ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জিডি করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হতে হয় ভুক্তভোগীকে;###;জিডি করলেও সমস্যার কোন সমাধানই মেলে না;###;অনেকক্ষেত্রে সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ দিতে হয়

ডিএমপিতে গড়ে দৈনিক ২ হাজার জিডি- নামেই আইনী পদক্ষেপ

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১১ জুন ২০১৬

ডিএমপিতে গড়ে দৈনিক ২ হাজার জিডি- নামেই আইনী পদক্ষেপ

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ পাঁচ বছর পাঁচ মাসেও স্বামী রাজধানীর নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী সুলতান হাওলাদারের কোন সন্ধান পাননি বিউটি আক্তার। নিখোঁজের জিডির তদন্ত দূরের কথা খোঁজও নেয়নি পুলিশ। অন্যদিকে আট বছর চার মাসেও রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের পূর্ব রসূলপুরের ৭ নম্বর গলির ভাড়াটিয়া সাজেদা আক্তার সাজুর একমাত্র মেয়ে শাহিদা আক্তার লিমার সন্ধান মিলেনি। সে সময় স্থানীয় মোহাম্মদিয়া কিন্ডারগার্টেনের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী ছিল লিমা (৭)। তারও জিডির তদন্তে আজও পর্যন্ত খোঁজ নেয়নি পুলিশ। এরকম শত শত জিডির একই হাল। উল্টো পুলিশের ধমক গিলতে হয় ভুক্তভোগীদের। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অধীন ৪৯টি থানায় প্রতিদিন প্রতিটিতে কমপক্ষে ৪০টি করে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) লেখা হয়। প্রতিদিন এত সাধারণ ডায়েরি হলেও এর অধিকাংশই থেকে যায় ফাইলবন্দী। গুরুত্ব অনুসারে জিডির কোন ক্যাটালগও নেই ডিএমপি কিংবা পুলিশ সদর দফতরে। শুধু তাই নয়, কোন কোন জিডির দ্রুত গতিতে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করে নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন সে সম্পর্কেও নেই সুস্পষ্ট কোন নির্দেশনা। ডিএমপির বিভিন্ন থানা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। ডিএমপি ও পুলিশ সদর দফতর বলছে, শুধু রাজধানীর থানাগুলোতে বছরে ৫ লক্ষাধিক জিডি লেখা হয়। হাজার হাজার মামলা তদন্তের জন্যই যেখানে পর্যাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা নেই সেখানে সব জিডির তদন্ত করা অসম্ভব। রাজধানীতে পুলিশের ৪৯টি থানায় গড়ে ৪০টি করে জিডি দায়ের করেন ভুক্তভোগীরা। এর ভেতর হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে- এমন অভিযোগ থাকে অন্তত তিনটি। মাস শেষে একটি থানায় জিডির সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪শ’র ওপরে। হত্যার হুমকির জিডি হয় ৯০টি। সে হিসেবে ৪৯টি থানায় প্রতিমাসে প্রায় চার হাজার হত্যার হুমকিতে জিডি দায়ের হয়। আইন বিশেষজ্ঞরা জানান, থানার জেনারেল ডায়েরি (জিডি) নামেই আইনগত পদক্ষেপ। বাস্তবে অর্থহীন আনুষ্ঠানিকতা। কখনও কখনও উল্টো হয়রানি এবং সন্ত্রাসীদের টার্গেটে পরিণত হওয়া। জিডি করার কারণে খুনের ঘটনাও ঘটছে। নিরাপত্তার পরিবর্তে দেখা দিচ্ছে প্রাণনাশের আশঙ্কা। রাজধানীর ৪৯টি থানায় প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার জিডি নথিভুক্ত হয়। এসব জিডির প্রেক্ষিতে যথাযথ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া দূরের কথা পুলিশ একে অর্থ আদায়ের হাতিয়ার হিসাবেই ব্যবহার করছে। অনেক ক্ষেত্রে দুই পক্ষের কাছ থেকেই হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থ। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, জবাবদিহিতা না থাকায় বাস্তবে এটি শুধু কাগুজে আইনে পরিণত হয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞরা জানান, আমাদের মতো দেশগুলোতে পুলিশের প্রতি আস্থা এমনিতেই নাগরিকদের কম। তা সত্ত্বে¡ও আইনগত বাধ্যবাধকতা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে মানুষকে থানার আশ্রয় নিতে হয়। কোন ভুক্তিভোগী থানায় জিডি করতে গেলে তাকে প্রথমে পুলিশের ধমক সহ্য করতে হবে। ধমকের অর্থ হচ্ছে তাকে মানসিক ভাবে দুর্বল করে দিয়ে অর্থ আদায়ের পথ পরিষ্কার করে নেয়া। অর্থ আদায়ের পর জিডি নথিভুক্ত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এখানেই শেষ। কোন কোন বিশেষ ক্ষেত্রে তদন্তে যায় পুলিশ। তখন বাদী-বিবাদী দুই জনকেই ধমক-ধামক দিয়ে দুর্বল করে অর্থ আদায় করা হয়। অতঃপর তদন্তের ফল শূন্য। জিডি করতে গিয়ে অনেকে আবার সন্ত্রাসীদের টার্গেটে পরিণত হয়। যথাযথ পুলিশী নিরাপত্তার পরিবর্তে সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হয়ে প্রাণ পর্যন্ত যায় অনেকের। থানায় জিডি করে সম্প্রতি সন্ত্রাসীদের খুনের শিকার হয়েছে শিক্ষক, ধর্মযাজক, ব্লগারসহ দশ বিশিষ্টজন। আবার অনেকে জিডি করে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। অনেকে প্রাণের ভয়ে দেশ ছেড়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভিআইপি কেউ থানায় জিডি করলে পুলিশ সেগুলোর কিছুটা খোঁজ-খবর নেয়। তাদের নিরাপত্তারও ব্যবস্থা নেয়া হয়। সাধারণ নাগরিকরা জিডি করলে পুলিশ একটি জিডি নম্বর দিয়েই নিজের দায়িত্ব শেষ করে। জিডির পর তদবির না করলে সেই জিডির খোঁজ-খবর কেউ নেয় না। থানায় জিডি পড়ে থাকে মাসের পর মাস। এসব কারণে সাধারণ মানুষ হুমকিতে পড়লেও থানা পুলিশের কাছে যেতে চান না। অনেক সময় তারা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আপোস-মীমাংসা করতে বাধ্য হন। এসব কারণে পুলিশের প্রতি মানুষের এখন আর সামান্যতম আস্থাও নেই। জবাবদিহিতা না থাকায় পুলিশের এই দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতা বড় ধরনের খেসারতের ক্ষেত্রই শুধু তৈরি করবে। থানায় দায়েরকৃত সাধারণত হত্যার হুমকি, চাঁদাবাজির হুমকি, শ্লীনতাহানি, ছিনতাই, ল্যাপটপ চুরি, মোটরসাইকেল চুরিসহ সব ধরনের যানবাহন হারানো ইত্যাদি অভিযোগে জিডি করা হয়ে থাকে। তবে অধিকাংশ জিডি দায়েরকারীর অভিযোগ- জিডির ব্যাপারে পুলিশের তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না। হত্যার হুমকির কারণে জিডি করলেও নিরাপত্তা দেয়া কিংবা বিষয়টি খতিয়ে দেখার ক্ষেত্রে পুলিশের রয়েছে গাফিলতি। তদন্ত কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও বাদীর অভিযোগ শুনতে মোটেই আগ্রহ দেখান না। এ ব্যাপারে আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা চেয়ে প্রথম আইনী ধাপটিই হলো জিডি। আর সেই জিডির তদন্ত করতে যদি পুলিশ গড়িমসি করে তাহলে নতুন অপরাধ সংগঠনের ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। ভুক্তভোগীরা জানান, অধিকাংশ জিডির ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করে থানা পুলিশ। কিন্তু অনেক সময়ই বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ও ছোট-বড় যানবাহন হারানোর পর থানায় জিডি করা হলেও পুলিশের পক্ষ থেকে জিডি দায়েরকারী ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হয় না। জানা গেছে, আট বছর চার মাসেও রাজধানীর সাজেদা আক্তার সাজুর একমাত্র মেয়ে শাহিদা আক্তার লিমার সন্ধান মিলেনি। ২০০৮ সালে লিমাকে নিয়ে তার মা সাজেদা কামরাঙ্গীরচরের পূর্ব রসূলপুরের ৭ নম্বর গলির সোনা মিয়ার বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। লিমা তখন স্থানীয় মোহাম্মদিয়া কিন্ডারগার্টেনের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী ছিল। ২৯ জানুযারি সাত বছরের লিমা নিখোঁজ হয়। ঘটনার দুদিন পর ২০০৮ সালের ৩১ জানুয়ারি রাতে নিখোঁজের মা সাজুু থানায় জিডি (নম্বর ১৩৭৫) করেন। এখন পর্যন্ত জিডির তদন্তে পুলিশ আসেনি। লিমা কোথায় আছে, কেমন আছে, তাকে কি গুম করা হয়েছে। নাকি অন্য কোথায় আছে। তা কেউ জানে না। মা সাজু মেয়ে লিমার জন্য সাড়ে ৮ বছর ধরে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন। কখন মেয়ে ফিরে আসে। সাজু কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, মেয়ে তার কাছে থাকলে এখন এসএসসি পরীক্ষা দিত। এখনও তিনি লালবাগ ভাট্ট মসজিদ এলাকায় থাকেন। গার্মেন্টসে কাজ করে কোন রকমে তার সংসার চলে। একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে মা সাজু এখনও পাগলপ্রায়। এদিকে ২০১১ সালের ৮ ডিসেম্বর রাত ৯টায় নিউমার্কেট এ্যালিফ্যান্ট রোড উড়োজাহাজ মসজিদ সংলগ্ন চায়ের দোকান থেকে ব্যবসায়ী সুলতান হাওলাদারকে (৪০) সাদা পোশাকে র‌্যাব পরিচয়ে সশস্ত্র ৮জন একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। পরের দিন নিউমার্কেট থানায় জিডি করেন ব্যবসায়ীর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বিউটি (যার নম্বর ৬৬৩)। পাঁচ বছর পাঁচ মাসেও জিডির তদন্ত দূরের কথা কেউ খোঁজও করেনি। নিঁেখাজের ছয় মাস পর বিউটি কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে মেয়ে সন্তান। তার নাম রাখা হয়েছে তাকসি। তাকসির বয়স এখন ৫ বছর। এখন বুঝতে শিখেছে। এখন সে মায়ের কাছে তার বাবা কোথায় জানতে চায়। কবে তার বাবা ফিরে আসবে। সন্তান এমন কথা বললেও বিউটি ঠিকই বুঝতে পাররেছন তার স্বামী সুলতান বেঁেচ নেই। সেদিন র‌্যাব পরিচয়ে ৮জন তার স্বামী সুলতানকে তুলে নিয়ে গুম করে দিয়েছে। সন্তানটি আরও বড় হলে তার বাবার করুণ পরিণতির কথা জানতে পারবে। বিউটি আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, আমার স্বামী সুলতানের বিরুদ্ধে কোন মামলা নেই। কেন তাকে র‌্যাব পরিচয়ে কয়েকজন তুলে নিয়ে গেল। এর কোন উত্তর আজও খুঁজে পাননি। স্বামী নিখোঁজের পর বড় কষ্টে সংসার চলছে। অনেক ধারদেনা করে স্বামী নিখোঁজ হওয়ার দুই বছর পর ২০১৩ সালে বড় মেয়ে সুজানা সুলতানার বিয়ে দেয়া হয়েছে। লালবাগ ভাট্ট মসজিদ এলাকার ২০৯/৩/ আই নম্বর কাউছারের বাড়িতে ভাড়া থাকেন। সেলাই মেশিন চালিয়ে কোন রকম সংসার চলে। ২৬ জানুয়ারি রাত ১১টায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে রাজধানীর এ্যাপোলো হাসপাতালের পাশের একটি বাসা থেকে রামপুরা থানার ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এস এম মোয়াজ্জেম হোসেন তপুকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরের দিন তপুর মা সালেহা বেগম থানায় জিডি করেন। পাঁচ মাসেও তিনি ছেলের তপুর খোঁজ পাননি। জিডির তদন্ত হয়নি। গত ১ ফেব্রুয়ারি ভাটারা থানায় একটি মামলা করেন। এতে আসামি করা হয় ইমন, তাজুল, শিবলু, তানিম, রইস উদ্দিন রইস, অর্নব, জুয়েল ও নিশি নামে আটজনকে। এ নিয়ে চার দফা সংবাদ সম্মেলন করে সালেহা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, ছেলেহারা বেদনা যে কত বেদনাদায়ক তা একজন মা-ই বলতে পারেন। সাত মাসেও রাজধানী বনানীর বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় এআইইউবির ইলেকট্রিক্যাল এ্যান্ড ইলেকট্রনিক বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র আসিফ ইমরানের (১৯) খোঁজ মেলেনি। গত বছরের ৭ অক্টোবর উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের বাসা থেকে আসিফ ইমরানকে বন্ধু গোলাম মোস্তফা আদর পূর্বপরিকল্পিতভাবে বেড়ানোর কথা বলে নারায়ণগঞ্জে নিয়ে যান। নিখোঁজ হওয়ার দু’দিন পর ৯ অক্টোবর আসিফের বড় বোন নাজিয়া কাজল উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। জিডি তদন্ত দূরের কথা থানার অপহরণের মামলা করতে গেলে উত্তরা পশ্চিম থানা প্রথমে মামলা নেয়নি। পরে আদালতের নির্দেশে ১ নবেম্বর ওই থানা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আলমগীর ইসলামসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা নেয়। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে জমি জালিয়াতি হোতাদের দাপটে অসহায় সেখানকার বাসিন্দারা। শাসকদলীয় নেতা ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা জাল দলিলের মাধ্যমে জোরপূর্বক প্রায় অর্ধশতাধিক নিরীহ লোকজনের বসতবাড়ি দখল করে নেয়। এ নিয়ে ভুক্তভোগীরা থানায় জিডি করেছেন। জিডির তদন্ত দূরের কথা উল্টো এসব ভূমিদস্যু পুলিশ দিয়ে অভিযোগকারীদেরই হয়রানি করছে। আর এই থানা এলাকায় জিডি করতে গেলে গুনতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। এর আগে ২০১২ সালের ৩০ জুলাই কামরাঙ্গীরচর থানায় জিডি করতে আসা দুই ব্যক্তির কাছ থেকে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ আসে থানার ওয়ারলেস অপারেটর কনস্টেবল মোঃ আরিফ হোসেনের (বেতার কং নং ২০৫৪০) বিরুদ্ধে। অভিযোগের সত্যতা পেয়ে তখনকার লালবাগ বিভাগের ডিসির নির্দেশে তাকে ক্লোজ করা হয়। তবুও থেমে নেই কামরাঙ্গীরচর থানার জিডি করতে আসা সাধারণ মানুষের ভোগান্তি। এরকম প্রতিটি থানায় প্রতিদিন শত শত জিডির একই পরিণতি হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ২০১৩ সাল থেকে বেড়ে যায় হত্যার হুমকির ঘটনা। ২০১৫ সালে কয়েক মাসে হত্যার হুমকি দেয়া হয় অর্ধশতাধিক বিশিষ্ট নাগরিককে। আবার অনেক হুমকি ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানা এলাকায় জিডি করতে গিয়ে কতিপয় কর্মকর্তার বিদ্রƒপের শিকারও হয়েছেন। জিডি করার পরই খুন হয়েছে যারা ॥ ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়। খুন হওয়ার আগে গত বছর ১৫ মে বেলা ১১টা ২৬ মিনিটে তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি (সাধারণ ডাইরি) করতে গেলেও তা নেয়নি পুলিশ। নিলয়ের স্ট্যাটাস থেকেই জানা গেল, জিডি করতে গেলে পুলিশ বলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশ ছেড়ে চলে যান। ৯ মাসে যে পাঁচ ব্লগার খুন হয়েছেন তাদের সবাই জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে জিডি করেছিলেন। কিন্তু জিডি তাদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী আশামনি দাবি করেন, পুলিশ খুনীদের ধরতেও পারে না, আবার নিরাপত্তা চাইলে নিরাপত্তাও দিতে পারে না। এমন পুলিশ রেখে লাভ কী? তিনি জানান, গত ১৫ মে খিলগাঁও থানায় ও পরদিন শাহজাহানপুর থানায় নিরাপত্তা চেয়ে জিডি করতে গেলে জিডি নেয়নি পুলিশ। জিডি নেয়ার পর যদি তদন্ত হতো তাহলে স্বামীকে মরতে হতো না। নীলাদ্রির স্ত্রী আশামনি জানান, তাকে হত্যা করা হতে পারে এটা নিলয় আগে থেকে আশঙ্কা করেছিলেন। তাকে হত্যার তিন মাস আগে সেই বছর ১৫ মে বেলা ১১টা ২৬ মিনিটে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এ নিয়ে একটি পোস্ট দেন। এতে লেখা ছিল, ‘আমাকে দুজন অনুসরণ করেছে গত পরশু। অনন্ত বিজয় দাশ হত্যার প্রতিবাদে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে যোগদান শেষে আমার গন্তব্যে আসার পথে এই অনুসরণটা করা হয়। এরপর সেই যুবক ক্রমাগত অনুসরণ করে। এতে সন্দেহ হলে এই ঘটনায় জিডি করতে গিয়ে আরও উদ্ভট পরিস্থিতির সম্মুখীন হই। প্রথমেই এক পুলিশ অফিসার ব্যক্তিগতভাবে জানিয়েছিল যে, এই ধরনের জিডি পুলিশ নিতে চায় না। কারণ ব্যক্তির নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যাপারে যে কর্মকর্তা জিডি গ্রহণ করবে তার এ্যাকাউন্টিবিলিটি থাকবে সেই ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। আর যদি ওই ব্যক্তির কোন সমস্যা হয়, সেইক্ষেত্রে ওই পুলিশ কর্মকর্তার দায়িত্বে অবহেলার জন্য চাকরি পর্যন্ত চলে যেতে পারে। থানায় জিডি করতে ঘুরেও একই চিত্র দেখলাম, অনুসরণকালে অনেক থানা অতিক্রম করার জন্য গতকাল ঘটনাস্থলের আওতায় থাকা একটি থানায় গেলে তারা জিডি নিল না, তারা বলল, আমাদের থানার অধীনে না, এটা অমুক থানার অধীনে পড়েছে, ওখানে যেয়ে যোগাযোগ করুন, আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশ ছেড়ে চলে যান। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত একে একে একই কায়দায় খুন করা হয় ১২ ব্লগারকে। ২০১৩ সালে ৭ জন, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ৫ জন। এছাড়া ২০১৩ সালে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করা হয়েছে ৪ জনকে। ২০১৫ সালে ৪ জনকে। ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপন নৃশংসভাবে খুন হন। এর আধাঘণ্টা আগে লালমাটিয়ার সি ব্লকের ৮/১৩ নম্বর চারতলায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে কবি তারেক রহিম, শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী আহমেদুর রশীদ টুটুল ও লেখক-গবেষক রণদীপম বসুকে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে ও গুলি করে আহত করে। আহত টুটুলের স্ত্রী শামীম রুনা সাংবাদিকদের বলেন, হুমকি-ধমকির কারণে ওই বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদপুর থানায় একটি জিডি করা হয়। কিন্তু নিরাপত্তা পাননি। সে কারণেই হামলার শিকার হয়েছেন তিনি (টুটুল)। শামীমা রুনা জানান, ২০১৪ সালে ফেসবুক স্ট্যাটাসে ও থানায় জিডি করে নিজের জীবননাশের হুমকি-ধমকির কথা জানিয়েছিলেন তার স্বামী টুটুল। কিন্তু নিরাপত্তা পাননি বলে অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে টুটুল ভাই জিডি করেও নিরাপত্তা পাননি। ২০১৫ সালের ২৮ আগস্ট জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে মোহাম্মদপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন শাম্মী হক (২৩) নামে এক নারী ব্লগার। খুন হওয়া কিংবা আহত হওয়া সব ব্লগারই জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে থানায় জিডি করেছিলেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য। বরং জিডি করলে পুলিশী হয়রানির পাশাপাশি উল্টো নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে জীবন। প্রাণনাশের শঙ্কা নিয়ে ফেরারি হয়ে ঘুরছেন এমন কয়েকজন লেখক ও ব্লগার এসব তথ্য জানান। তাদের দাবি, জিডি করলে যা, না করলেও তা। বরং জিডি করলে জীবন আরও বেশি নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করলেও দোষীদের আইনের আওতায় আনতে পারছে না পুলিশ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জিডির তদন্তে কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলেই যান না। ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল মধ্যরাতে রাজধানীর বাড্ডায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা বিভাগের সাবেক পরিচালক নজরুল হককে বাড্ডার পূর্বাচল সড়কের বাসায় কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এর প্রায় তিন মাস আগে তিনি হত্যার হুমকির ঘটনায় জিডি করেছিলেন বলে জানান তাঁর মেয়ে ফারহানা হক লোপা। তাঁর অভিযোগ, পুলিশ তাঁর বাবার নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের অবহেলাতেই এই হত্যাকা- ঘটেছে। একই থানায় মাত্র চার মাস আগে নিরাপত্তা চেয়ে জিডি করার ছয় দিনের মাথায় খুন হন বালু ব্যবসায়ী মামুন হোসেন। ২০১০ সালে সবচাইতে আলোচিত হত্যাকা-টি ঘটেছে গুলশানে। ব্যবসায়ী সাদেকুর রহমান ও তার স্ত্রী রোমেনা নার্গিসকে বাসায় ঢুকে নৃশংসভাবে খুন করে স্থানীয় সন্ত্রাসী ও বখাটে যুবক রুবেল। বেশ কিছু দিন ধরেই রুবেল সাদেকুরের স্কুলপড়ুয়া মেয়ে ইতিকে বিয়ের জন্য চাপ দিয়ে আসছিল। বিয়ে না দিলে তাদের হত্যা করা হবে বলে হুমকি দেয় সে। হুমকি দেয়ার পর সাদেকুর গুলশান থানায় জিডি করেছিলেন। জিডির খবর শুনে রুবেল ক্ষিপ্ত হয়। এরপর থেকে রুবেল তার মেয়ে ইতিকে আরও উত্ত্যক্ত করতে থাকে। সে নানাভাবে চাপ দিতে থাকে সাদেকুরের পরিবারকে। অবশেষে সাদেকুর চাপের মুখে থানা থেকে জিডি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। জিডি প্রত্যাহারের ক’দিন পরই রুবেল ও তার সহযোগী মিথুন বাসায় ঢুকে সাদেকুর ও তার স্ত্রীকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। ঘটনার পর বড় মেয়ে বীথি কাঁদতে কাঁদতে জানায়, সন্ত্রাসীদের ভয়ে বাবা থানা পুলিশের সাহায্য চেয়েছিলেন। পুলিশ একদিনের জন্যও তাদের বাসায় আসেনি। একই বছর একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে মিরপুরে। কাফরুলের উত্তর ভাসানটেকে ওয়ালিউল্লাহ (৫০) নামে এক ফার্নিচার ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। তিনিও সন্ত্রাসীদের হুমকিতে ভীত হয়ে থানায় জিডি করেছিলেন। ওই বছরই পুরনো ঢাকার স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রেমকৃষ্ণকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে। এর আগে তিনি সন্ত্রাসীদের হুমকিতে ভীত হয়ে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করেন। জিডি করার সাত দিনের মধ্যে প্রেমকৃষ্ণকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। চলতি বছর ১৭ জানুয়ারি ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতের এক নারী বিচারককে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নামে। ডাকযোগে পাঠানো চিঠিতে এই বিচারক ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের এই হুমকি দেয়া হয়। ওই বিচারক সপরিবারে রাজধানীর খিলক্ষেতের নিকুঞ্জে বসবাস করেন। তিনি স্পেশাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিকুঞ্জে পল্লী বিদ্যুতায়ন আদালতে কর্মরত। ওদিনই তিনি খিলক্ষেত থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ জনকণ্ঠকে জানান, পুলিশের সংখ্য যথেষ্ট নয়। ১২শ’ লোকের একজন পুলিশ। ভারত বর্ষে ৪ থেকে ৫শ’ লোকের জন্য একজন পুলিশ। যে সংখ্যক জনবল তা দিয়ে তো মামলা চালাতে পুলিশের হিমশিম খেতে হয়। সেখানে জিডির তদন্ত সত্যিকার অর্থেই কষ্টসাধ্য। তিনি জানান, তদন্ত সাপেক্ষে জিডি নিষ্পত্তি করতে গেলে আগে পুলিশের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। পুলিশের কারিগরি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন না ঘটলে জিডি নিষ্পত্তি সম্ভব নয়। ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ জানান, জিডির তদন্ত না হলে অনেক ক্ষেত্রে হত্যাকাণ্ড কিংবা হামলার ঘটনাও ঘটতে পারে। তিনি জানান, তবে পুলিশ প্রযুক্তি ব্যবহার ও ট্রেনিং অভাব রয়েছে। উন্নত মানসম্মত পুলিশ তৈরি করতে পারছি না আমরা। সিসিসি টিভি ফুটেজের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। নেই কোন উন্নত প্রযুক্তি। জঙ্গী দমন ও কিলারদের ডিকেক্ট করতে পুলিশের কারিগরি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নেই। উন্নত যন্ত্রাংশ নেই। টেলিযোগে এই কারিগরি ও প্রযুক্তি যন্ত্রাংশ আছে মাত্র ছয়টি। যা কোন ক্রমই হুমকিদাতা ও জঙ্গী দমনে সম্ভব নয়। এজন্য প্রযুক্তি ব্যবহার ও কারিগরি উন্নত টেলিযোগাযোগ যন্ত্র বাড়াতে হবে। ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ জানান, কোন রাষ্ট্র একার পক্ষে জঙ্গী দমন করা সম্ভব নয়। এটি উন্নত রাষ্ট্রের সঙ্গে একত্রে কাজ করে তাদের দমন করতে হবে। এজন্য পুলিশে এসব দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে। তিনি জানান, টার্গেট কিলিং রোধ করা কঠিন। টার্গেট কিলিং নেটওয়ার্ককে নিয়ন্ত্রণে আনা, তাদের অবস্থান ডিটেক্ট করতে হলে উন্নত প্রযুক্তি ও কারিগরি যন্ত্রাংশ পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে। তাহলে হুমকিদাতা ও টার্গেট কিলিংয়ের অপরাধীদের ধরা সম্ভব। এটি অচিরেই কমে আসবে। তুরিন আফরোজ জানান, হুমকির বিষয়ে জিডি হলে থানা পুলিশ মোবাইলের কললিস্ট দেখে পাঠায় ডিবিতে। সেখান থেকে হুমকি দাতাকে শনাক্ত করতেই মাস পেরিয়ে যায়। এত দিনে হুমকি দাতার স্থান বদলে যায়। পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি ক্রাইম হুমায়ুন কবির জনকণ্ঠকে জানান, পুলিশ সদর দফতরে সাধারণত জিডির কোন ক্যাটালগ নেই। সারা বাংলাদেশে ৬শ’ ওপরে থানায় অসংখ্য জিডি হয়। তার হিসাব রাখা অসম্ভব। তবে পুলিশ সদর দফতরে মামলার রেকর্ড রয়েছে। তিনি জানান, যে কোন থানা এলাকায় যা কিছু ঘটে। যেমন আগুন, ভবন ধস, আবহাওয়া, মারামারি অথবা নানা অপরাধসহ বিভিন্ন সমস্যার