ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গোয়েন্দারাও একমত

টার্গেট কিলিং ॥ জঙ্গী যোগসূত্রের সমীকরণ-

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ১২ জুন ২০১৬

টার্গেট কিলিং ॥ জঙ্গী যোগসূত্রের সমীকরণ-

হাসান নাসির ॥ “আমরা যখন কথা বলি, মনে রেখে দেবেন, কোন অমূলক কথা বলি না। একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না, আমি হেড অব দ্য গবর্নমেন্ট। আমার কাছে নিশ্চয়ই তথ্য আছে। তদন্তের স্বার্থে হয়ত প্রচার করা যাবে না। কিন্তু সূত্রটা জানা আছে। আমরা সূত্র ধরেই কথা বলি।” দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন এমন দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন তখন হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। সৌদি আরব থেকে ফিরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি যা বলেছেন, তা কোন মেঠো বক্তব্য নয়। বিশ্বাস করতে হয় যে, সরকারপ্রধান যা বলেছেন তা পর্যাপ্ত তথ্য নিয়েই বলেছেন। দেশে একের পর এক ঘটে চলেছে টার্গেট কিলিং। সেই টার্গেট এখন আর সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয় বরং ব্যক্তি ছাড়িয়ে গড়িয়েছে পরিবার পর্যন্ত। সকল হত্যাকা-ের ধরন একই। কারা এই খুনোখুনিতে মেতে উঠেছে তা তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণসাপেক্ষ হলেও অনুমান করা কষ্টসাধ্য নয়। ‘জঙ্গী’ শব্দটি এদেশে প্রথম পরিচিতি পায় দৈনিক জনকণ্ঠের মাধ্যমে। জঙ্গী নিয়ে সবচেয়ে বেশি লেখালেখি হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক জনকণ্ঠে। পর্যায়ক্রমে প্রায় সকল পত্রিকায় গুরুত্বের সঙ্গে আসতে শুরু করে জঙ্গী প্রসঙ্গ। বেগম জিয়া সরকারের তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী জামায়াতে আমির মতিউর রহমান নিজামী বলেছিলেন, ‘দেশে কোন জঙ্গী নেই, জঙ্গী মিডিয়ার সৃষ্টি।’ তার এই কথা যেন ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না’ প্রবাদটির মতোই। পরে দেশজুড়ে সিরিজ বোমা, বিচারক হত্যা এবং শায়খ আবদুর রহমানÑবাংলা ভাইয়ের ফাঁসির মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয় যে, দেশে জঙ্গী ছিল এবং আছে। বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগও তখন জঙ্গী ইস্যুতে ছিল উচ্চকণ্ঠ অথচ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর সেই আওয়ামী লীগও নানা আন্তর্জাতিক পেক্ষাপট বিবেচনায় দেশে জঙ্গীগোষ্ঠীর অস্তিত্ব স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করে। এমন শৈথিল্যের সুযোগ নিয়ে তাদের অবস্থান ক্রমেই সুসংহত হতে থাকে। কোন ঘটনা ঘটলে সরকারের পুলিশ বলে এক কথা, সরকার তথা মন্ত্রীরা বলেন আরেক কথা। আবার বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দেয়ার প্রয়াসও পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু সর্বশেষ চট্টগ্রামে একজন এসপি-পতœী নৃশংসভাবে খুন হওয়ার পর টনক নড়ে পুলিশের, সরকারও জঙ্গী প্রশ্নে পরিষ্কার একটি অবস্থানে উপনীত হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। সম্ভবত এই প্রথম কোন হত্যাকা-কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিচ্ছিন্ন ঘটনা না বলে এর সঙ্গে জঙ্গীসম্পৃক্ততা রয়েছে বলে মত প্রকাশ করলেন। পুলিশের ভাষ্যও একই। সৌদি আরব থেকে ফিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আঙ্গুলও জঙ্গীদের দিকে। তবে তিনি জঙ্গীকা- ও গুপ্তহত্যার সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের যোগসূত্রতা থাকার বিষয়টিও বলেছেন পরিষ্কারভাবে। আর এতেই তীব্র প্রতিক্রিয়া বিএনপি মহল থেকে। কিন্তু যোগসূত্র যে আছে, তা বুঝতে খুব বেশি গবেষণার প্রয়োজন পড়ে না। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে সরকার হটাতে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডাররা ২০১৩ সালে দেশজুড়ে চালিয়েছিল নারকীয় তা-ব। তখন প্রধান টার্গেট ছিল পুলিশ। