ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আজ বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ১২ জুন ২০১৬

আজ বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস

নিখিল মানখিন ॥ শিশুশ্রম কমলেও ঝুঁকি কমেনি। দশ বছর আগে দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৪৯ লাখ ১০ হাজার। আর বর্তমানে সেই সংখ্যা নেমে এসেছে ২৪ লাখ ৮০ হাজারে। ভাগ্যহত শিশুদের ওপর চালিত একটি জরিপে এ তথ্য বেরিয়েছে। সেভ দ্য চিলড্রেন সুইডেন-ডেনমার্কের সহযোগিতায় গবেষণাটি পরিচালনা করেছে সেন্টার ফর সার্ভিসেস এ্যান্ড ইনফরমেশন অন ডিজএ্যাবিলিটি (সিএসআইডি)। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমুখী কর্মসূচী বাস্তবায়িত হলেও শিশু শ্রমিকের সংখ্যা উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়ে গেছে। শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে অল্প বয়সী এসব শিশু অমানবিক পরিশ্রম করছে। শিশুশ্রম বন্ধে কঠোর আইন থাকলেও তার প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন না থাকায় শিশুশ্রম বন্ধ করা যাচ্ছে না শিশুশ্রম বন্ধে একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করে জোরালোভাবে তা পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যারা শিশুদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করে, তাদের সচেতন করতে মন্ত্রণালয় থেকে নোটিস জারি করতে হবে। জাতীয় শিশুনীতিতে এটা স্বীকার করা হয় যে, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে শিশুরা নানা শ্রমে নিয়োজিত হয়। এ ক্ষেত্রে গ্রাম-শহরের ভেদ নেই। সরেজমিন ঘুরে শিশুশ্রমের করুণ চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। রাজধানীর নিউ ইস্কাটন রোডে একটি কার সার্ভিসে কাজ করে ১২ বছরের শিশু শামীম। মেরামত করাতে আসা কোন গাড়ির ড্রাইভারকে ডাক দিয়ে সার্ভিস সেন্টারে টেনে নিয়ে যাওয়াই তার কাজ। এর বিনিময়ে তাকে দেয়া হয় দু’বেলা ভাত। মাস শেষে ধরিয়ে দেয়া হয় নামমাত্র কিছু টাকা। মা খালেদা অন্যের বাসায় কাজ করেন এবং বাবা ঠেলাগাড়িতে করে সবজি বিক্রি করেন। আর্থিক সঙ্কটে পড়ে তৃতীয় শ্রেণীতেই তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। রাজধানীর ফার্মগেট এলাকার একটি খাবার হোটেলে থালাবাসন ধোয়ার কাজে ব্যস্ত ১০ বছরের শিশু মোঃ হাবিব। সকালে নাশতা বানানোর কাজে সহায়তা করা থেকে শুরু করে বাসন মাজা, ঘর ঝাড়ু দেয়া, বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত থাকে সে প্রতিদিন। টাঙ্গাইল থেকে আসা ১০ বছর বয়সী এই শিশুটি জানায়, ৪ ভাইবোনের সংসারে সে দ্বিতীয় সন্তান। দরিদ্র বাবা-মায়ের কষ্ট একটু ঘোচাতে ৫ বছর আগে সে ঢাকায় আসে। নেত্রকোনার ১৩ বছরের শিশু মাসুম মগবাজার পেয়ারাবাগ কাঁচাবাজারের পাশের একটি চা দোকানে কাজ করে। তার মালিক কাশেম চা তৈরি করেন। আর লোকজনের হাতে চা তুলে দেয় মাসুম। আশপাশের দোকানে দোকানে গিয়েও তাকে চা দিয়ে আসতে হয়। শিশু মাসুম জানায়, মা রাহেলা বেগম অন্যের বাসায় কাজ করেন। বাবা সবুজ মিয়া রিক্সা চালান। তিন ভাইবোনের মধ্যে সে সবার বড়। অসচ্ছলতার কারণেই সে লেখাপড়া করতে পারছে বলে জানায় শিশু মাসুম। শিশুটির নাম হাবিব, জন্মের কিছুদিন পরই দিনমজুর বাবাকে হারিয়েছে। ওই পরিবারে নেমে আসে কালো ছায়া। বাঁচার তাগিদে শিশু থেকেই কাজে নেমেছে সে। এখন তার বয়স ১৪ বছর। যে বয়সে তার স্কুলের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ছোটাছুটি করার কথা, তখন সে মগবাজার রেলগেটের একটি ওয়ার্কশপের ঝালাইসহ রড-টিন কাটা ও হাতুড়ি পেটানোর মতো অধিক ঝুঁঁকিপূর্ণ কাজ করছে। শুধু শিশু হাবিব নয়, ১১ বছরের ইকবাল চালায় রিক্সা, ৯ বছরের জাফর করছে খাবার হোটেলের কাজ। ১০ বছরের