ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ধূমপান ত্যাগ কি খুব কঠিন?

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ১২ জুন ২০১৬

ধূমপান ত্যাগ কি খুব কঠিন?

গত ৩১ অক্টোবর দৈনিক জনকণ্ঠ ও আরেকটি দৈনিকে লিখেছিলাম তামাক আণবিক বোমার চেয়েও ভয়ঙ্কর! ওই দিনটা ছিল ‘বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস’। এ ব্যাপারে বেশকিছু স্বনামধন্য ব্যক্তির কাছ থেকে আমি ধন্যবাদ পেয়েছি। একই সঙ্গে কেউ কেউ বলেছেন, পরবর্তী অংশে যেন লিখি কি করে তা ত্যাগ করা যায়? ধূমপান ত্যাগ করা নিয়ে অনেক রসালো গল্প আছে। এটা ত্যাগ করা কোন কঠিন ব্যাপার নয়। ইচ্ছে করলে যে কেউ যেমন ছাড়তে পারেন তেমনি অতি সহজেই পুনরায় শুরু করতে পারেন। পড়েছি, প্রখ্যাত লেখক হুমায়ূন আহমেদ নাকি ৬০/৭০ বার ধূমপান ত্যাগ করেছেন, আবার শুরু করেছেন। আসলে ছাড়েননি, হলে সিনেমা দেখার সময় যখন ক্ষণিকের বিরতি দেয়া হয়, এটা ছিল সে রকম। কথায় কথায় সমাজের অল্প সংখ্যক লোক স্বল্প দিনের দাম্পত্য জীবনের ইতি টানতে দ্বিধাবোধ করেন না, বরং বিবাহ-বিচ্ছেদকে সানন্দে গ্রহণ করেন। দুই পরিবার একে অপরকে দোষারোপ করেন, কেউ নিজের ঘাড়ে দোষ নেন না। একই পরিবারের ধূমপানে আসক্ত ছেলে বা মেয়েকে কিন্তু ধূমপান ত্যাগে সাহায্য করেন না। বিবাহ-বিচ্ছেদে পারিবারিক ইগো কাজ করে কিন্তু সিগারেটের বেলায় প্রতিজ্ঞাটা কেউ করাতে চান না। আসলে ধূমপান ত্যাগ প্রচ- ইচ্ছাশক্তির ব্যাপার। শক্ত এবং কঠিন ইচ্ছাশক্তি দিয়ে যেমন কাম, ক্রোধ ও লোভ নিবারণ করা যায় ঠিক তেমনি ধূমপান পরিহারও কঠিন কিছু নয়। হিন্দু ধর্ম গ্রন্থে বলা আছেÑ কাম, ক্রোধ ও লোভ এই তিনটি নরকের দ্বারস্বরূপ। এই তিনটি রিপুকে যদি নিয়ন্ত্রণ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়, তাহলে ধূমপান নিয়ন্ত্রণ করা মানবকুলের জন্য কেন কঠিন হবে? আসলে ধূমপানের দিকে মানুষ নেশাগ্রস্ত হয়ে ঝোঁকে না। শখের বসে বা বন্ধুসভায় দুষ্টুমি করে অথবা বন্ধু-বান্ধবীকে খুশি করতে বা সাহচর্য দিতে গিয়ে কিংবা হাল্কা যে কোন কারণে যুব সমাজ (অর্থাৎ টিনএজের) আকৃষ্ট হয়। এর শুরুতে তারা কিছু স্বল্পমেয়াদী উপকার পেয়ে থাকেন। সেই ঝযড়ৎঃ ঃবৎস নবহবভরঃ গুলো হলো-ঊধঃরহম নবঃঃবৎ! খড়ড়শরহম নবঃঃবৎ! ঋববষরহম নবঃঃবৎ! ঝসবষষরহম নবঃঃবৎ! যদি এই স্বল্পকালীন উপকারিতার সময়ে তা ত্যাগের চেষ্টা করা হয় এবং করলে তৎক্ষণিক যে উপকার পাওয়া যায় তা হলো : সার্বিক স্বাস্থ্য ভাল ও জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভূত হবে। নাকের ঘ্রাণ শক্তি বৃদ্ধি পাবে। জিহবার স্বাদের উন্নতি ঘটবে পেটে