশীদের মনে সন্দেহ প্রবেশ করিয়েছে। ব্রিটিশ এমপিকে দিয়ে পার্লামেন্টে প্রশ্নও তুলেছে। সবই জামায়াতের অর্থের মাজেজা। ২০১৫ সালের এপ্রিলে সাংবাদিক সম্মেলনে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। কিন্তু কি সেই আন্দোলন কি তার লক্ষ্য? দেশবাসীর জীবনে যে সব দাবি-দাওয়ার প্রতিফলন নেই, প্রয়োজন নেই, সে সব দাবি-দাওয়া নিয়ে সহিংস অরাজকতার নাম যদি হয় আন্দোলন, তবে তার বিজয় আসবে কোথা থেকে। মূলত নির্বাচনের মাধ্যমে বৈধভাবে শাসক পরিবর্তনের পথ বেছে না নিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট নির্বাচন বানচালের পথ বেছে নিয়েছিল। সহিংসতাকে আশ্রয় করে দেশব্যাপী অরাজক অবস্থা তৈরির তাদের সেই প্রচেষ্টাও মাঠে মারা যায়। নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার মাত্রা তারা আরও তীব্র করে। আন্দোলনের নামে আগুন সন্ত্রাসে যা করেছে, তা দেশবাসী ভুলে যায়নি। সেই পথে ব্যর্থ হয়ে চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য গুপ্তহত্যাকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। আন্দোলন হচ্ছে সরকার উৎখাত করার জন্য। আর তা সম্ভব করা গেলে দুর্নীতি ও যুদ্ধাপরাধের মামলা থেকে রেহাই পেতে পারে বিএনপি-জামায়াত নেতারা। অন্ধকারের শক্তি বহুবার শুভকে গ্রাস করার চেষ্টা করেছে, ক্ষতি করেছে কিন্তু নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। গুপ্তহত্যা করে সরকারের পতন যে ঘটানো যায় না, তার নজির অতীতে রয়েছে। গুপ্তহত্যা যারা করছে তারা হয়ত দেশবাসীর মনে ভয়ভীতি ছড়াতে পারছে। কিন্তু তা খুব বেশি দিন সম্ভব হবে না। যেমন হয়নি আগুন সন্ত্রাস চালানো। এই যে দেশজুড়ে নৃশংস টার্গেট কিলিং চলছে, তাতে বিএনপি-জামায়াত জোট ও তাদের মতাদর্শের কেউ শিকার হচ্ছেন না। যদি হতো তবে স্পষ্ট হতো যে, আইএস জঙ্গীরা এসব চালাচ্ছে। কিন্তু খালেদা-জামায়াত পরিচালিত বলেই জঙ্গীরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, মুক্তমনাসহ বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীদের হত্যা করছে। যেভাবে নিজামী মুজাহিদের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী একাত্তর সালে হত্যাযজ্ঞ চালাত। তারা বাড়ি থেকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে গিয়ে বধ্যভূমিতে হত্যা করত বেয়নেটে খুঁচিয়ে আর তাদের উত্তরসূরিরা এখন বাড়িতে-রাস্তায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করছে। এসব হত্যাকা- কোনটাই মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংগঠন আইএস-এর পদ্ধতির নয়। শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বকে উস্কে দিয়ে আইএসকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশে এ ধরনের ধর্মীয় বিভেদ নেই। এখানকার হত্যাকা-ের পেছনে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা যেমন আছে, তেমনি রয়েছে রাজনৈতিক মতাদর্শ। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যাদের জনসমর্থন নেই, তারা বাস্তবতাবিবর্জিত পথ ধরবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাই তারা জঙ্গীবাদের দিকে ধাবিত হয়েছে। এর সঙ্গে ধর্মের ন্যূনতম সংযোগ নেই। অপরাধ বিজ্ঞানীরাও মনে করছেন, সরকার বা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টায় একের পর এক হত্যাকা- ঘটানো হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে পরিচালিত হত্যাকা-ের নেপথ্যে অর্থনৈতিক যোগসাজশ রয়েছে। সরকার জামায়াত-শিবিরের প্রকাশ্য সন্ত্রাস দমন করায় তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে আরও ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক তৎপরতায় নেমে মানুষ হত্যা করছে। জঙ্গীদের বিভিন্ন গোষ্ঠীকে নিয়ে জোট করার চেষ্টা করছে বিএনপি-জামায়াত জোট। জনগণ এটা বোঝেন, সুশীল সমাজের বোধে কাজ না করলেও যে, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে কাদের লাভ। ঘোলা পানিতে রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ির ফাঁকে একের পর এক হত্যাকা- সংঘটিত করে কোন্ পক্ষ লাভ হচ্ছে, তা সুশীল সমাজের বিবেচনায় নেয়া উচিত। জঙ্গীবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান শুরুর পর খালেদা শিবিরে ত্রাহি ত্রাহি রব ওঠার মধ্য দিয়ে আরও স্পষ্ট হয় যে, জঙ্গীরা আটক হয়ে গেলে খালেদার ‘চূড়ান্ত বিজয়’ অর্জন পথ ক্ষীণ ও সঙ্কুচিত হয়ে যাবে। বিএনপির মহাসচিব এই অভিযান বিএনপি-জামায়াত জোটের ওপর ‘দমন-পীড়ন’ বলে যে আশঙ্কা করছেন, তা অমূলক নয়, তখনই বলা যাবে, যদি জঙ্গী ধরা না পড়ে। গুপ্ত হত্যাকারীরা ধরা পড়া মানেই তাদের দেশকে অস্থিতিশীল করার আন্দোলনের (!) তিরোধান ঘটবে। মহাসচিব তো স্বীকারই করেছেন এই সাঁড়াশি অভিযানের মাধ্যমে তাদের সেই কৌশল, যে কৌশলের মাধ্যমে জনগণের আন্দোলন তথা আগুন সন্ত্রাস দমিয়ে দিয়েছিল, সাঁড়াশি অভিযানের মাধ্যমে তাদের সর্বশেষ অপচেষ্টা গুপ্তহত্যাও দমিত হয়ে যাবে। তখন আর তাদের আন্দোলন বা বিজয় ঠিকই দমিত হয়ে যাবে। এই জঙ্গীদের তারা ২০০৪, ২০০৫ সালে ব্যবহার করেছিল। বোমা ও গ্রেনেড হামলার সে সব ঘটনার মামলাগুলোর অধিকাংশ ঝুলে আছে। তাদের সৃষ্ট জঙ্গীরা আজও সক্রিয়। সুতরাং তারা ধরা পড়ে গেলে সব পরিকল্পনাই যে মাঠে মারা যাবে। ‘বাংলাদেশে জঙ্গী আছে এবং তারা আইএস’Ñএমন ধারণা তারা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে। এর মাধ্যমে নিজেদের অপকর্মকে আড়াল করার একটা পথও পেয়ে যাচ্ছে তারা। গুপ্তহত্যাকারীদের রাজনৈতিক পরিচয় আড়াল করার জন্য মার্কিন ওয়েবসাইট থেকে দাবি করা হয়, আইএস ঘটিয়েছে। বিতর্কিত এই সাইটটির নেপথ্যে কারা এবং কারা এর অর্থ যোগান দেয়Ñ তা জনগণকে জানানো সরকারের দায়িত্ব। এমনিতেই বেগম জিয়া এই হত্যাকা- সরকার ঘটাচ্ছে বলে নিজের অপরাধ আড়াল করতে চান। তার শাসনামলে ২১ আগস্ট ও ১৭ আগস্টের ঘটনা সরকারে থেকে তিনি ও তার অনুগতরা যে ঘটিয়েছেন, সেই আলোকে তিনি হয়ত এভাবে বলছেন। কিন্তু গোয়েবলসীয় কায়দায় মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করার দক্ষতা তার একান্ত নিজের। খালেদা জিয়া যদি অবরোধ প্রত্যাহার করে নেন, আশা করি সেই সঙ্গে তার গুপ্তহত্যার জঙ্গনামাও প্রত্যাহৃত হবে। দেশজুড়ে যে সাঁড়াশি অভিযান চলছে, তাতে জঙ্গী নির্মূল হবে এমনটা নয়। তবে জঙ্গীদের বিরুদ্ধে সরকার যে প্রাথমিক পদক্ষেপ নিয়েছে, তা জনমনে এক ধরনের স্বস্তি এনে দেবে। সরকারের উচিত গণমাধ্যমের সহায়তায় জঙ্গীবিরোধী জনমত গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেয়া। একই সঙ্গে পুলিশ বাহিনীকে দক্ষ করে গড়ে তোলা জরুরী।
×