ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

জামায়াত-শিবির কোন্ পথে?

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ১২ জুন ২০১৬

জামায়াত-শিবির কোন্ পথে?

কিছুদিন যাবত দেশের বহু মানুষের মনে একটি প্রশ্ন কাজ করছে। যুদ্ধাপরাধী রাজনৈতিক দল জামায়াত-শিবির এখন কোথায়? কী তাদের কার্যক্রম? তাদের প্রকাশ্য কোন কর্মকা-ে দেখা যাচ্ছে না। এমনকি কোন কর্মসূচী দিলেও সেটি বাস্তবায়িত হচ্ছে না। তার প্রমাণ সাম্প্রতিক সময়গুলোতে জামায়াতের ডাকা হরতালগুলো দেশের কোথাও পালিত হচ্ছে না। ঘটনা কী? এরকম নানান প্রশ্ন। আমার মতো অনেকই এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। আমি মনে করি জামায়াত-শিবির সঙ্কটে পড়েছেন তারপরও শেষ হয়ে যায়নি; এখনও নষ্ট ইতিহাসের অংশ হয়নি। শহরে নয় গ্রাম পর্যায়ে তারা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে তারা অনেকটা সফলও হয়েছে। সরেজমিনে বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে সহজেই উপলব্ধি করা যায়। একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। ক’মাস আগে দিনাজপুরে জামায়াত অধ্যুষিত বিরামপুর উপজেলায় গিয়েছিলাম। এই উপজেলা এবং পার্শ্ববর্তী আরও তিনটি উপজেলা নিয়ে জাতীয় সংসদের দিনাজপুর-৬ নির্বাচনী এলাকা। যে এলাকাটি থেকে বিএনপি-জামায়াত জোট সবসময় জামায়াতের প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়ে থাকে এবং সেখান থেকে জামায়াত প্রার্থী ১৯৯১ এবং ২০০১ সালের জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে। আমার ধারণা ছিল সাত-আট বছরে এলাকাটিতে জামায়াতের প্রভাব হয়ত অনেকটা কমে গেছে। কিন্তু মোটেও সেরকমটি নয়। সেখানে জামায়াত আরও বেশি সংগঠিত হয়েছে। তার প্রমাণও পেলাম। গত উপজেলা নির্বাচনে বিরামপুর উপজেলায় জামায়াত প্রার্থী আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সঙ্গে খুবই সামান্য ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন। এছাড়া পার্শ্ববর্তী জাতীয় সংসদের দিনাজপুর-৪ নির্বাচনী এলাকার চিরিরবন্দর উপজেলায় জামায়াত প্রার্থী আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ভাল ভোটের ব্যবধানে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। গত পৌরসভা নির্বাচনের সময় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ছোট্ট জেলা নড়াইলে গিয়েছিলাম। জেলাটি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে জেলাটিতে জামায়াতের কী ধরনের উত্থান সেটি রীতিমতো গবেষণার দাবি রাখে। তার প্রমাণ গত উপজেলা নির্বাচনে জেলার সদর উপজেলায় জামায়াতের প্রার্থী ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এটি হচ্ছে দেশের দুটি এলাকার চিত্র। যে চিত্রটি শিক্ষা-দীক্ষা, চিন্তা-চেতনায় অগ্রসর রাজধানী ঢাকায় বসে অনুমান করা মোটেই সম্ভব নয়। এই চিত্র যে দেশের বহু এলাকায় বিদ্যমান সেটিও প্রমাণিত। গত উপজেলা নির্বাচনে শতাধিক উপজেলায় জামায়াতের প্রার্থীরা উপজেলা চেয়ারম্যান এবং ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। সম্প্রতি ৬ ধাপে দেশব্যাপী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়েছে। এখানে জামায়াতের দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগ ছিল না। তাই তারা কতটি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছে তার পরিসংখ্যান বের করা কঠিন। তবে স্থানীয়রা এই বিষয়টি নিশ্চিত যে, কারা জামায়াত সমর্থিত। নির্বাচনী ফলাফলে আওয়ামী লীগ, বিএনপির বাইরে অন্যান্য বা স্বতন্ত্র অংশে যে ফল দেখানো হচ্ছে সেই অংশটির সংখ্যা এবার বেশ বড়। আমার ধারণা এই অংশটিতে জামায়াতপন্থীদের একটি বড় অংশ রয়েছে। তবে সচেতন মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তিকর মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রভাব বিস্তার করা মোটেই সম্ভব নয়Ñ জামায়াত-শিবির এই জিনিসটিও ভাল করে অনুধাবন করে বলেই লক্ষ্য হিসেবে তারা বেছে নিয়েছে গ্রামীণ সাধারণ অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী। তাদের মূল লক্ষ্যও গ্রামগঞ্জের সহজ-সরল মানুষগুলো। সরকার শীঘ্রই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার জন্য সংসদে আইন পাস করতে যাচ্ছে। এটি যেমন একটি বিরাট আশার কথা, তেমনি অনেক শঙ্কার কথাও আছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতের নেটওয়ার্ক কতটা বিস্তৃত সচেতন মহল মাত্রই জানেন। এটি পুরোপুরি একটি ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন। জামায়াতের সহযোগী সংগঠন ছাত্রশিবির স্কুল পর্যায় থেকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। তারা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে মূল জামায়াতে প্রবেশ করে। এটি একটি অভিনব ব্যবস্থা এবং নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়ে তারা বর্তমানেও তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। সত্যিকার অর্থে তারা তাদের লক্ষ্যে অনেকাংশেই সফল। জামায়াত-শিবির হয়ত এখন সেইভাবে সামনাসামনি কোন আন্দোলনে নেই; কিন্তু তারা তৃণমূলে তাদের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য অত্যন্ত গোপনে যেভাবে কাজ করছে তা ভাববার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সহজ-সরল ধর্মভীরু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ বাংলাদেশ। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মকে মাধ্যম করে কোন বিষয় উপস্থাপন করলে খুব সহজেই পক্ষে আনা সম্ভব হয়। আর জামায়াত সেই কাজটিই করে যাচ্ছে দিনের পর দিন। এক্ষেত্রে তারা সাম্প্রদায়িকতাও ছড়াচ্ছে। গত কয়েক বছর যাবত রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বেছে বেছে প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার মানুষ হত্যাযজ্ঞ চলছে। এক একটি হত্যাকা- হচ্ছে আর তথাকথিত আইএস, আল কায়েদার নামে হত্যার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয়া চলছে। আমি একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে মনে করি যে বিবৃতিগুলো দেয়া হচ্ছে এগুলো সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং ভিত্তিহীন। পৃথিবীর কোথাও অপরাধ করে অপরাধী দায় স্বীকার করে নেয় এমনটি আমার মনে হয় সচরাচর ঘটে না। হত্যাকা-ের মোটিভ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য এই গোষ্ঠীটি দায় স্বীকারের নাটক করছে। দেশ যখন উন্নয়নের মহাসড়ক দিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক সেই সময় দেশে একটি চরম অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানো তাদের পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। যেমনটি তারা ঘটিয়েছিল ১৯৭১ সালে। এ ব্যাপারে সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বিষয়গুলো তদন্ত করা অতি জরুরী। কারণ দেশের বিভিন্ন দফতরে বিপুলসংখ্যক জামায়াতের আদর্শধারী কর্মকর্তা কাজ করে যাচ্ছে। এই জামায়াতী আদর্শের কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করা একান্ত জরুরী। এদের কারণে জামায়াত নামের আগুনটি নিভে গেলেও আগুনের ফুলকি থেকে যেতে পারে এবং সেই ফুলকি থেকেই বড় ধরনের আগুন ধরতে পারে। আজ স্বাধীনতার পক্ষের অসাম্প্রদায়িক দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছে বলে আমরা মনে করছি হয়ত জামায়াত-শিবির শেষ হয়ে গিয়েছে। বিষয়টি মোটেই তেমনটি নয়। সুতরাং সর্তক হতে হবে সবাইকে। সাম্প্রদায়িক এই অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসীদের। [email protected]
×