বিষয় থাকলে থানা থেকে কোন পুলিশ অফিসার জিডি করে ঘটনাস্থলে যেতে হবে। অথবা এসে সে বিষয় জিডি করতে হবে সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারকে। কোন অফিসার কোন কাজ বের হলে জিডিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। ডিআইজি ক্রাইম হুমায়ুন কবির জানান, অবশ্যই কোন হুমকি যা খুবই স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জিডি করা হলে তা অবশ্যই ভালভাবে তদন্ত করতে হবে। পুলিশের গাফিলতির বিষয়ে ডিআইজি ক্রাইম জানান, দায়িত্বশীল অফিসাররা স্পর্শকাতর বিষয়ে জিডির তদন্ত ভালভাবে করেন। কিছু অফিসাররা আছেন, তারা এই জিডির বিষয় গুরুতর দেন না। এটি কোনভাবে ঠিক নয়। ঢাকা মহানগর মিডিয়া সেন্টার সূত্র জানায়, ডিএমপিতে ৪৯টি থানা। সব থানার জিডির পরিসংখ্যান রাখা সম্ভব হয় না। তিনি আরও বলেন, থানায় যে পরিমাণ জনবল তা দিয়ে তো মামলার তদন্ত কাজ করতেই হিমশিম খেতে হয়। সেখানে সব জিডির তদন্ত সত্যিকার অর্থেই কষ্টসাধ্য। তবে থানা পুলিশ জিডির গুরুত্ব অনুযায়ী তদন্ত করে থাকেন। এদিকে জিডি করেই তাৎক্ষণিক ফল পেতে চায় ভুক্তভোগীরা। কিন্তু অনুসন্ধান ছাড়া তো আর পুলিশ কোন ব্যবস্থা নিতে পারে না। সব জিডির তদন্ত চাইলে পুলিশ সদস্য দ্বিগুণ করতে হবে বলেও জানান তিনি। তাদের বক্তব্য রাজধানীর বিভিন্ন থানায় বছরে প্রায় পাঁচ লাখ জিডি নথিভুক্ত হয়। এগুলোর বেশিরভাগই খতিয়ে দেখা পুলিশের পক্ষে সম্ভব হয় না। ডিএমপির কয়েকজন কর্মকর্তা অবশ্য দাবি করেন, যেখানে মামলা তদন্তের জন্যই পর্যাপ্ত সময় মেলে না, সেখানে সব জিডির তদন্ত বাস্তবতার নিরিখে অসম্ভব। কেন জিডি করা হয় ॥ পুুলিশের একাধিক কর্মকর্তা ও আইন বিশেজ্ঞরা জানান, মূল্যবান যে কোন জিনিস যেমন- সার্টিফিকেট, দলিল, লাইসেন্স, পাসপোর্ট, মূল্যবান রসিদ, চেকবই, এটিএম বা ক্রেডিট কার্ড, স্বর্ণালংকার, নগদ অর্থ ইত্যাদি হারালে থানায় জিডি করা হয়। কোন প্রকার হুমকির মুখোমুখি হলে বা হুমকির আশঙ্কা থাকলে কিংবা কেউ নিখোঁজ হলেও জিডি করার সুযোগ রয়েছে। অর্থাৎ সাধারণত যেসব ক্ষেত্রে মামলা হয় না সেসব ক্ষেত্রেই থানায় জিডি করা যায়। জিডি করার কোন বাধ্যবাধকতা না থাকলেও নতুন করে হারানো কাগজ তুলতে হলেও জিডির কপির প্রয়োজন হয়। জেনারেল ডায়েরি বা জিডি কোন থানার নিজস্ব কার্যক্রমসহ তার অধীক্ষেত্রে সংঘটিত ও পুলিশের নজরে আনিত যাবতীয় ঘটনার একটি সরকারী দলিল। পুলিশ আইনের ৪৪ ধারার বিধান মতে প্রত্যেকটি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি রেজিস্ট্রার রাখা হয় । এ ছাড়াও ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৪ ও ১৫৫ ধারার উদ্দেশ্য পূরণে থানায় জিডি বই সংরক্ষণ করা বাধ্যতামূলক। জিডি বই লিখন ও সংরক্ষণ সম্পর্কে পুলিশ প্রবিধানের ৩৭৭ ধারায় বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। জিডি রেজিস্ট্রার সংরক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং থানার অফিসার-ইন-চার্জের (ওসির)। তবে ইচ্ছে করলে অফিসার-ইনচার্জ সাময়িকভাবে এই দায়িত্বের কিছু অংশ অন্য কোন অফিসারের ওপর ছেঁড়ে দিতে পারেন। এই বিধানমতে সাধারণত থানার ডিউটি অফিসার এই কাজটি করে থাকেন ওসির পক্ষে। জনগণ কর্তৃক কোন তথ্য বা সংবাদকে সরকারী দলিলে সন্নিবেশিত করার সহজতম উপায় হলো থানায় জিডিভুক্ত করা। কেননা, থানার জিডি বইতে যে কোন এন্ট্রি সাক্ষ্য আইনের ৩৫ ধারা মতে ভবিষ্যতে আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। তাই মানুষের কাছে জিডি এন্ট্রি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০০২ সালের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের একটি গৃহ-জরিপের তথ্যানুসারে বাংলাদেশে নাগরিকদের গড়ে প্রতিটি জিডি এন্ট্রির জন্য ৪৫৮ টাকা ঘুষ দিতে হয়। অনেক সময় ভুক্তভোগীরা অর্থ খরচ করেও থানায় জিডি এন্ট্রি করতে ব্যর্থ হন। পুলিশী সেবার অনেকাংশ বেসরকারীকরণ বা অন্য কোন সংস্থার