ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে শেখ হাসিনা

বিএনপি গুপ্তহত্যা করছে ॥ প্রকাশ্যে মানুষ হত্যার পর ব্যর্থ হয়ে

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১২ জুন ২০১৬

বিএনপি গুপ্তহত্যা করছে ॥ প্রকাশ্যে মানুষ হত্যার পর ব্যর্থ হয়ে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা চলমান গুপ্তহত্যার ঘটনায় বিএনপি-জামায়াত জোটকে পুনর্বার দায়ী করে বলেছেন, সম্প্রতি গুপ্তহত্যাসহ যেসব ঘটনা ঘটছে তার মদদদাতা হচ্ছেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। আন্দোলনের নামে প্রকাশ্য মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার পর ব্যর্থ হয়ে তারা এখন গুপ্তহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। সরকার যদি তাদের (বিএনপি-জামায়াত) প্রকাশ্য মানুষ হত্যা বন্ধ করতে পারে, তাহলে চলমান গুপ্তহত্যাও আমরা বন্ধ করতে পারব। এটি সময়ের ব্যাপার মাত্র। যারা এসব গুপ্তহত্যা করছে এবং মদদ দিচ্ছে তারা কেউই রেহাই পাবে না, ক্ষমা পাবে না। প্রধানমন্ত্রী কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত এবং সরকার ও দেশকে নানাভাবে হেয়প্রতিপন্ন ও ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতেই এসব গুপ্তহত্যা চালানো হচ্ছে। তবে এসব গুপ্তহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, এর হোতা কারা, অর্থ কারা দেয়, উৎসাহ কারা দেয়, কারা এসব ঘটনা নিয়ে সরকারের ব্যর্থতা দেখছে- এগুলো সবই বের করা হবে। আমরা এদের খুঁজে খুঁজে বের করব। বাংলাদেশে ছোট দেশ, এরা যাবে কোথায়! গুপ্তহত্যা বন্ধ এবং অশান্তি যারা সৃষ্টি করতে তাদের বিরুদ্ধে যা যা করা দরকার সবই করব। যারা উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে, তাদের কোন ক্ষমা ও রেহাই নেই। কেউ পার পাবে না। এর শান্তি তারা পাবেই। এদেশে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসী কর্মকা- চলবে না, চলতে দেব না। শনিবার গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। দলের ২০তম জাতীয় কাউন্সিল সফল করতেই এবং প্রস্তুতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয় বৈঠকে। বৈঠকে অধিকাংশ নেতাই পবিত্র ঈদ ও শোকের মাস আগস্টের কথা তুলে ধরে সম্মেলনের তারিখ পেছনোর দাবি জানালে প্রধানমন্ত্রী তাতে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। পরে সম্মেলনের নতুন তারিখ ঘোষণা করা হয়। সভার শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারামুক্তি দিবস উপলক্ষে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা তাঁকে ফুল-শুভেচ্ছায় স্নাত করেন। প্রধানমন্ত্রী অতীতের মতো ঐক্যবদ্ধভাবে বিএনপি-জামায়াত জোটের সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচী প্রতিহত করার মতো গুপ্তহত্যার বিরুদ্ধে দেশবাসীকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, কেউ যখন আঘাত করবে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দয়া করে দেখবেন না। বরং সবাই একজোট হয়ে সেটাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করবেন। আমাদের সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও আপনাদের সঙ্গে থাকবে। আর যারা এগুলো করে পালাতে চাইবে, রাস্তায় যারা থাকে তাদের বলব, এদের অন্তত ধরার চেষ্টা করবেন। ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেবেন, প্রতিরোধ করবেন। ঠিক যেভাবে করেছিলেন, ২০১৫-এর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের জ্বালাও-পোড়াও ও পুড়িয়ে মানুষ হত্যার ঘৃণ্য রাজনীতি। হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ভূ-খ-ের দিক দিয়ে ছোট। তবে জনসংখ্যা বেশি। এখানে সবাই সবাইকে চিনতে পারে বা জানতে পারে। গুপ্তহত্যায় জড়িতদের খুঁজে বের করাও খুব কঠিন কাজ নয়। আমরা এদের সূত্রগুলোও খুঁজে বের করব। আর কিছু সূত্র সরকারে কাছেও এসেছে, সব এক সময় বের হবেই। দেশী-বিদেশী যারাই এর পেছনে থাক, বাংলাদেশের মানুষ তা মেনে নেবে না। কেউ-ই রেহাই পাবে না। দীর্ঘদিনের প্রিয় ব্যক্তিত্ব কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হওয়ার কারণে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার দেশবাসীর ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছেন এমন অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশ সব দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা আলোর পথে যাত্রা শুরু করেছি। এই যাত্রায় তারা বাধা দিতে চায়। কেননা তারা যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে চেয়েছিল, আমরা বিচার করেছি। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া যাদের মন্ত্রী বানিয়েছিলেন, যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তারাই ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলছেন। তাঁর (খালেদা জিয়া) এত পেয়ারের বান্দাদের শাস্তি হয়ে যাচ্ছে, বিএনপি নেত্রী এ ব্যথা কী ভাবে ভুলবেন? এই যন্ত্রণা থেকেই বিএনপি নেত্রী জনগণের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছেন, এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। গুপ্তহত্যায় জড়িতদের উদ্দেশে করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ পুলিশের পরিবারের ওপর আঘাত করা হয়েছে। যারা এটা করে, তারা ভুলে যায় কেন যে তাদেরও পরিবার আছে। তাদেরও বাবা-মা, ভাই-বোন ও ছেলে-মেয়ে আছে। আঘাত দিলে প্রতিঘাত কিন্তু পেতেই হবে। তারা কী তাদের পরিবারকে এভাবে বিপদে ফেলতে চায়? আর জঙ্গিবাদী কর্মকান্ডে যেন তাদের সন্তানরা জড়িয়ে না পড়ে- সে জন্য অভিভাবকদেরও সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, নিজের পরিবারে খোঁজখবর নিন, আপনাদের কেউ এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে কি না। গুপ্তহত্যার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি নেত্রী বললেন আওয়ামী লীগই খুন করছে, আমি করেছি! কিন্তু খুন করার অভ্যাস তো আমার নেই, তাঁরই (খালেদা জিয়া) আছে। কেননা, তাঁরা আমাকে খুন করার জন্য বারংবার চেষ্টা করেছে। যেদিন বাংলাদেশে পা দিয়েছি, সেদিন থেকেই শুরু। এমন কোন জেলা নেই যে, আমাকে বাধা না দিয়েছে, আক্রমণ না করেছে। এ প্রসঙ্গে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তাঁর ওপর গ্রেনেড হামলার কথাও মনে করিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, যে গ্রেনেড যুদ্ধের ময়দানে ব্যবহার করা হয়, প্রকাশ্য দিবালোকে সে গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়েছে ঢাকা শহরের রাজপথে। সরকারের মদদ না থাকলে, তাঁর (খালেদা জিয়া) নিজের ও তাঁর ছেলের মদদ না থাকলে এ ধরনের হামলা হয় কীভাবে? প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপি নেত্রীই মানুষ খুনের মদদ দেয়, খুন করাই তাঁদের চরিত্র। এটি সবাইকে বুঝতে হবে। তাঁর স্বামী জিয়াউর রহমানও নির্বিচারে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। তারাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, খুনিদের লালন-পালন ও পুরস্কৃত করেছে, ইনডেমনিটি দিয়ে বিচারের হাত থেকে রক্ষাও করেছে। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছেন। আর খালেদা জিয়া ওই খুনি ফারুক আর রশিদকে ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা ভূয়া নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে এনে বসিয়েছেন। এ সময় খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু সাজুগুজু করার জন্য আয়নায় চেহারা দেখা বন্ধ করুন। অতীতে কী কী অপকর্ম করেছেন, কীভাবে মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করিয়েছেন- তা মনে করার জন্যও চেহারাটা একটু আয়নায় দেখুন। আয়নায় খুনের চেহারাটাই ভেসে উঠবে। মনের আয়নাটা দেখেন কীভাবে খুনিদের মদদ দিয়েছেন। আর খালেদা জিয়া এখন ‘ঠাকুর ঘরে কেরে? আমি কলা খাই না’-প্রবাদের মতোই নিজেদের অপকর্ম আওয়ামী লীগের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, প্রতিদিন যত হত্যাকা- ঘটছে, প্রতিটির