ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

টার্গেট কিলিংয়ে বিব্রত সরকার ॥ পুলিশে বড় রদবদল আসছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১২ জুন ২০১৬

টার্গেট কিলিংয়ে বিব্রত সরকার ॥ পুলিশে বড় রদবদল আসছে

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ সাম্প্রতিক সময়ে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে দেশজুড়ে টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনা সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সংস্থাগুলোকে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথায় কিলিংয়ের এসব ঘটনা ঘটছে। সেবায়েত, পুরোহিত, ভিক্ষু এমনকি উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীও এ জাতীয় হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন এবং আগামীতে এ ধরনের হত্যাকা-ের টার্গেটে কারা রয়েছেন তা নিয়েও এক ধরনের শঙ্কা বিরাজ করছে। শুক্রবার মধ্যরাত থেকে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে দুর্বৃত্ত, সন্ত্রাসী ও জঙ্গীবিরোধী সর্বাত্মক অভিযান। চলবে এক সপ্তাহ। আইজিপি এমনই ঘোষণা দিয়েছেন। বিষয়টি পুলিশের চলমান অভিযানের পাশাপাশি একটি বিশেষ অভিযান হিসেবে চালানোর সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের দায়িত্বশীল একটি সূত্র শনিবার জনকণ্ঠকে জানায়, এ অবস্থায় দেশব্যাপী জেলা ও মেট্রোপলিটন পুলিশে কর্মকর্তা পর্যায়ে বড় ধরনের রদবদলের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দেশের যে সমস্ত এলাকায় টার্গেট কিলিংসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে যেসব কর্মকর্তা কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছেন তাদের সরিয়ে দেয়া হবে। দু’দিন আগে পুলিশ সদর দফতরে দেশের সকল ডিআইজি ও মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারদের নিয়ে আইজিপি একেএম শহীদুল হক জরুরী বৈঠক আহ্বান করেন। এ বৈঠকে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। আইজিপি যেসব জেলা বা মেট্রো এলাকায় এ পর্যন্ত টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনা ঘটেছে সেসব এলাকার শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সার্বিক পরিস্থিতি জানতে চান। কারণ, কয়েকটি হত্যাকা-ের ঘটনার সময় আইজিপি ছিলেন দেশের বাইরে। তাই প্রত্যক্ষ ধারণা অবহিত হতে আহূত হয় এ বৈঠক। আইজিপির বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে ডিআইজি ও মেট্রোপলিটন কমিশনারগণ স্ব স্ব এলাকার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা দেন। ওই বৈঠকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার ইকবাল বাহার ও চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি মোঃ শফিকুল ইসলামের মধ্যে ব্যাপক বাগ্বিত-ার ঘটনা ঘটে। সিএমপিতে এসপি বাবুল আক্তারের পতœী মাহমুদা খানম মিতুর নৃশংস হত্যাকা-ের ঘটনা আলোচনায় আসার পর এ বিত-ার ঘটনা ঘটে। উল্লেখ্য, ইকবাল বাহার ও শফিকুল ইসলাম দু’জনই ব্যাচমেট এবং ক্লাসমেটও। কিন্তু সিএমপিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিষয়ে ব্যাপক অভিযোগ তোলেন ডিআইজি শফিকুল ইসলাম। এ ঘটনা আইজিপি একেএম শহীদুল হকের সামনেই ঘটে। ডিআইজি শফিকুল ইসলামের অভিযোগ, সিএমপিতে দক্ষ কর্মকর্তার বড় ধরনের ঘাটতি হয়েছে এবং কর্মকর্তাদের অনেকেই এ বিষয়ে রহস্যজনকভাবে অমনোযোগী রয়েছেন, যে কারণে শেষ পর্যন্ত একজন চৌকস পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীকেও প্রাণ দিতে হলো। উত্তরে সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার এর প্রতিবাদ করেন এবং পাল্টা বক্তব্য দেন। পরে আইজিপি উভয়কে থামিয়ে দেন। ফলে বিষয়টি আর বেশিদূর এগোয়নি। চট্টগ্রাম মহানগরীতে যেদিন মাহমুদা খানম মিতু খুন হন