ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

জঙ্গীদের ঔদ্ধত্য চ্যালেঞ্জের উপযুক্ত জবাব দিতে হবে

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ১২ জুন ২০১৬

জঙ্গীদের ঔদ্ধত্য চ্যালেঞ্জের উপযুক্ত জবাব দিতে হবে

গোলাম মোস্তফা রচিত বিশ্বনবী (সা) গ্রন্থ থেকে দুটি বড় উদ্ধৃতির প্রাসঙ্গিক অংশ উল্লেখপূর্বক আজকের লেখাটি শুরু করতে চাই। মক্কা বিজয়ের আগে মুতা অভিযানের প্রাক্কালে অভিযাত্রীদের সকলকে হযরত মুহাম্মদ (সা) উপদেশ দেন। তাতে তিনি বলেন, ‘সাবধান! কোন সাধু-সন্ন্যাসীকে, বালক-বালিকাকে বা স্ত্রীলোকদের বধ করিও না।’ (গোলাম মোস্তফা, বিশ্বনবী, পৃ. ৩০৮)। মক্কা বিজয়ের পর নবম হিজরীতে তাবুক অভিযানের এক পর্যায়ে নজরান প্রদেশের একদল খ্রিস্টান মদিনায় উপস্থিত হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে সেখানে বসবাসের আগ্রহ প্রকাশ করেন। মহানবী (সা) তাদেরকে বসবাসের অনুমতি দেন এবং ঘোষণা করেন- ‘নজরানের পাদ্রী, পুরোহিত ও সাধারণ নাগরিকদের প্রতি আল্লাহর নামে তাঁহার রসুল মুহম্মদ (সা) এই প্রতিজ্ঞা করিতেছে যে, সর্বপ্রকার সম্ভবপর চেষ্টা দ্বারা আমরা তাহাদিগকে নিরাপদ রাখিব, তাহাদের দেশ, তাহাদের জীবন ও ধনসম্পদ অক্ষুণœ থাকিবে, তাহাদের ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠান এবং অন্যান্য অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করা হইবে না, কোন ধর্মযাজক বা পুরোহিতকে পদচ্যুত করা হইবে না, কোন সন্ন্যাসীর সাধনায় ব্যাঘাত জন্মানো হইবে না’ (প্রাগুক্ত পৃ. ৩৩৩)। গত ৫ জুন রবিবার চট্টগ্রামে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে নিরীহ একজন গৃহিণীকে, তাঁর সাত বছরের সন্তানের সামনে। একই দিনে নাটোরের বনপাড়ায় একজন নিরীহ খ্রিস্টান দোকানদারকে হত্যা করা হয়েছে। প্রথমজন পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী, নাম মাহমুদা আক্তার মিতু এবং দ্বিতীয়জনের নাম সুনীল গোমেজ। লেখার শুরুতে বিশ্বনবী (সা) গ্রন্থ থেকে দুটি উদ্ধৃতির অংশ উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, আলোচ্য দুটি হত্যাকা-ের জন্য সঙ্গতকারণেই যাদেরকে প্রবলভাবে সন্দেহ করা হচ্ছে তারা পবিত্র ইসলাম ধর্মের নাম ব্যবহার করে একের পর এক এই ধরনের গুপ্তহত্যা, টার্গেটেড কিলিং চালাচ্ছে। এটা যে ইসলাম ধর্মের কত বড় অবমাননা এবং নবী (সা)-এর নির্দেশের লঙ্ঘন, উপরের দুটি উদ্ধৃতিই তার প্রমাণ বহন করে। এ যাবত যারা ব্যক্তিগতভাবে গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছেন তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড ও জীবন বৈশিষ্ট্যের দিকে তাকালে চারটি শ্রেণীগত চিত্র পাওয়া যায়। প্রথমত. ইসলাম ধর্মের আলেম ও পীর, ফকির, যারা উগ্রবাদিতা, ওয়াহাবিতন্ত্র ও ফেতনা ফ্যাসাদের বিরোধী এবং নিজেরা চিন্তা চেতনায় উদার, সহিষ্ণু ও শান্তিপ্রিয়। এই শ্রেণীতে পড়ে জঙ্গীদের হাতে নিহত হয়েছেন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, প্রখ্যাত ইসলামিক আলেম মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকী, পীর খিজির হায়াত খান, যাত্রাবাড়ীর কথিত পীর লুৎফর রহমান এবং চট্টগ্রামের কথিত ন্যাংটা ফকির। দ্বিতীয়ত. হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মের সাধারণ মানুষ, ধর্মযাজক ও গুরু যার সাম্প্রতিক শিকার নাটোরের বনপাড়ার সুনীল গোমেজ এবং ৭ জুনে হত্যার শিকার হওয়া ঝিনাইদহের হিন্দু পুরোহিত আনন্দ গোপাল। তৃতীয়ত. বাঙালী সংস্কৃতির লালন-পালনকারী এবং তার বিস্তৃতির জন্য কাজ করেন এমন সব মানুষ এবং যারা অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থার চিন্তক ও