কাছে হস্তান্তর করা সম্ভব। যেমন, মোটর যানের রেজিস্ট্রেশন, পাসপোর্ট প্রদান ইত্যাদি কাজ থেকে পুলিশকে অব্যহতি দেয়া হয়েছে। বেসরকারী সিকিউরিটি গার্ড দিয়ে বাসাবাড়ি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা, মানি এস্কর্ট ইত্যাদি কাজও করানো হচ্ছে। জিডি এন্ট্রি বা মামলা রুজুর মতো বিষয়গুলো কোনভাবেই পুলিশ থেকে পৃথক করা বা অন্য কোন সংস্থার ওপর ছেড়ে দেয়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে পুলিশ সম্পূর্ণ একচেটিয়া কর্তৃত্ব ভোগ ও দায়-দায়িত্ব বহন করে। তাই থানা পুলিশের কাছে এই বিষয়ে সঠিক সেবা না পেলে মানুষের কাছে আর বিকল্প থাকে না। কাজেই থানায় জিডি বা মামলা রুজুর বিষয়টি সহজীকরণ এবং কার্যকর করা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করেন আইন বিষেশজ্ঞরা। থানা ছাড়াও যেখানে জিডি করা যাবে ॥ জিডির তদন্ত থানা পুলিশের গাফিলতি ও অর্থ লেনদেনের বিস্তর অভিযোগের পর ২০১২ সালের জুন মাস থেকে থানায় সাধারণ মানুষের ভোগান্তি দূর করতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সদর দফতরে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) গ্রহণে বিশেষ সেল খোলা হয়েছিল। তবে আগের মতো সংশ্লিষ্ট থানায় গিয়ে জিডি করার ব্যবস্থাও চালু থাকবে। এর আগে ২০১১ সালে চালু হওয়া অনলাইন জিডির ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় এ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তবে বর্তমানে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের আওতায় ডিএমপি সদর দফতর থেকে নগরবাসী সহজেই পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট পাচ্ছে। বিদেশে যাওয়া বা দেশে চাকরি পাওয়ার মতো বিষয়ে অনেক সময় এ সনদটির প্রয়োজন হয়। থানায় না গিয়ে অনলাইনে জিডি করার পদ্ধতি ॥ ডায়েরি (জিডি) করতে থানায় গিয়ে আবেদনপত্র লেখার দিন শেষ হতে চলেছে। ঘরে বসে অনলাইনে নির্ধারিত ফরম পূরণ করে আপনি নিজেই করতে পারেন সাধারণ ডায়েরি। আপনার দলিল, সার্টিফিকেট, পরিচয়পত্র ইত্যাদি হারানো, চুরি, ছিনতাই সংক্রান্ত তথ্য জানিয়ে বাসায় বসেই নিরাপদে অনলাইনে জিডি করতে পারেন। শুরুতে শুধু ঢাকা মেট্রোপলিটনের সব থানার আওতায় বসবাসকারীরা এ সুযোগ পাচ্ছেন। পাসপোর্ট, ব্যাংকের চেক বই, সার্টিফিকেটসহ কোন গুরুত্বপূর্ণ দলিল হারিয়ে গেলে অনলাইনে সাধারণ ডায়েরি করা যাবে। এছাড়া বখাটে, মাদকসেবী বা অপরাধীদের আড্ডাস্থল বা অন্য কোন অবৈধ সমাবেশ সম্পর্কিত অভিযোগ অনলাইনে করার সুযোগ রয়েছে। যেভাবে অনলাইনে জিডি করবেন ॥ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ওয়েবসাইট যঃঃঢ়:// িি.িফসঢ়. মড়া.নফ/ এই ঠিকানায় প্রবেশের পর প্রধান পৃষ্ঠার ব্যানারের নিচেই দেখতে পাবেন ঈরঃরুবহ ঐবষঢ় জবয়ঁবংঃ নামের একটি ট্যাব। এই ট্যাবে ক্লিক করলে চলে আসবে আলাদা একটি পাতা। পাতার শুরুতেই অনলাইনে সাধারণ ডায়েরি নিয়ে কিছু বর্ণনা দেয়া হয়েছে। নিচের অংশে রয়েছে তথ্য দেয়ার তালিকা। এই তালিকা থেকে আপনি যে ধরনের সাধারণ ডায়েরি করতে চান তা নির্বাচন করুন। নির্বাচনের মাধ্যমে পরবর্তী পাতায় আপনি পাবেন ডায়েরি করার ফরম। ফরম পূরণের শুরুতে আপনি যে থানায় ডায়েরিটি করবেন তা নির্বাচন করতে হবে। এরপর আপনার নাম, ঠিকানাসহ সংশ্লিষ্ট তথ্যাবলি পূরণ করে ঝঁনসরঃ বাটনটি ক্লিক করলেই সংশ্লিষ্ট থানায় পৌঁছে যাবে আপনার তথ্য। এরপর স্বয়ংক্রিয় বেআপনি একটি শনাক্তকরণ নম্বর ও থানা থেকে কখন ডায়েরি সংক্রান্ত সত্যায়িত কাগজটি সংগ্রহ করবেন তার সময় জানতে পারবেন। নম্বরটি সংরক্ষণ করুন। কারণ থানা থেকে আপনার সাধারণ ডায়েরি সত্যায়িত কপিটি সংগ্রহ করতে পরে নম্বরটির প্রয়োজন পড়বে। তথ্য ও পরামর্শ ॥ অনলাইনে সাধারণ ডায়েরি সংক্রান্ত যে কোন পরামর্শ ও তথ্যের জন্য নধহমষধফবংয@ঢ়ড়ষরপব.মড়া.নফ ঠিকানায় মেইল পাঠাতে পারেন। অথবা ফ্যাক্স করতে পারেন ০২-৯৫৫৮৮১৮ নম্বরে।
×