এ্যাসিডিটি কমবে। বন্ধু মহলে অধূমপায়ী ব্যক্তিরা দুর্গন্ধ পাবে না। দীর্ঘমেয়াদী উপকারিতার অংশ হিসেবে ধূমপান পরিত্যাগে সব ধরনের ধূমপানজনিত রোগ ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, সরিয়াসিস, বারজার্স ডিজিসসহ মারাত্মক কিছু রোগের ঝুঁকি কমে যাবে। বিশেষ করে খাদ্যনালীর ক্যান্সার কমে যায়। শ্বাসনালী বা কণ্ঠনালীর ক্যান্সারের হার কমে। ধূমপানের অবসানে চিকিৎসার ফলও ভাল পাওয়া যায়। যদি আপনি ধূমপায়ী হন, ধূমপান পরিত্যাগের ২০ মিনিটের মধ্যে : আপনার রক্তচাপ ও পালস রেট কমে যাবে ২ ঘণ্টার মধ্যে : ফুসফুসের নিকোটিন নির্গমন শেষ হয়ে যাবে ৮ ঘণ্টার মধ্যে : শরীরের বিষাক্ত কার্বন মনো অক্সাইড কমে যাবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে : হৃদরোগের ঝুঁকি কমে যাবে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে : নাকের ঘ্রাণ শক্তি বৃদ্ধি পাবে তিন মাসের মধ্যে : আপনার প্রজনন ক্ষমতা বাড়বে নয় মাসের মধ্যে : শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্লান্তি কমে যাবে। ৫-১৫ বছর ধূমপান বন্ধ থাকলে অধূমপায়ীদের মতোই আপনার হৃদরোগ, ক্যান্সার এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে যাবে। যারা ধূমপান করেন তাদের ২৫ থেকে ৩৩ শতাংশ ধূমপানের প্রতি আসক্তিতে আক্রান্ত হন। বলা হয়ে থাকেÑ হেরোইন, কোকেন, এ্যালকোহল বা গাঁজার চেয়ে বেশি আসক্তি সৃষ্টি করে তামাক। সপ্তম এ্যাডওয়ার্ড ধূমপানে এত বেশি আসক্ত ছিলেন এবং শ্বাস-প্রশ্বাস অর্থাৎ রেসপিরেটরি সিস্টেমের রোগে এতই বেশি আক্রান্ত ছিলেন যে, তাঁর স্ত্রী তাকে অনুরোধ করেছিলেন, সিগারেট ছেড়ে দেবার জন্য। জবাবে তিনি স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি কেন সিগারেট ছাড়ব? স্ত্রীর জবাব তুমি সিগারেটের প্রতি আসক্ত হয়ে গেছ। রাজার জবাব আমি তোমার প্রতিও একইভাবে আসক্ত, তাহলে কি তোমাকেও ছেড়ে দিতে হবে? সুস্বাস্থ্য রক্ষা, অর্থনৈতিক ধ্বংস বিবেচনায় আনা এবং পরিবারের অন্য সবার কথা বিবেচনায় আনলে ধূমপান পরিত্যাগ কোন কঠিন ব্যাপার নয়। সিগারেট বা ধূমপান বন্ধ করলে যে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যায় তার কয়েকটি হলোÑ মুড ডিপ্রেশান, ঘুম না হওয়া, বিরক্তি ভাব, মনোযোগহীনতা, খিদে বেড়ে যাওয়া। এ কয়েকটা জিনিস নিজেকে কর্মব্যস্ত রেখে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এসব উপসর্গ ক্ষণস্থায়ী যার স্থায়িত্বকাল ২ থেকে ৪ সপ্তাহ। সুতরাং একে দমন করা প্রবল ইচ্ছাশক্তিতেই সম্ভব। তারপরেও বারবার মনে করবেন, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলো ক্ষণস্থায়ী এবং স্বল্প সময়ের জন্য, যখন এই নেশার টান আসবে, তখনই ভাবতে হবে এটা কয়েক মিনিটের জন্য, আর ঐ সময়ের চুইংগাম, আদা বা দারুচিনি একটু মুখে রাখবেন, সব সময় কাজে ব্যস্ত থাকবেন অথবা গুরুজনদের সামনে থাকবেন। পুষ্টিকর খাবার খাবেন। পর্যাপ্ত ব্যায়াম করবেন, ইউগা বা অন্যান্য পদ্ধতিতে রিলাক্স করবেন। এমন কোন পরিবেশে যাবেন না যেখানে আপনি রেগে যেতে পারেন। নিয়মিত ঘুমোতে যাওয়া এবং ঘুম থেকে ওঠা আপনাকে এ ব্যাপারে যথাসম্ভব সহায়তা করবে। ওষুধ হিসেবে আপনি সহজেই ব্যবহার করতে পারেন নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি। যদিও ঘড় ভড়ৎস ড়ভ ঢ়যধৎসধপড়ঃযবৎধঢ়ু রং ধ ংঁনংঃরঃঁঃব ভড়ৎ সড়ঃরাধঃরড়হ. নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি এখন প্রায় ছয় ধরনের পাওয়া যায়- নিকোটিন চুইংগাম, নিকোটিন স্কিন পেচ, নিকোটিন লজেন্স, নিকোটিন ইনহেলার, জিহবার নিচে দেয়ার মতো নিকোটিন ট্যাবলেট এবং নিকোটিন নেজাল স্প্রে। মনে রাখবেন, এ সবের কিছু না কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে। আমার জীবনের প্রথম ও শেষবারের ধূমপানের গল্প শুনিয়ে শেষ করতে চাই। ১৯৬৬ সালের কথা। নবেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের শেষ শুক্রবার। ৮ম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষার জন্য গ্রামের স্কুল থেকে আমরা ৪ জন পরীক্ষা দিতে কুমিল্লায় যাই। সাধারণত পরীক্ষা হতো নবেম্বরের শেষ বুধ ও বৃহস্পতি। বাবা আমাকে এবং আমার বন্ধু মনোরঞ্জনকে বাঁদুরতলায় নিজেদের এক আত্মীয়ের বাসায় সোমবারে রেখে আসেন। কথা ছিল পরীক্ষা শেষে শুক্রবারে নিয়ে যাবেন। কুমিল্লা জিলাস্কুল, পরীক্ষা কেন্দ্র। ভয়ভীতির অন্ত নেই। আমার বয়স তখন ১৩-১৪ হবে। মনোরঞ্জন আমার চেয়ে বয়সে কিছু বড় ছিল। বৃহস্পতিবার পরীক্ষা শেষ। মনোরঞ্জন বলতে লাগল চল আমরা বাড়ি চলে যাই। আমি বললাম, বাবা বলেছেন একা না যেতে এবং কাল সকালে এসে নিয়ে যাবেন, তাই আমি যাব না। ওর পীড়াপীড়ি থেমে গেল। শুক্রবার সকালে ঘুম থেকে উঠেই বলল, তুই না যাস থাক, আমি চলে যাব। কুমিল্লার বাঁদুরতলা থেকে চান্দিনার মাধাইয়া বাসে যাব, এর জন্য কি বাবার অপেক্ষায় থাকতে হয়? ওর চাপে অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হয়ে গেলাম। বাদুরতলা থেকে রিক্সা নিয়ে শাসনগাছা যাচ্ছি, পথিমধ্যে মনোরঞ্জন রিক্সা থামিয়ে একটা পান দোকানির কাছ থেকে দুটো সিগারেট কিনে দড়ির আগুনে ধরিয়ে আনল। সে নিজে একটা খাচ্ছে আরেকটা আমাকে খাবার জন্য কত গুণাগুণের কথা বলতে লাগল। অবশেষে আমি নিজেও এটা হাতে