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের ওপর একের পর এক চলেছে চোরাগোপ্তা হামলা। আন্দোলনের নামেও সবচেয়ে বেশি হামলা হয়েছে পুলিশের ওপর। এদেশে পুলিশের গুলিতে আন্দোলনকারী নিহত হওয়ার ঘটনা অনেক থাকলেও আন্দোলনকারীদের হাতে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নিহত হয়েছে এমন ঘটনা এর আগে ঘটেনি। কিন্তু প্রাণ দিতে হয়েছে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যদেরও। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে মারমুখী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল জামায়াত-শিবির। জঙ্গী কারা? সাধারণত এ প্রশ্নের জবাবে আসে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনগুলোর নাম। কোন ঘটনা ঘটলে সর্বাগ্রে সন্দেহের মধ্যে আসে জামা’আতুল মুজাহিদিনসহ কয়েকটি সংগঠন। কিন্তু বৈধভাবে রাজনীতি করছে এমন জঙ্গী সংগঠনও এদেশে রয়েছে। পুলিশের গোয়েন্দা তথ্যে এখন ঘুরে ফিরে আসছে জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের নাম। চট্টগ্রামে এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী নিহতের ঘটনায় সন্দেহের তালিকায় এই সংগঠনটিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে রাখা হয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, জেএমবিরা অবৈধ জঙ্গী সংগঠন আর জামায়াত-শিবির এদেশে বৈধ জঙ্গী সংগঠন। বস্তুত এদের কার্যক্রমের মধ্যে কোন তফাত নেই। শুধু তাই নয়, জঙ্গী সংগঠনগুলোর কোন সদস্যকে গ্রেফতার করার পর তার অতীত পর্যালোচনায় দেখা যায়, পূর্বে কোন না কোন সময় জামায়াত-শিবিরের সঙ্গেই সম্পৃক্ত ছিল। শুধু তাই নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গী আস্তানায় অভিযান চালিয়ে জামায়াত-শিবিরের পুস্তিকা, প্রচারপত্র ও জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর ওয়াজের ক্যাসেটও পাওয়া গেছে। এতে প্রমাণ হয় আলাদা সংগঠন হলেও এরা মূলত জামায়াতের সঙ্গেই মিলেমিশে একাকার। জামায়াত-শিবির দেশের মানুষ ও প্রশাসনের দৃষ্টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে পরিকল্পিতভাবে এই পকেটগুলো সৃষ্টি করেছে কিনা সেই সন্দেহও অমূলক নয়। কারণ নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনগুলো থাকায় সুবিধা হচ্ছে জামায়াত-শিবিরেরই। কারণ কোন ঘটনা ঘটলেই সন্দেহের তীর সেদিকে যায়। আর এই গোষ্ঠীটি থেকে যায় চিন্তার বাইরে। গোয়েন্দা পুলিশের বিভিন্ন সূত্র জামায়াত-শিবির ও জঙ্গী সংগঠনগুলোর আন্তঃসম্পর্কের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তাভাবনা করছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সরাসরি ইঙ্গিত করেছে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের দিকে। এ ধরনের বক্তব্য অতীতেও দেয়া হলেও তার এবারের বক্তব্যটি গতানুগতিক নয়। কারণ তিনি বেশ জোর দিয়েই বলেছেন, আমার কাছে তথ্য আছে। এর আগে এতটা জোরালো উচ্চারণ শোনা যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে একমত রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ। এ ব্যাপারে বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, জামায়াতের অঙ্গ সংগঠন ছাত্র শিবিরের রাজনীতি এদেশে বৈধ হলেও এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। বিশ্বখ্যাত নিরাপত্তাবিষয়ক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘আইএইচএস জেনস’ প্রকাশিত গ্লোবাল টেররিজম এ্যান্ড ইনসারজেন্সি এ্যাটাক ইনডেক্স-২০১৩-এ পৃথিবীর শীর্ষ ১০টি সন্ত্রাসী সংগঠনের মধ্যে বাংলাদেশের ছাত্র শিবিরকে রাখা হয়েছে তিন নম্বরে। এর মধ্যে এক নম্বরে থাইল্যান্ডের বারিসান রেভুলুসি ন্যাশনাল ও দুই নম্বরে রয়েছে আফগানিস্তানের তালেবান। ২০১৩ সালে সারাবিশ্বে সংঘটিত জঙ্গী ও সন্ত্রাসী ঘটনা এবং সহিংসতার পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয় এই তালিকা। এতে উঠে আসে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দ- কার্যকরকে কেন্দ্র করে প্রতিদিনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সাধারণ মানুষের ওপর হামলা এবং অসংখ্য হতাহতের ঘটনা। পুলিশের গাড়িতে আগুন, ইট দিয়ে পুলিশের মাথা থেঁতলে দেয়া ও নিরীহ যাত্রীবাহী বাসে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মারার ঘটনাগুলো।
×