ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এসপি পত্মী মিতু হত্যাকাণ্ড

ক্লু উদ্ঘাটনে পুলিশ ব্যর্থ, সন্দেহের তীর হাটহাজারীর দিকে

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১১ জুন ২০১৬

ক্লু উদ্ঘাটনে পুলিশ ব্যর্থ, সন্দেহের তীর হাটহাজারীর দিকে

মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী হত্যা ঘটনার একসপ্তাহ পার হলেও আজ পর্যন্ত অপরাধীদের গ্রেফতারে পুলিশ এখনও সঠিক কোন ক্লু পায়নি। এ পর্যন্ত যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তাদের বেশিরভাগই হাটহাজারীকেন্দ্রিক। তাই পুলিশের সন্দেহের তীরটা অনেকটা হাটহাজারীর দিকে। কারণ, এসপি বাবুল আক্তার দীর্ঘ প্রায় তিন বছর হাটহাজারী, ফটিকছড়ি ও রাউজান উপজেলার সাবেক এএসপি হিসেবে অপরাধ দমনে সক্রিয় ছিলেন। এসব অপরাধের মধ্যে ছিল হত্যা, রাহাজানি, ছিনতাইসহ জঙ্গী দমনের নানা অভিযান। এদিকে, অন্ধকারেই রয়ে গেছে অন্য তদন্ত সংস্থারগুলোর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের সফলতা। তবে চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকা-ের কুলকিনারা হচ্ছে না সিএমপিতে চৌকস কর্মকর্তার অভাবে। কিন্তু সিএমপিতে কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তাদের একটাই মন্তব্যÑএকমাত্র চৌকস কর্মকর্তা যিনি এসপি বাবুল আক্তার তিনিই এখন দুর্বৃত্তের কৌশলের কাছে ধরাশায়ী হয়েছেন। শুক্রবার বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে মিতু হত্যার বিচার চেয়ে মানববন্ধন করেছে কয়েকটি সংগঠন। মানববন্ধন চলাকালে এক রিক্সাচালককে সন্দেহজনক আচরণের কারণে গ্রেফতার করেছে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। তার নাম মোঃ ইব্রাহিম (২২)। তার বাড়ি টাঙ্গাইল জেলায়। পেশায় সে রিক্সাচালক হলেও তার সঙ্গে থাকা ব্যাগ থেকে দুটি ছোরা উদ্ধার করেছে পুলিশ। তবে জঙ্গী সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কিনা বিষয়টি যাচাইবাছাই করে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে। এ ছাড়াও রিক্সাচালকবেশে যাত্রী থেকে নগদ অর্থ বা মূল্যবান জিনিস লুটে নেয়ার জন্য ধারালো ছোরা রাখা হয়েছে কিনা সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কোতোয়ালি থানার ওসি। অথচ, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের মতো আবাসিক এলাকায় নিজ গৃহে মা-মেয়ে খুনের হত্যার রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে এক বাকপ্রতিবন্ধীর তথ্যের উৎস ধরে বাবুল আক্তার খুনীকে শনাক্ত করেছেন স্বল্প সময়ে। কিন্তু বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুর মোবাইল সেটটি এখন পর্যন্ত উদ্ধার করতে পারেনি তদন্ত সংস্থাগুলো। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, হত্যাকা-ে জড়িতদের শনাক্ত করতে কত কালক্ষেপণ হতে পারে। এদিকে, এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রীর মোবাইলে সর্বশেষ কললিস্ট অনুযায়ী নগরীর শুলকবহরের বাদুরতলা থেকে যে কলটি হয়েছিল তা এখন টার্গেট পুলিশের। তবে গোয়েন্দা বিভাগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কৌশলে চেষ্টা করা হচ্ছে ক্লু উদঘাটনের। গত ৫ জুন হত্যাকা-ের পর থেকে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত মহানগর গোয়েন্দা বিভাগসহ ঘটনার ক্লু উদঘাটনের সঙ্গে কাজ করছে একাধিক দফতর। কিন্তু শত চেষ্টা করেও একটি হত্যাকা-ের ক্লু উদঘাটন করতে না পারায় নির্ভরশীল বিভাগগুলোর ব্যর্থতার বিষয়টি উঠে এসেছে সচেতন নাগরিক সমাজের কাছে। গোয়েন্দা পুলিশ সন্দেহের তীর ছুড়ে চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকা-ের ক্লু উদঘাটনের চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে পুলিশ মোবাইলের কললিস্ট, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাস, হত্যাকা-ের পর এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রীর মোবাইলটির অপরপ্রান্তের ব্যক্তিকেও খুঁজে বের করার বিষয়ে তদন্ত প্রক্রিয়া চালু রেখেছে বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু ক্লু উদঘাটনে তেমন কোন অগ্রগতি নেই। তবে ক্লু উদঘাটন অতটা সহজ না হলেও সিএমপির পক্ষ থেকে বা বিভিন্ন বিভাগের পক্ষ থেকে যেভাবে তদন্ত করা হচ্ছে তা সঠিক প্রক্রিয়ায় হচ্ছে কিনা তাও প্রশ্নবিদ্ধ। সন্দেহজনক অনেককেই এ পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও গ্রেফতার দেখানো হয়েছে মাত্র একজনকে। তাও আবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে গ্রেফতারকৃত আসামি আবু নসর গুন্নুর পরিবার ও মুসাবিয়া দরবারের একপক্ষের গত বৃহস্পতিবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলনের কারণে। যদিও পুলিশ মিতু হত্যাকা-ের সঙ্গে আবুকে সংশ্লিষ্ট থাকার বিষয়টি প্রমাণ পেয়েছে বলে দাবি করে চট্টগ্রাম আদালতে দশ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেছে। কিন্তু তাৎক্ষণিক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে কোন তথ্যপ্রমাণ দিতে না পারায় আদালতে রিমান্ড আবেদনের শুনানি হয়নি। এদিকে, কাল রবিবার এ আবেদনের ওপর শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে আরও ৪ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গোয়েন্দা দফতরে আনা হলেও তাদের কাছ থেকে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না বলে পুলিশের একটি সূত্রে জানা গেছে। পুলিশের ধারণা, গ্রেফতারকৃত আবুকে রিমান্ডে আনা হলে এ হত্যাকা-ের ক্লু উদঘাটনে অনেক বেশি তথ্য পাওয়া যাবে। এ ব্যাপারে সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার দেবদাস ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, প্রত্যেকটি উৎসকে ক্লু উদঘাটনে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। কোনভাবেই যেন উগ্রগোষ্ঠী অপরাধীরা পার না পায় সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। আবু নসর গুন্নু শিবিরের সাবেক সক্রিয় কর্মী এমনকি তার বিরুদ্ধে সীতাকু- থানায় অপহরণের মামলাও রয়েছে। এছাড়া কললিস্ট অনুযায়ী ঘটনাস্থলে তার উপস্থিতির বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। মোটরসাইকেলের তিন দুর্বৃত্ত ছাড়াও আরও অনেক অপরাধী ছিল সেখানে। সিএমপি সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ জুন সকালে এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী হত্যা ঘটনার পর পাঁচলাইশ থানা পুলিশ ওই রাতেই শুলকবহরের বাদুরতলার বড় গ্যারেজ এলাকা থেকে ঘটনায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি উদ্ধার করে। হেলমেটসহ পরিত্যক্ত অবস্থায় মোটরসাইকেলটি পড়ে থাকার কারণে এমনকি ওই এলাকায় কেউ দীর্ঘ প্রায় আঠারো ঘণ্টা সময়ের মধ্যে মালিকানা দাবি না করায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পুলিশ মোটরসাইকেলটি গোয়েন্দা দফতরে নিয়ে আসে। এই মোটরসাইকেলের মালিকানা নিশ্চিত করতে গিয়ে বিআরটিএ থেকে নিবন্ধনের সকল কাগজপত্র জব্ধ করা হয়। পরবর্তীতে দেখা যায়, মোটরসাইকেলটি আরও ৫ বছর আগে বিক্রি করা হয়েছে। সর্বশেষ মালিকানায় বোয়ালখালীর শহিদউল্লাহ বাবুর্চির। তার বাড়ি থেকে গত মে মাসের ৮ তারিখ মোটরসাইকেলটি চুরি হয়ে যায়। এ ব্যাপারে বোয়ালখালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও রয়েছে। শহিদউল্লাহকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কিন্তু চুরির পর সর্বশেষ ব্যবহারকারীর কোন তথ্যই খুঁজে পায়নি। এরপর গোয়েন্দা বিভাগ মিরসরাই থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৪ জনকে নিয়ে আসে গোয়েন্দা দফতরে। প্রথম দফায় জিজ্ঞাসাবাদের পর কোন ধরনের তথ্য পাওয়া যায়নি তাদের কাছ থেকে। কিন্তু প্রয়োজনে আবারও ডাকা হতে পারে বলে তাদের বলা হয়েছে। এ বিষয়ে সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) দেবদাস ভট্টাচার্য প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে কোন ধরনের আটক বা গ্রেফতার নেই বলে নিশ্চিত করেছেন গত মঙ্গলবার। এরপর গ্রেফতার করা হয়েছিল হাটহাজারীর পশ্চিম ফরহাদাবাদ এলাকার মুসাবিয়া দরবার শরীফ থেকে আবু নসর গুন্নুকে। পুলিশের মোবাইল ট্র্যাকিং অনুযায়ী আবু নসরের ঘটনার সময় ওই এলাকায় অপরাধীদের সঙ্গে যোগসাজশের বিষয়টি উঠে আসে। সে অনুযায়ী পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়েছে প্রায় ২৪ ঘণ্টা। বুধবার প্রেস ব্রিফিংয়ে সিএমপির পক্ষ থেকে গুন্নুকে গ্রেফতার ও সংশ্লিষ্টতা থাকার বিষয়টি জানানো হয়। অপরদিকে, বুধবার সকালে ভাটিয়ারির সিলিমপুর এলাকা থেকে আটক করা হয় ভিডিও ফুটেজে দৃশ্যমান কালো রঙের মাইক্রোবাসের চালক জানে আলমকে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর বেরিয়ে এসেছে হত্যাকা-ের বর্ণনা। তবে তার কাছে কোন ধারণকৃত বা স্থিরচিত্র নেই। অপরাধী ধরা পড়ার পর তাকে দিয়েই নিশ্চিত করার বিষয়টি অপেক্ষমাণ রয়েছে পুলিশের কাছে। এদিকে, আবুল খায়ের গ্রুপের অফিস স্টাফদের পরিবহনের গাড়ির চালক ছিল এই জানে আলম। এমনকি মাইক্রোবাসটিও তার মালিকানায় রয়েছে। ভাড়ায় ওই প্রতিষ্ঠানের স্টাফদের বহন করার বিষয়টি পুলিশকে নিশ্চিত করেছে সে। বৃহস্পতিবার দুপুরে এই হত্যাকা-ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার অপরাধে ও পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসা গ্রেফতার আসামি আবু নসর গুন্নুকে আদালতে প্রেরণ করা হলে তথ্য-উপাত্তের অভাবে রিমান্ড শুনানি হয়নি। তাকে জেলহাজতে প্রেরণের মধ্য দিয়ে কাল রবিবার রিমান্ড শুনানির কথা রয়েছে তেমনি পরিবারের পক্ষ থেকেও জামিন আবেদন করা হতে পারে। এদিকে, বৃহস্পতিবার বিকেলে নগরীর মেহেদীবাগ এলাকা থেকে একজনসহ মোট চারজনকে নতুন করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। শুক্রবার এ বিষয়ে কোন ধরনের প্রেসব্রিফিং হয়নি সিএমপির মিডিয়া সেলে।
×