নিয়ে টান দিতেই খুব কাশি হলো। সে আবার ছবক দিতে লাগল এভাবে-ঐভাবে। দুই বন্ধু শাসনগাছা অর্থাৎ বাসস্ট্যান্ডমুখী। বাসস্ট্যান্ডের কাছে নামতেই পেছনের একটা রিক্সা বাবাকে নিয়ে সামনে এসে গেল। অপরাধী হিসেবে আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারেন। বাবা বাসে উঠিয়ে দিয়ে ড্রাইভারকে সব বলে দিলেন, কোথায় নামাতে হবে এবং পরে আবার রিক্সায় উঠিয়ে দিতে। বাবা যে দেখেছে, এ ব্যাপারে আমার মন নিশ্চিত। ক্ষোভে এবং রাগে মনোরঞ্জনের সঙ্গে ঝগড়া চলছে। আশ্চর্য সে একেবারে নির্বিকার। মনে হলো আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে সে মহানন্দে। বাড়িতে ঢুকেই আমার রক্ষাকবচ ঠাকুর মা যাকে দাদুসহ সব ছেলেমেয়েরাই ভয় পেতেন, তাকে নিজের অপরাধের কথা খুলে বললাম। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন, ভয়ের কিছুই নেই, তোর বাবা শহর থেকে আসতে রাত ৯টা বেজে যাবে। তুই সন্ধ্যায় খেয়ে আমার বিছানায় ঘুমিয়ে থাকবি। যেমন আদেশ, তেমন কর্ম। কিন্তু ঘুম ত আসে না। বাবা রাত সাড়ে আটটার দিকে বাড়ি ফিরলেন। হাত মুখ ধুয়ে রান্না ঘরে খেতে গেলেন। সেখানে বসেই জিজ্ঞেস করলেন, আমি কোথায়? ঠাকুর মার জবাব ঘুমিয়ে গেছে। বাবা ডেকে দিতে বললেন। ঠাকুর মা কিছুতে রাজি না, উপরন্তু এক ধাপ এগিয়ে বললেন পরীক্ষা ভাল হয়েছে। সকালে কথা বলতে বললেন। বাবা আরও পীড়াপীড়ি শুরু করলেন। ঠাকুর মার স্পষ্ট জবাব, সে আমাকে বলেছে, আর একটা সিগারেট খেলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না। তার পরেও বাবা থামছিলেন না। তাই আমি ঘুম থেকে উঠে বাধ্য হয়ে রান্না ঘরে গেলাম। প্রথম প্রশ্ন : কতদিন ধরে সিগারেট খাচ্ছি? জবাব আজই প্রথম এবং শেষ। দ্বিতীয় প্রশ্নÑ কেন খেলাম? জবাবÑ মনোরঞ্জন জোর করে আমাকে খেতে বাধ্য করেছে। বাবা বললেনÑ সে কি জোর করে তোমার মুখে ঢুকিয়ে দিয়েছে? লা জবাব, চুপ করে রইলাম। ভবিষ্যতে খাবে না কি করে বুঝব? সঙ্গে সঙ্গেই ঠাকুর মার মাথায় হাত দিয়ে বললাম, শপথ করছি আর খাব না। আবারও প্রশ্ন শপথ ভঙ্গ করলে কি হবে? জবাবÑ ঠাকুর মা মরে যাবেন। তারপরে নাছোড় বান্দা বাবার মন্তব্য, তাহলে তুমি তোমার মায়ের মাথায় হাত দিয়ে শপথ কর। আর শপথ ভঙ্গ করলে তোমার মা মরবে। পিঠ বাঁচানোর জন্য তাই করলাম। কিন্তু চিন্তা হলো আমার শপথ ভঙ্গের জন্য আমার মা মরে গেলে বাবার কোন আপত্তি নেই। তবে তাঁর বৃদ্ধ মা মরতে পারবে না। শুধু এই এক শপথের পরে মনের শক্তি এত বেড়ে গিয়েছিল যে, আর কোনদিন কোন পরিস্থিতিতে তা স্পর্শ করিনি। লেখক : সাবেক ভিসি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×