ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কল্পনা চাকমা নিখোঁজের রহস্য দুই দশকেও উন্মোচিত হলো না

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১১ জুন ২০১৬

কল্পনা চাকমা নিখোঁজের রহস্য দুই দশকেও উন্মোচিত হলো না

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ গত দুই দশক ধরে হিল উইমেন ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনাটি রহস্যাবৃতই রইল। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাই উপজেলার নিউ লাইল্লাঘোনার নিজ গ্রামের বাড়ি থেকে কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়েছেন বলে চাউর হয়ে আছে। কল্পনার নিখোঁজ ঘটনা নিয়ে তার সমর্থকরা বলছেন, এটি অপহরণ। অন্যপক্ষ বলছেন, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এটি একটি সাজানো নাটক। তিনি কৌশলে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে গিয়ে অবস্থান নিয়েছেন এবং এখনও সেখানে থেকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন বলে গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন সূত্রের কাছে তথ্য রয়েছে। কল্পনা চাকমা ১৯৯৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম হিল উইমেন ফেডারেশনের (এইচডব্লিউএফ) সাংগঠনিক সম্পাদিকার দায়িত্বে ছিলেন। অন্যদিকে, তার প্রেমিক ও পরবর্তীতে স্বামী অরুণ বিকাশ চাকমা ভারতের অরুণাচল প্রদেশের ভারতীয় যুব কংগ্রেসের রাজনৈতিক কর্মকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে তথ্য রয়েছে। কল্পনা ও অরুণের প্রেমে পারিবারিক বাধা ছিল। যে কারণে কল্পনা চাকমা দেশত্যাগ করেন অতি গোপনে এবং এ ঘটনাটি অত্যন্ত কৌশলে কাজে লাগায় তৎকালীন শান্তি বাহিনী ও পিসিপি’র সদস্যরা। শান্তি চুক্তির পর লুপ্ত তৎকালীন শান্তি বাহিনী ১৯৯৬ এর সংসদ নির্বাচনে রাঙ্গামাটি জেলায় নিজস্ব প্রার্থী হিসেবে তাদের অঙ্গ সংগঠন পাহাড়ী গণপরিষদের কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য বিজয় কেতন চাকমাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায়। তার পক্ষে প্রচার চালানোর জন্য পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), পাহাড়ী গণপরিষদ (পিজিপি) ও হিল উইমেন ফেডারেশন (এইচডব্লিউএফ) কে নির্দেশনা প্রদান করা হয়। অপরদিকে, রাঙ্গামাটিতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী দীপঙ্কর তালুকদারের পক্ষে নাগরিক কমিটিসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ উপজাতীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও বাঙালী জনগোষ্ঠী সমর্থন দেয় এবং প্রচারে নামে। তৎকালীন শান্তি বাহিনীর সমর্থক পিসিপি, পিজিপি ও এইচডব্লিউএফ নির্বাচনে তাদের প্রার্থীর জয়লাভে শঙ্কিত হয়ে উপজাতীয়দের হুমকি ও হয়রানি শুরু করে। পরিসংখ্যানে বেরিয়ে এসেছে, এরা গোটা পার্বত্য অঞ্চলে ৩৫ আওয়ামী লীগ সমর্থককে ঐ নির্বাচনের আগে ও পরে অপহরণ করে। এদিকে, কল্পনা চাকমা এইচডব্লিউএফ-এর নেত্রী হয়েও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে প্রচার কাজ চালাচ্ছিলেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে উপদলীয় কোন্দলের সৃষ্টি হয় এবং তাকে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে প্রচার কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য হুমকি দেয়া হয়। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিপক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে কল্পনা চাকমাকে অপহরণের নাটক সাজায় শান্তি বাহিনী ও পিসিপি। ভোটের পূর্ব রাতে তাৎক্ষণিক একটি ইস্যু তৈরি করে নির্বাচনী জনপথকে তাদের পক্ষে নিতে প্রচার চালায় যে, ভোট কেন্দ্রগুলোর প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসাররা ভোট শুরু হওয়ার পর বেশকিছু সময় ভোটার পাননি। ফলে বিলম্বে ভোট গ্রহণ শুরু হয়েছিল। কল্পনা চাকমা অপহরণ হয়েছে বলে ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার তদন্তে তার বাড়িতে তার পরিধেয় বস্ত্র, বই পুস্তক ও নিত্য ব্যবহার্য কোন সামগ্রী খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্বাভাবিকভাবে ওই সময় প্রশ্ন ওঠে- তিনি কি অপহৃত হয়েছেন, নাকি স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে একটি ইস্যু তৈরির চেষ্টা চালিয়েছেন। এ পর্যন্ত পরিচালিত কোন তদন্তেই কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়েছেন এমন কোন আলামত পাওয়া যায়নি। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে এ অপহরণের যে অভিযোগ তারও কোন প্রমাণ মেলেনি। ঘটনার পর সেই ১৯৯৬ সালের ১৭ জুন পাহাড়ী গণপরিষদ, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন ফেডারেশন জেলা প্রশাসকের কাছে একটি স্মারকলিপি প্রদান করে। কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়েছেন বলে তৎকালীন উগলছড়ি ক্যাম্পের সেনাক্যাম্প কমান্ডারকে দায়ী করা হয়। স্মারকলিপিতে বলা ছিল, নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য উগলছড়ি আর্মি ক্যাম্প থেকে নিউ লাইল্লাঘোনায় এসে কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করে। ওই সময় ওই কর্মকর্তা নির্বাচনী ডিউটিতে এসেছিলেন। উল্লেখ্য, ওই অফিসার শান্তি বাহিনী বা পিসিপির অবৈধ কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সাফল্যজনক কয়েকটি অপারেশন পরিচালনা করেন। ঘটনার কিছুদিন পূর্বে বাঘাইছড়ি ইউপি চেয়ারম্যানের বাড়িতে অবৈধ চাঁদা আদায়কারীদের অবস্থানের খবর পেয়ে ওই কর্মকর্তা তল্লাশি অভিযান চালান। তাঁর নেতৃত্বে অপারেশনে পিসিপির কয়েক চাঁদাবাজ হাতেনাতে গ্রেফতার হয়। ওই কর্মকর্তার অপারেশনে দিশেহারা হয়ে শান্তিবাহিনী ও পিসিপি তার পেট্রোলের উপর বেশক’বার এ্যামবুশ করে। ভাগ্যক্রমে তিনি এবং তার সঙ্গে থাকা সদস্যরা বেঁচে যান। কোন অবস্থাতেই শান্তিবাহিনী ও পিসিপিই সেনা সদস্যদের কর্মকা-ের সঙ্গে পেরে উঠতে না পারায় তাদের ঘায়েল করার জন্য ভিন্নপথ খুঁজে নেয়ার অভিযোগ উঠে। তারা মিথ্যা অভিযোগ ও অপপ্রচারের ফাঁদ ফাদে। ওই সময়ের বিভিন্ন সংবাদপত্রে এ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য উপাত্ত প্রকাশিত হয়। এদিকে সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, কল্পনা চাকমা বেশ কয়েকবার দেশে ফেরার চেষ্টা করলেও পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের হুমকির কারণে আসতে পারছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। সূত্র জানায়, পার্বত্য অঞ্চলে নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা পরিবার পরিজন ব্যতিরেকে দুর্গম এলাকার ক্যাম্পে মৃত্যুঝুঁকি ও নানাবিধ প্রতিকূলতার মধ্যে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। দীর্ঘ তিন যুগেরও বেশি সময় পার্বত্য অঞ্চলে নিয়োজিত থাকাকালে নিরাপত্তা বাহিনী নারী অপহরণ ঘটনার সঙ্গে জড়ায়নি। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা কঠোর আইনশৃঙ্খলার মধ্যে পরিচালিত হয় সেক্ষেত্রে এ ধরনের কোন সুযোগ থাকে না। সূত্র মতে, যে কুচক্রী মহল দেশের অখ-তা ও সার্বভৌমত্ব চায় না, পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি বিরাজ করুক চায় না, ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে যারা ফায়দা লুটছে তারা এদেশের বিরুদ্ধে, নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের অপচেষ্টা চালায়। বিতর্কিত করার অপচেষ্টা চালায় নানাবিধ অপপ্রচার চালিয়ে। সূত্র মতে, আগামী ১২ জুন কল্পনা চাকমার কথিত অপহরণ ঘটনা নিয়ে এখন থেকে শুরু হয়েছে পুরনো অপপ্রচারের নাটক। যার ফলাফল বরাবরই রয়েছে শূন্যের কোঠায়। কারণ, তিনি অপহরণ হয়েছেন এমন কোন তথ্য উপাত্ত গত দুই দশকেও যেমন উদঘাটিত হয়নি, তেমনি তিনি ভারতের ত্রিপুরায় যে অবস্থান করছেন এবং পরিবারের সঙ্গে যে যোগাযোগ রক্ষা করছেন তার যথেষ্ট তথ্য উপাত্ত তদন্ত সংস্থা পুলিশসহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছে রয়েছে।
×