বুদ্ধিজীবী। এ শ্রেণীর সর্বশেষ শিকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দিকী। হুমকির মুখে রয়েছেন আরও অনেক বুদ্ধিজীবী, লেখক, কলামিস্ট ও সাংবাদিক। চতুর্থত. মুক্তচিন্তার কিছু ব্লগার, যাদের বিরুদ্ধে জঙ্গীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় এরা নাকি ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করেন। তবে অদম্য সাহসী, আইকন পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আকতারের স্ত্রীকে হত্যা করে জঙ্গীরা বোধহয় আরেকটি নতুন ফ্রন্ট ওপেন করলেন। নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন পুলিশের প্রতি। উল্লেখিত চার-পাঁচ শ্রেণীর বাইরে গত বছর দুই অচেনা, অজানা নিরীহ বিদেশীকে হত্যা করা হয়। একজন ইতালির সিজার তাভেলা, অন্যজন জাপানের নাগরিক হোশি কুনিও। এই দুই জনের হত্যার সঙ্গে জঙ্গী কানেকশন থাকলেও থাকতে পারে, তবে এর পেছনে মূলত নেপথ্যের ভূমিকায় গডফাদারের কাজ করেছে দেশী-বিদেশী রাজনৈতিক চক্রান্ত, যারা শেখ হাসিনার সরকারকে দ্রুত ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে চায় অথবা নিদেনপক্ষে চাপ প্রয়োগ করে নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়। সে সময়ে এই বিষয়ের ওপর কয়েকটি দৈনিকে একাধিকবার লিখেছি বিধায় আজকে আর সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করছি না। ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ও যুক্তরাষ্ট্রের সিআইয়ের নিজস্ব লোক রিতা কর্টেজ নামক এক ইহুদী দ্বারা পরিচালিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটা সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্স কর্তৃক আইএসের নিজস্ব অথবা সকলের কাছে পরিচিত কোন সূত্রের উল্লেখ না করে প্রতিটি গুপ্ত হত্যার পর অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে প্রচার করছে বাংলাদেশে এসব হত্যাকা- নাকি চালাচ্ছে সিরিয়া-ইরাকভিত্তিক আইএস সদস্যরা। এর থেকে মিথ্যাচার এবং নিম্নমানের ষড়যন্ত্র আর হতে পারে না। আল কায়েদার বর্তমান প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরি একটা বই লিখেছেন, যার নাম ‘দ্য নাইটস (শহরমযঃং) আন্ডার প্রোফেট ব্যানারস’। ওই বইয়ে আল কায়েদার মতে কারা তাদের শত্রু এবং শত্রুদের পরাজিত করার যুদ্ধ কৌশলের বর্ণনা রয়েছে। এই বইয়ের বর্ণনা অনুসারে এবং ২০১৪ সালে আইএস সৃষ্টি হওয়ার শুরু থেকে এ পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্বসহ অন্যান্য দেশে যত আক্রমণ চালিয়েছে সে সব টার্গেটে বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্টত প্রমাণ হয় যে, কেবল ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা ভিন্ন ধর্মের যাজক ও গুরু হওয়ার জন্য বা ভিন্ন মতাদর্শের জন্য কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ওপর একটি আক্রমণ ও হত্যাকা- আইএস চালায়নি। সিরিয়ায় প্রায় আড়াই কোটি জনসংখ্যার শতকরা দশভাগ খ্রিস্টান। সিরিয়ায় তো আইএসের সীমাহীন দৌরাত্ম্য ও ক্ষমতা রয়েছে। তারপরও কেবল খ্রিস্টান হওয়ার জন্য স্বতন্ত্রভাবে কারও ওপর একটি আক্রমণও আইএস চালায়নি, যা বাংলাদেশের জঙ্গীরা করছে। সুতরাং আইএস নয়, বাংলাদেশের জঙ্গীরা সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে দুটি কারণে। প্রথমত. ভারত ও পশ্চিমা বিশ্বের কাছে তারা প্রমাণ করতে চায় এ সরকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। যাতে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের চাপে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিরাজমান অন্যরকম উষ্ণ সম্পর্কের চিড় ধরে, যা এখন জামায়াত-বিএনপির