শিশু জয়নাল পরিত্যক্ত শাক-সবজি, ফলমূল কুড়োয় কারওয়ানবাজারে। এসব কুড়িয়ে সে তার মায়ের কাছে জমা দেয়। আর তার মা সেগুলো পরিষ্কার করে বাজারের এক পাশে ভাগা সাজিয়ে বিক্রি করে। এসব কুড়োতে গিয়ে অনেক সময় ব্যবসায়ীদের দ্বারা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় বলে জানায় শিশু জয়নাল। এভাবে সারাদেশে এ রকম শত শত শিশু এখন জীবনধারণ ও বেঁচে থাকার তাগিদে দৈনিক ২০-৫০ টাকা আয়ে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নেমেছে। অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়ে বাবা-মা শিশুকে সামান্য টাকার বিনিময়েই এসব কাজে লাগিয়ে দিচ্ছেন। আর মালিক পক্ষও অনুকরণ প্রিয় শিশুদের কম টাকায় অধিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সুযোগ লুফে নিচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দ্বিতীয় ন্যাশনাল প্ল্যান অব এ্যাকশন ফর চিলড্রেনে (১৯৯৭-২০০২) দেশে শিশুশ্রমের বিষয়টি প্রথম চিহ্নিত হয়। ২০০১ সালের মার্চ মাসে সরকার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ১৮২ নম্বর ধারায় অনুসমর্থন দেয়। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সে বছরই জাতীয় শিশুনীতি প্রণয়ন শুরু করে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ ধারায় শিশুদের সুবিধাপ্রাপ্তি-সংক্রান্ত বিশেষ বিধান রয়েছে। শ্রম আইন, ২০০৬ অনুসারে, কাজে যোগদানের ন্যূনতম বয়স হচ্ছে ১৪ বছর আর ঝুঁকিপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে তা ১৮ বছর। ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সের মধ্যে হালকা কাজ করলে সেটাকে ঝুঁকিমুক্ত কাজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা তাদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে শিশুশ্রম কমেছে, এটা স্বস্তির খবর। সরকারী-বেসরকারী প্রচেষ্টায় ছিন্নমূল ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিদ্যালয়ে গমনের হার বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে জড়িত এই সাফল্য। তবে এটাই যথেষ্ট নয়। কারণ সিএসআইডির গবেষণাতেই বেরিয়ে এসেছে, শিশুশ্রম কমলেও দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা এখনও ঢের বেশি। গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, চরম দারিদ্র্যের কারণেই শিশুরা শ্রমে নিয়োজিত হতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে সরকারকে যেমন একদিকে শিশু অধিকার সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে, তেমনি দারিদ্র্য হ্রাসে আরও মনোযোগ দিতে হবে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে। শিশুশ্রম কমার ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই এর প্রভাব রয়েছে। বিপুলসংখ্যক শিশুকে এমন মানবেতর অবস্থায় রেখে আমরা নিজেদের কোনভাবেই সভ্য, মানবিক ও গণতান্ত্রিক দাবি করতে পারি না। তাদের কচি হাত হাতুড়ি পেটানোর জন্য নয়, বাসন ধোয়ার জন্য নয়, ভারি বস্তু মাথায় তোলার জন্য নয়; পেনসিল দিয়ে খাতায় বা দেয়ালে আঁকিবুঁকি করার জন্য। যখন কল্পনার ডানায় ভর করে স্বপ্নের দেশে চলে যাওয়ার সময়, তখন তারা কারখানায়, রান্নাঘরে বা রাস্তায় হারভাঙ্গা খাটুনি করতে করতে ক্লান্ত। এই অবস্থা কখনই কাম্য নয় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। শ্রম মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, দেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে ১৩ লাখ শিশু। এসব শিশুকে শ্রমে নিয়োগের ব্যাপারে ব্যাপক বিধিনিষেধ রয়েছে। তবে পারিপাশ্বিক অবস্থা ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে শর্তসাপেক্ষে জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতিতে শিশুদের শ্রমে নিয়োগের অনুমতি দেয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে শিশুদের কাজ করার জন্য অনুকূল কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও বাস্তবে সেসব শর্তের সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র লক্ষ্য করা গেছে অনেক কারখানায়। পুরান ঢাকার ট্যানারি কারখানাগুলোতে শিশুরা ভয়াবহ পরিবেশে কাজ করছে। মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের কয়েকটি লোহার কারখানায় দেখা গেছে, শিশুদের দিয়ে ভারি লেদ মেশিনে কাজ করানো হচ্ছে। কর্মঘণ্টা এবং দৈনিক কর্মতালিকার কোন বালাই নেই সেখানে। সপ্তাহে একদিন ছুটির ব্যবস্থা থাকলেও চাকরিচ্যুত করার আগে কোন নোটিস দেয়া হয় না। এছাড়া কর্মস্থলে তারা বড়দের দ্বারা নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। জাতীয় শিশুনীতি ২০১১ অনুসারে ৫ থেকে ১৮ বছরের শিশু কোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে পারবে না। ৫ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত শিশুশ্রম নিয়োগকর্তার জন্য দ-নীয় অপরাধ। কিন্তু এ আইন শুধু কাগজে-কলমেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শ্রমে নিয়োজিত অধিকাংশ শিশু মানসিক ও শারীরিকসহ নানা ঝুঁকির মধ্যে জীবনযাপন করছে। শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারপার্সন এনামুল হক চৌধুরী জানান, শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে এসব শিশুকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। শিশুশ্রম প্রতিরোধে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দরিদ্রতা। আইএলওর হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীতে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২৪ কোটি ৬০ লাখ। প্রতি ছয়জন শিশুর মধ্যে একজন শিশুশ্রমে নিযুক্ত। পাচার, সন্ত্রাস, নির্যাতন প্রভৃতি কারণে প্রতিবছর প্রায় ২২ হাজার শিশু মারা যায়। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে দেশে শিশুর সংখ্যা ৬ কোটিরও বেশি। ৯০ শতাংশ প্রাথমিকভাবে স্কুলে গেলেও শিক্ষা সমাপ্ত করার আগেই অর্ধেকের বেশি ছেলেমেয়ে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার এক জরিপে দেখা গেছে, ৫৭ শতাংশ শিশুশ্রম দিচ্ছে কেবল খাদ্যের বিনিময়ে। ২৩.৭ শতাংশ শিশুকে মজুরি দেয়া হলেও এর পরিমাণ শিশু আইনের তুলনায় নগণ্য। এদিকে বাংলাদেশে এখনও সাড়ে ৩ শতাংশ শিশু স্কুলের বাইরে রয়েছে বলে জানিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সূত্রটি জানায়, সারাবিশ্বে ১শ’ কোটি এবং বাংলাদেশে ৩ থেকে সাড়ে ৩ শতাংশ শিশু, যাদের স্কুলে যাবার কথা, তারা স্কুলের বাইরে রয়েছে। এসব শিশুর বিপুল অংশ ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের সঙ্গে জড়িত। শিশুদের শ্রমের বিরুদ্ধে সরকারী, বেসরকারী ও ব্যক্তিগতভাবে অনেকে অনেক ধরনের কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত। এসব কর্মকা-ের কমবেশি সফলতাও রয়েছে। তবে সরকারের মূল লক্ষ্য হলো একটি শিশুও যেন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়। আমরা সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি। ইসরাফিল আলম বলেন, শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে প্রথমে শিশুরা কেন শ্রমের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে সে বিষয়টি খুঁজে বের করতে হবে এবং সমস্যা সমাধানের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যেতে হবে। কেননা সকলের সহযোগিতা ছাড়া সরকারের একার পক্ষে এ ধরনের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। শিশুদের অধিকার রক্ষায় যে ৫টি মন্ত্রণালয় রয়েছে তাদের মধ্যে সমন্বয় করা প্রয়োজন।
×