ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনারের ঘটনাস্থল পরিদর্শন

পাবনায় অনুকুল ঠাকুর আশ্রমের সেবায়েতকে কুপিয়ে হত্যা

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১১ জুন ২০১৬

পাবনায় অনুকুল ঠাকুর আশ্রমের সেবায়েতকে কুপিয়ে হত্যা

নিজস্ব সংবাদদাতা, পাবনা, ১০ জুন ॥ এবার টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হলেন হেমায়েতপুর ঠাকুর অনুকুল চন্দ্র সৎসঙ্গ আশ্রমের সেবায়েত নিত্যরঞ্জন পাণ্ডে (৬৫)। শুক্রবার ভোর সাড়ে পাঁচটায় প্রাতঃভ্রমণরত অবস্থায় তাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নিহত নিত্যরঞ্জন পা-ে গোপালগঞ্জ জেলার সদর থানার আড়োয়াকংসু গ্রামের বাসিন্দা। তিনি দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে ঠাকুর অনুকুল চন্দ্র সৎসঙ্গ আশ্রমের সেবায়েতের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও ঘাতকদের গ্রেফতার দাবিতে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ ও পূজা উদযাপন পরিষদ ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছে। অন্যথায় দেশব্যাপী কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। আশ্রম কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ধর্মপ্রচারক প্রতিদিনের মতো শুক্রবার ভোরে প্রাতঃভ্রমণে বের হন। তিনি পাবনা মেন্টাল হসপিটালের ১নং গেটের কাছে এলে দুর্বৃত্তরা তার ঘাড়ে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায়। আশ্রমের সেবক হরিপদ মজুমদার প্রাতঃভ্রমণে বের হয়ে মানসিক হাসপাতালের ১ নম্বর গেটের সামনে তার মৃতদেহ দেখতে পান। পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে পাবনা সদর থানায় নিয়ে আসে। ধর্মপ্রচারক হত্যাকা-ের খবর ছড়িয়ে পড়লে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ, পূজা উদযাপন পরিষদ, জেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ পাবনা সদর থানায় ভিড় জমায়। দুপুরে খবর পেয়ে ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার অভিজিত চট্টোপাধ্যায় সৎসঙ্গ আশ্রম পরিদর্শন করেন। এদিকে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রেজাউল রহিম লাল সকালে থানায় এসে ধর্মপ্রচারকের লাশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় জানান, দেশকে অস্থিতিশীল করতে বিএনপি-জামায়াত টার্গেট কিলিংয়ের পথ বেছে নিয়েছে। তিনি ঘাতকদের দ্রুত আটকের দাবি জানান। ময়নাতদন্ত শেষে ধর্মপ্রচারকের লাশ নিয়ে দুপুরে শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল মুক্তমঞ্চে এক প্রতিবাদ সমাবেশ করে। প্রতিবাদ সমাবেশে নেতৃবৃন্দ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঘাতকদের গ্রেফতার দাবিতে আল্টিমেটাম দেন। পুলিশ ঘাতকদের গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হলে দেশব্যাপী কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে বলেও জানানো হয়। এ সময় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ পাবনার সাধারণ সম্পাদক বিনয় জ্যোতি কু-ু, পূজা উদযাপন পরিষদ পাবনার যুগ্মসাধারণ সম্পাদক বাদল চন্দ্র ঘোষ, সদর উপজেলা সভাপতি প্রভাস চন্দ্র ভদ্র, সাধারণ সম্পাদক কমল কৃষ্ণ দাস, পৌর সভাপতি বলাই চন্দ্র সাহা, সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর সরকার, সৎসঙ্গ আশ্রমের সাধারণ সম্পাদক যুগল কিশোর ঘোষ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। প্রতিবাদ সভা শেষে নিহত সেবায়েতের লাশ হেমায়েতপুর সৎসঙ্গ আশ্রমে নেয়া হলে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। এ সময় আশ্রমের শতাধিক সদস্য সদালাপী নিরীহ সেবায়েতের লাশ ঘিরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এরপর তার আত্মার শান্তি কামনায় বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। প্রার্থনা শেষে তার লাশ গোপালগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়। নিহত নিত্যরঞ্জন পা-ে ২ ছেলে ১ মেয়ের জনক। তার বড় ছেলে নন্দ দুলাল পা-ে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। সৎসঙ্গ আশ্রমের সাধারণ সম্পাদক যুগল কিশোর ঘোষ বাদী হয়ে সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। পাবনার পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম এ নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সকালে দু’দফা বৈঠক করেন। ঘাতকদের আটকে পুলিশী অভিযান চলছে বলে পুলিশ জানায়। অনুকুল ঠাকুর আশ্রমের সেবায়েত হত্যায় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি পাবনার সভাপতি ডাঃ ইলিয়াস ইফতেখার রসুল ও সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম রাজা গভীর শোক ও নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, দেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারায় তাকে হত্যা করা হয়েছে। সৎসঙ্গ আশ্রমে ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার ॥ ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় শুক্রবার দুপুরে সৎসঙ্গ আশ্রমে এসে নিহত নিত্যরঞ্জন পা-ের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি নিহত নিত্যরঞ্জন পা-ের শাশুড়ি ও নাতিকে সমবেদনা জানান। তিনি যে কোন প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। প্রায় ২০ মিনিট অবস্থানকালে তিনি সাংবাদিকদের কোন প্রশ্নের জবাব দেননি। ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনারের সঙ্গে এ সময় ছিলেন ভারতীয় হাইকমিশন রাজশাহীর এডুকেশন ও ভিসা কর্মকর্তা মৃত্যুঞ্জয় কুমার সিং। ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার আশ্রম ত্যাগের পরপরই র‌্যাব-১২ সিও এডিশনাল ডিআইজি মোঃ শাহাবুদ্দিন খান ঘটনাস্থল ও আশ্রম পরিদর্শনে এসে কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন। গোপালগঞ্জের বাড়িতে শোকের ছায়া ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা গোপালগঞ্জ থেকে জানান, জেলার আড়ুয়া কংশুর গ্রামের পা-ে বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। শুক্রবার সকালে পাবনার অনুকুল চন্দ্র সেবাশ্রমের সেবক নিত্যরঞ্জন পা-ে (৬০) হত্যাকা-ের খবর এসে পৌঁছলে তার গ্রামের বাড়িতে নেমে আসে শোকের ছায়া। স্বজনদের আহাজারিতে ক্রমান্বয়েই পা-েবাড়ির বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। ওই বাড়িতে স্বজনদের সমবেদনা জানাতে সকাল থেকেই এলাকার মানুষের ভিড় জমে। চারদিকে ওঠে নিন্দার ঝড়। স্বজনরা জানান, গত সপ্তাহে শেষবারের মতো আড়ুয়া কংশুর গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন অনুকুল ঠাকুরের একনিষ্ঠ ভক্ত নিত্যরঞ্জন পা-ে। এ সময় গোপালগঞ্জ শহরের বেদগ্রাম এলাকায় বড় মেয়ে নন্দিতা বাগচীর (৩২) ভাড়াবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন তিনি। ওই সময় বাবার সঙ্গে একান্তে কথা হয় নন্দিতার। কুষ্টিয়া সরকারী কলেজে এমএ শেষপর্বে অধ্যয়নরত একমাত্র ছোট বোন স্বন্দিপা পা-ের বিয়ের ব্যাপারে কথার একপর্য়ায়ে বড় মেয়ে নন্দিতা তার বাবাকে বলেছিলেন, ‘বাবা তোমার বয়স হয়েছে, কখন মরে যাবে, আগে তুমি স্বন্দিপার বিয়ে নিয়ে চিন্তা কর।’ তার উত্তরে বাবা বলেছিলেন, ‘আমি তাড়াতাড়ি মরবো নারে- মাগো, তোরা কোন চিন্তা করিস না। দেখিস, স্বন্দিপার একটা ভাল বিয়ে হবে।’ কথাগুলো বলতে বলতে অঝোরে কাঁদছিলেন নন্দিতা। বিলাপ করে বলছিলেন, আমার বাবাতো অনেক দিন বাঁচলেন না। কিন্তু এমনভাবে তাকে চলে যেতে হবে আমি তা কখনও ভাবিনি। গোপালগঞ্জের বাবরগাতী সরকারী প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক নন্দ দুলাল পা-ে প্রশ্ন রেখে বলেন, আমার বাবার কী অপরাধ ছিল? তিনি একজন ধর্মপ্রচারক। ধর্মের কাজে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ৪০ বছরের অধিক সময় ধরে তিনি পাবনার হেমায়েতপুরে ঠাকুর অনুকুল চন্দ্রের সেবাশ্রমে সেবক হিসেবে কাজ করছেন। সেখানে তাকে (বাবা) সহঃপ্রতি ঋত্ত্বিক উপাধি দেয়া হয়েছিল। আমার বাবাতো কোন অপরাধ করেননি? এলাকার সকলে বাবাকে খুব সম্মানের চোখে দেখতেন। আমি আমার বাবার নৃশংস হত্যার বিচার চাই। এ সময় সরকারপ্রধানের কাছে তার বাবার হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানান। স্বামীর শোকে মূহ্যমান দুলু হাজরা (৫৫) এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না যে, এমন নৃশংসভাবে কোন মানুষ তার স্বামীকে প্রকাশ্যে দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করতে পারে। তার স্বামী ডায়াবেটিসের রোগী ছিলেন। প্রতিদিন খুব ভোরে তিনি হাঁটতে বের হতেন। স্বামীই ছিলেন তার সংসারের একমাত্র অবলম্বন। এখন তাকে কে দেখবে? অবিবাহিত মেয়েটির কী হবে? তিনি তার স্বামীর হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে বলেন, আর কত নৃশংসতা দেখবো! প্রতিদিনই এ ধরনের হত্যাকা- ঘটছে। এসব দেখার কি কেউ নেই। আড়ুয়া কংশুর গ্রামের মনোজ বিশ্বাস (৬৫) বলেন, নিত্যরঞ্জন তার ছোটবেলার বন্ধু। অতি নিরীহ মানুষ ছিলেন তিনি। ৫-৬ মাস পর গ্রামে আসতেন। সকলের সঙ্গে ভাল ভাল ব্যবহার করতেন। তাকে এভাবে অকালে চলে যেতে হবে তা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। সংখ্যালঘুদের ওপর টার্গেট করে প্রতিদিন হত্যা করা হচ্ছে। এসব কারা করছে-সরকার তাদের ধরছে না কেন? এমন অবস্থা চলতে থাকলে আমরা কোথায় যাব। কে দেবে আমাদের নিরাপত্তা। গ্রামের বাড়ি আড়ুয়া কংশুর গ্রামের পাণ্ডে বাড়িতে নিত্যরঞ্জনকে সমাহিত করা হবে। পারিবারিকভাবে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানান নিহতের একমাত্র ছেলে নন্দ দুলাল পা-ে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত লাশ এখনও এসে পৌঁছায়নি। লাশ এসে পৌঁছলে তাকে সমাহিত করার কাজ সম্পন্ন করা হবে।
×