অন্যতম একটি লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাদানে ব্যর্থ হওয়ার অজুহাতে পশ্চিমা বিশ্বের চাপে সরকার নরম হলে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দ- রহিত হবে এবং জামায়াত অস্তিত্বের সঙ্কট কাটিয়ে আবার শ্বাস নেয়ার সুযোগ পাবে। দ্বিতীয়ত. সরাসরি জামায়াতের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথকে সুগম করা। অর্থাৎ সংখ্যালঘুরা ভীত হয়ে দেশ ছেড়ে গেলে বাংলাদেশ একটা মনোলিথিক রাষ্ট্র হবে এবং আবার ২০০১-২০০৬ মেয়াদের মতো ক্ষমতায় যেতে পারলে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো ইসলামিক রাষ্ট্র ঘোষণার পথ সুগম হবে। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জঙ্গীদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক শক্তি ক্ষমতায় থাকার কারণে তারা অবাধে যে রকম বড় বড় জঙ্গী তৎপরতা চালাতে পেরেছে, ২০০৯ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত সেই স্কেল ও মাত্রায় একটি ঘটনাও তারা ঘটাতে পারেনি। সেটি করতে পারলে এতদিনে বাংলাদেশ আরেকটি পাকিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া বা আফগানিস্তানের মতো হয়ে যেত। কোন কোন আন্তর্জাতিক চক্র এটাই চায় তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাফল্য এখানে। কিন্তু ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেলা হত্যার মধ্য দিয়ে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে আসে। শুরু হয় অভাবনীয় গুপ্তহত্যা, টার্গেটেড কিলিং। টার্গেট হিসেবে বেছে নেয়া হয় এমন সব মানুষ ও স্থানকে যা সকলের কল্পনার বাইরে। অলি-গলি, গ্রাম-গঞ্জে সাধারণ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে বেছে নেয়া হয়, যাকে নিরাপত্তার ভাষায় বলা হয় সফ্্ট টার্গেট। এ সমস্ত গুপ্তহত্যা বন্ধে পুলিশের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। মানুষ পুলিশের বিরুদ্ধে সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে। অনেক সময় আমাদের কাছেও মনে হয়েছে তাহলে পুলিশ কি দিশেহারা হয়ে গেল। প্রশ্ন ওঠে জঙ্গীদের কৌশলের কাছে পুলিশের গোয়েন্দারা কি হেরে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে পুলিশের এক অদম্য সাহসী অফিসার বাবুল আকতার হয়ে ওঠেন জঙ্গীদের আতঙ্ক। নিজের কর্তব্য পালনে সততা ও দায়িত্বকে ব্রত মেনে জঙ্গী দমনে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখান পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আকতার। তারই নির্মম, বর্বর ও নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নিয়েছে জঙ্গীরা বাবুল আকতারের স্ত্রীকে হত্যার মাধ্যমে। সরাসরি হুমকির কথা জানা থাকা সত্ত্বেও বাবুল আকতারের মতো একজন নিবেদিতপ্রাণ অফিসারের পরিবারকে চট্টগ্রাম পুলিশ নিরাপত্তা প্রদানে কেন ব্যর্থ হলো, এই কথাটি আজ মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শর্ষের ভেতরে থাকা ভূতের কারসাজির কথা আবার সামনে এসেছে। তবে একজন নিরস্ত্র, নিরীহ নারীকে একলা রাস্তায় পেয়ে হত্যা করা চরম কাপুরুষোচিত কাজ। সমস্ত মানবতা, সভ্যতা ও ধর্মের বাণীকে তারা বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছে। রাষ্ট্রের প্রতি ঔদ্ধত্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। তাই এহেন জঙ্গীদের প্রতি মানবতার দায় দেখাবার কোন কারণ থাকতে পারে না। রাষ্ট্রকে অত্যন্ত কঠোর ও নিষ্ঠুর হতে হবে। রাষ্ট্রের পুলিশ জঙ্গীদের এই ঔদ্ধত্য বর্বর চ্যালেঞ্জের উপযুক্ত জবাব দেবে- এটাই মানুষ দেখতে চায়। লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
×