সেদিনই কোন ধরনের তদন্ত ছাড়াই কমিশনার ইকবাল বাহার এ ঘটনা জঙ্গীদের দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেন। পরে আবার সন্দেহের তীর জামায়াত-শিবিরের প্রতিও ছুড়ে দেন। অপরদিকে, মিতু হত্যাকা-ের তদন্তের দায়িত্ব নগর গোয়েন্দা পুলিশকে অর্পণ করা হলেও তাদের সহযোগিতায় সার্বক্ষণিক মাঠে রয়েছে পিবিআই, সিপিআই, র‌্যাব ও সিআইডি। এছাড়া থানা পুলিশ তো রয়েছেই। হত্যাকা-ে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি উদ্ধার হয়েছে। এ বিষয়ে এ হত্যাকা-ে জড়িত সন্দেহে তিন মালিককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটকও করা হয়। এছাড়া হত্যাকা-স্থলের অদূরে অবস্থানরত কালো রঙের মাইক্রোবাসকে সন্দেহ করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে ওই মাইক্রোবাসটি আবুল খায়ের গ্রুপের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অফিসে আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে ভাড়ায় খাটে। মাইক্রোবাসের চালক মালিক নিজেই। তিনি নিজেই সিএমপিতে গিয়ে ঘটনাস্থলে অবস্থানের ব্যাখ্যা দেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, ওই রোড দিয়ে নিত্য তাকে যাওয়া-আসা করতে হয়। ওই দিনও ওই সময়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় আকস্মিক হত্যাকা-ের নির্মম ঘটনাটি দেখে খানিক দাঁড়িয়ে পরে তার গন্তব্যে চলে যান, যা ছিল কিলিং স্কোয়াড সদস্যদের পালিয়ে যাওয়ার সেই পথ। এতেই পুলিশের সন্দেহ দানা বেঁধেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সঠিক নয় বলে প্রমাণিত হয়েছে। অপরদিকে, এ পর্যন্ত এ ঘটনায় ১০ জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এছাড়া গ্রেফতার দেখানো হয়েছে হাটহাজারীর আবু নসর গুন্নু ও শনিবার আটক শাহ জামান ওরফে রবিন নামের এক যুবককে। চট্টগ্রামে এর আগে নার্সিং ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ অঞ্জলি দেবীকে ভোরে চকবাজার এলাকায় অজ্ঞাতানামা সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনার কোন বিহিত ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত হয়নি। এর পর এক ল্যাংটা ফকির ও তার শিষ্যকে মাজার প্রাঙ্গণে হত্যা করা হয়। এ হত্যা ঘটনার নেপথ্যে জেএমবির সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়েছে। এরপর ঘটল এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী হত্যাকা-। সাম্প্রতিক সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিম, নাইক্ষ্যংছড়িতে ভিক্ষু মং শৈ উ-কে, কুষ্টিয়ায় বাউলভক্ত মীর সানোয়ার হোসেনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দিরের পুরোহিত, সেবায়েত, খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মপ্রাণ মুদি দোকানি, টাঙ্গাইলের দর্জি নিখিল চন্দ্র এবং সর্বশেষ পাবনায় আশ্রম সেবায়েত নিত্যরঞ্জন পা-ের প্রাণ সংহার করেছে সন্ত্রাসী বা নৃশংস কায়দায়। এছাড়া আরও কয়েকটি স্থানে অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে, যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সঙ্গত কারণে পুলিশ মহলে বিষয়টি ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছে। সরকারপক্ষেও পুলিশকে আরও কঠোর দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, এ অবস্থায় পুলিশের প্রায় ১৭০ পদোন্নতিপ্রাপ্ত এসপির পদায়ন এবং জেলা ও মেট্রোপলিটন পুলিশের শীর্ষপর্যায়ের রদবদলের বিষয়টি সামনে এসেছে। জানা গেছে, এ বিষয়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সরকারের কাছে কর্মকর্তাদের ব্যাপারে রিপোর্ট পৌঁছানো হয়েছে, যা নিয়ে সহসা প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত প্রদান করবেন। ১৭০ পদোন্নতিপ্রাপ্ত এসপির তালিকাটি প্রধানমন্ত্রীর দফতরে আগেই পৌঁছেছে।
×