মদদদাতা তাঁরাই। এটি কী ভাবে তাঁরা অস্বীকার করেন? জনগণ যদি একটু ভালভাবে দেখে, তাহলে দেখবে কারা রক্তপাত ঘটায়, কারা মানুষ পুড়িয়ে মারে? কিছু হলেই দেশের কিছু মানুষ সরকারের ব্যর্থতা খুঁজে এমন মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী টানা দু’বছর বিএনপি-জামায়াত জোটের জ্বালাও-পোড়াও ও পুড়িয়ে নির্বিচারে মানুষ হত্যার ঘটনা তুলে ধরে বলেন, কিছু লোক আছেন, একটি হত্যা হলেই বলেন সরকারের ব্যর্থতা! যখন ২০১৩ ও ২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াত ধ্বংসযজ্ঞ চালালো, শত শত মানুষকে পুড়িয়ে মারলো- তখন তো তারা কিছুই বলেননি। তখন তাদের কণ্ঠও কিন্তু এতটা সোচ্চার ছিল না। তিনি বলেন, এখন গুপ্তহত্যা বন্ধ করার জন্য সরকার যা যা করার করবে। এই ব্যবস্থা গ্রহণের সময় সন্ত্রাসী ও জঙ্গীদের জন্য ওইসব ব্যক্তিরা যেন মনে ব্যথা না পান, তাদের পরান যেন না পোড়ে। এদের হোতা কারা তা খুঁজে বের করার পাশাপাশি কারা এর পেছনে সরকারের ব্যর্থতা দেখছেন- তাদেরও চিহ্নিত করা হবে। ধর্মের নামে মানুষ হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, ইসলাম ধর্ম কাউকে খুন করতে বলেনি। অহেতুক নিরীহ মানুষগুলোকে খুন করা- এটি কোন ধরনের ধর্ম পালন? আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই বলেছেন, তিনিই শেষ বিচার করবেন। যেখানে আল্লাহ বলেছেন, তিনিই বিচার করবেন আর সেই বিচারের ভার যখন বান্দা নিয়ে নেয়Ñ তখন তো সে আল্লাহ এবং রসুলকেও মানে না। সে ইসলাম ধর্মই মানে না। আসলে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারণে গোটা মুসলিম জাতির বদনামের ভাগিদার হতে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক ও সকল ধর্মের সম্প্রীতির দেশ। দেশের এই অসাম্প্রদায়িক চরিত্র নস্যাতের পরিকল্পনা থেকেই মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ব্যক্তিদের ওপর হামলা করা হচ্ছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ইমাম, পাদ্রি, পুরোহিত এসব হত্যা করে তারা (ঘাতকচক্র) কী মেসেজ দিতে চাচ্ছে? এই বাংলাদেশের ভূ-খ- তো এমন নয়। এখানে সব ধর্মের মানুষ শাস্তির সঙ্গে, সমান মর্যাদা নিয়ে বসবাস করবে। যার যার ধর্ম পালন করবে। যারাই এর পেছনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে, তাদের কেউই পার পাবে না। ২০০৮ সালের এই দিনে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দেশবাসীসহ আওয়ামী লীগের তৃণম’ল নেতা, প্রবাসী এবং দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে তাঁকে নির্বাচন না করার বিনিময়ে প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে রাখার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু আমি ওই প্রস্তাবের জবাবে পরিস্কার জানিয়েছিলাম যে, আমি দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করতে চাই। সেই কাজের সুযোগ পেতেই ক্ষমতায় যেতে চাই। কিন্তু সেটি অবশ্যই নির্বাচনের মাধ্যমে। জনগণ ভোট দিলে ক্ষমতায় যাব, না হলে নেই। পরে নেতাকর্মী ও দেশবাসীর আন্দোলন বিশেষ করে বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক-ছাত্রদের সাহসী ভূমিকায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে জনগণের কল্যাণ ও উন্নয়নে কাজ করছে। দু’মেয়াদে তাঁর সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকা-ের বিবরণ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ গড়ে তুলব। দেশকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, এগিয়ে নিয়ে যাবেই। জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তুলব। সেটি একমাত্র আওয়ামী লীগই পারবে। আর সেই পথে যারা বাধা সৃষ্টি করবে, তাদের সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই এদেশকে বিশ্বের বুকে মর্যাদা ও শান্তির দেশে পরিণত করা হবে। বাংলাদেশে কাউকে কোন অশান্তি সৃষ্টি করতে দেব না। যারাই অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধেই সরকার থেকে যা যা পদক্ষেপ না গ্রহণ করা হবে না।
×