ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়া নগরীর এ্যাডওয়ার্ড পার্ক

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ১১ জুন ২০১৬

বগুড়া নগরীর এ্যাডওয়ার্ড পার্ক

সমুদ্র হক ॥ বগুড়ার ঐতিহ্যের এ্যাডওয়ার্ড পার্ক নগর জীবনের সুস্থ বিনোদনের পীঠস্থানে পরিণত হয়েছে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত পার্কে পরিবার বন্ধু-বান্ধবসহ বেড়ানো যায়। শিশুদেরও বিনোদনের দোলনাসহ নানা কিছুর ব্যবস্থা করা আছে। উত্তর ধারে উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তন ও দক্ষিণে সুপরিসর শহীদ টিটু মিলনায়তন। দুই মিলনায়তনের মধ্যে উন্মুক্ত ওস্তাদ আলাউদ্দিন মঞ্চ ও রোমেনা আফাজ মঞ্চ সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। তারপরও কিছু কথা থেকেই যায়। বগুড়া শহরের সূত্রাপুর মৌজায় গোহাইল সড়কের ধারে ৯ দশমিক ৬৬ একর (প্রায় ২৯ বিঘা) জমির ওপর এই পার্কের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৯০৫ সালে। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের বগুড়ার কালেক্টর কুমার রাম কৃষ্ণ শিল্পী নাট্যমোদী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে পার্কটি স্থাপন করেন। এর আগে ১৮৫৪ সালে শতাধিক পাম ট্রি ও ফুলের বাগানের এক কোনায় স্থাপিত হয় উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি। সেই হিসাবে পার্কটি দেড়শ’ বছরেরও বেশি সময় আগে প্রতিষ্ঠিত। আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু গত শতকের প্রথমে। ওই সময়ে ব্রিটিশ সম্রাজ্যের সম্রাট সপ্তম এ্যাডওয়ার্ডের নামে পার্কটির নামকরণ হয় এ্যাডওয়ার্ড পার্ক। রাজ পোশাকে এ্যাডওয়ার্ডের পাথরের মূর্তি আজও রয়েছে এই পার্কে। যার সামনে দাঁড়িয়ে পর্যটকসহ অনেকেই ছবি তোলে স্মৃতির স্মারকে। পার্ক স্থাপনের পরই সেই সময়ের জমিদারররা নিজের নামে কিছু স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। ১৯০৬ সালে কাজলার জমিদার বাবু বেনী মাধব চাকী, আনন্দ চন্দ্র সেন প্রেমানন্দ সেন ও নিত্যনন্দন সেন পার্কে একটি সরোবর বানিয়ে দেন। যার নাম দেয়া হয় ‘আনন্দ সরোবার’। উদ্বোধন করেন তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট জেএন গুপ্ত। সানবাঁধা সিড়ির প্রবেশ পথেই লিখা আছে ‘ফর দ্য ইউজ এ্যান্ড বেনিফিট অব দ্য পাবলিক’। আজও এই সরোবরে কাপড় কাঁচা নিষেধ। এর কাছেই আদমদীঘির জমিদার বাবু সতীশ চন্দ্র নিয়োগী স্থাপন করেন হংস ফোয়ারা। বছর দশেক আগেও ছিল এই ফোয়ারা। বর্তমানে এই ফোয়রাকে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে এই ফোয়ারা জলের অবারিত ধারা তৈরি করে। সরোবরের এক ধারে গড়ে তোলা হয়েছে কৃত্রিম পাহাড়। চার ধারে এঁকে বেঁকে ওপরে ওঠার এই পাহাড় এতটাই দৃষ্টিনন্দন যে ওপরে উঠে গোটা পার্ক দেখা যায়। পাহাড়ের চূড়ায় বসবারও ব্যবস্থা আছে। ওঠার সময় মনে হবে কোন গুহার মধ্য দিয়ে উঠতে হচ্ছে। কৃত্রিম পাহাড়ের কিছুটা দূরেই বগুড়ার সৃষ্টিশীল শিল্পী আমিনুল করিম দুলালের (প্রয়াত) তৈরি লাইভ সাইজের কৃত্রিম চিড়িয়াখানা স্থাপিত হয়েছে। কৃত্রিম এই জীবজন্তুগুলো ছিল নবাববাড়ি সড়কের ধারে দুলালের সৃষ্টি কারুপল্লীতে। নবাব পরিবারের সদস্যরা তাদের ভূমিতে স্থাপিত কারুপল্লী বিক্রি করে দিলে বগুড়ার পৌরসভার মেয়র মাহবুবুর রহমান দুলালের সৃষ্টিগুলোকে এ্যাডওয়ার্ড পার্কে এনে সেড রেখে দেন। পার্কে যারা বেড়াতে আসে তারা হাতি ঘোড়া জিরাফ বাঘ বানার কুমিড় ডইনোসারসহ নানা শিল্পকর্মগুলো দেখে আনন্দ পায়। প্রবীণ ও মধ্যবয়সীদের মনে নাড়া দেয় শিল্পী দুলাল। কৃত্রিম চিড়িয়াখানা স্থাপিত হয়েছে আম্রকুঞ্জের ভিতরে। পার্কের বড় এলাকাজুড়ে আছে আমের বাগান। দর্শনার্থীরা পার্কে নিরবচ্ছিন্ন ঘুরতে পারে এক ধারে আমের বাগান ও সরোবরের ধারে ফুলের বাগানে। ঝাউ লতাপাতার গাছ গাাছালি দিয়ে এই বাগানের গেট এমনভাবে বানানো হয়েছে মনে হবে কোন এক স্বর্গীয় উদ্যানে প্রবেশ করা হচ্ছে। বাগানের ভেতরের সরু পথের দুই ধারে সবুজ বেষ্টনীতে ছেয়ে দেয়া হয়েছে। পার্কের ভেতরে কয়েকটি স্থানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু পাম ট্রিগুলো। একটি পাম ট্রি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মর্টার শেলের আঘাত এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে। যা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জাগিয়ে তোলে। এই পার্কে প্রতিদিনই আসে কয়েকশ’ নরনারী শিশু। বয়স্করা সকালে ও সন্ধ্যায় হাঁটার জন্য যায় পার্কে। বিশেষ করে ডায়বেটিস রোগীদের হাঁটা নিত্যদিনের। এক সুন্দর এই পার্কে সন্ধ্যার পর থাকে প্রায় অন্ধকার। পর্যাপ্ত বাতি নেই। অন্ধকারে রাতের পার্ক পরিণত হয় মাদকসেবীদের আখড়ায়। সন্ধ্যার পর পার্কে যেতে সাহস পায় না অনেকে। ছিনতাইকারীরাও ওৎ পেতে থাকে। অপরাধীদের এই অংশটুকু বাদ দিলে পার্কটি এই অঞ্চলের দিনের নিসর্গে পরিণত হয়ে আছে। রাতের পার্ক বোধ হয় সাধারণের জন্য নয়।
×