ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শরীফা খন্দকার

উৎসবের আগের রাতে রুটি আর মুরগির ঝোল!

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ১১ জুন ২০১৬

উৎসবের আগের রাতে রুটি  আর মুরগির ঝোল!

(শেষাংশ) রাস্তায় এদেশীয় যাদের দেখা পাওয়া গেল ফরাসী ভাষা তারাই কেবল জানে। হাতে লেখা হোটেল মন্ট্রিয়েল রেনেসাঁর ঠিকানাটা দেখাতে ক’জন ইশারায় সামনের দিকে আঙ্গুল দেখাল। মানেটা যেন ওই যে গাঁয়ের তালগাছটা, ওটার ঠিক পেছনেই। পথের দুই ধারের লোকালয় গ্রামেরই মতো বটে; কিন্তু তালগাছটির সন্ধান পাওয়া যায়নি শেষ দুপুরতক! ওই সময়টাতেই দ্বিখ-িত হয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ফোবানা। একই শহর মন্ট্রিয়েলে দু’দুটি সরগরম সম্মেলন। তদুপরি দারুণ উপভোগ্য ছিল আমাদের ভাগের সম্মেলনটি। আরও অনেকের সঙ্গে নচিকেতা এসেছিলেন। জীবনে কখনও কোন বাউল দেখিনি বলে আফসোস ছিল মনে। এই আমেরিকায় এসে তার সন্ধান পাব কখনও ভাবতেও পারিনি। মন্ট্রিয়েলের সম্মেলনে গিয়েই আমাদের দেখা হলো শুধু একজন বাউলের সঙ্গে তো নয়, দর্শন পাওয়া হলো স্বয়ং এ যুগের বাউল সম্রাট পূর্ণ চন্দ্র দাসের সঙ্গে। তিনি পুত্র দিব্যেন্দুসহ হোটেলের যে ফ্লোরে ছিলেন তার কাছাকাছি ছিলাম আমরাও। সন্ধ্যের আগে অনুষ্ঠানস্থলে যাওয়ার সময় দেখতাম তিনি ও তার পুত্র হয়ত রুম থেকে বেরিয়ে আসছেন। এ সময় তার মাথায় থাকত সম্রাটের মুকুট। কিন্তু গান গাইবার সময় কিন্তু সেটা নয়- থাকত বাউলের রক্তিম মস্তকাবরণ। তার কাঁধে ঝোলানো করতাল, বাঁশি এবং হাতে সাত জোড়া ধাতু দিয়ে নির্মিত গুটিয়ে রাখা লম্বা এক যন্ত্র, যার নাম নাকি চিমটা! মনে হতো বালিকার মতো এই বাউলের গানের যন্ত্রগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখে জিজ্ঞেস করি ‘তুমি কেমন করে গান করহে গুনী’! আমার স্বামী পূর্ণ দাস বাউলের একটা ইন্টারভিউ নিয়েছিল সে সময় তার পত্রিকার জন্য। বাউল সম্রাট সে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তার আবাল্য বাউল জীবনের কথা- ১৪০টি দেশ পরিভ্রমণের গল্প। বলেছিলেন শত বর্ষের অন্যতম বিখ্যাত মার্কিন গায়ক বব ডিলানের কথাও। যে ডিলান বাউল গানে মুগ্ধ হয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি একজন আমেরিকান বাউল। ডিলান তার জন্মস্থানে পূর্ণ দাসের সঙ্গে রেকর্ডও করেছিলেন একাধিক গান। বাউল সম্রাট সবশেষে বলেছিলেন, মানুষের নিজের আত্মাকে জানলেই পরমাত্মাকে জানা যায়। সে সময় আমেরিকাব্যাপী অনুষ্ঠানের ঘনঘটায় সর্ববৃহৎ বাংলাদেশ সম্মেলন অনুষ্ঠানটি হয়েছিল ঐতিহাসিক নিউইয়র্ক মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে। আমেরিকান বাঙালীদের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন সংগঠন লীগ অব আমেরিকা ছিল এর দায়িত্বে। প-িত রবি শঙ্কর এবং জর্জ হ্যারিসনের সেই সুবিখ্যাত বাংলাদেশ কনসার্টের স্থান এই মেডিসন স্কয়ার গার্ডেন। ওপার বাংলার প্রখ্যাত সাহিত্যক সমরেশ মজুমদার দিনে দিনে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন ফোবানা ও সাহিত্য সম্মেলনের সঙ্গে। শুধু নিজে নন বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে তিনি কলকাতা থেকে সঙ্গে করে আনতেন নানা গুণীজন ও নামী-দামী শিল্পীদের। ৯৯ সালে মেডিসন স্কয়ারের জাঁকজমকপূর্ণ ফোবানায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে আনার উদ্যোগও গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তখন ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছে সন্ধ্যার শরীর। তবে সেবার এসেছিলেন আরতি মুখার্জি ও কন্যাসহ অনুপ ঘোষাল। তারা সবাই ছিলেন হোটেল নিউইয়র্কে। এ প্রসঙ্গে আমার একটা গল্প মনে পড়ছে। যে গল্পের নাম হয়ত হতে পারে ‘উৎসবের আগের রাত ও রুটি মুরগির ঝোল’। সমরেশ দাদাকে আমরা আপনজন ভাবি। তার সঙ্গে হোটেলে দেখা করতে যাব আমি ও আমার স্বামী আগের রাতে। জিজ্ঞেস করলামÑ দাদা কি খাবেন আজ রাতে? বাসায় তো আসতে পারবেন না জানিÑ একটু রেঁধে আনি? -ঠিক আছে শুধু একটু রুটি আর মুরগির ঝোল! -কি যে বলেন, শুধু এই? -এটাই যথেষ্ট। যা চাইলেন তাই নেয়া। কিন্তু পৌঁছে দেখা গেল খাবারের প্রতি কোন আগ্রহই নেই তার। গল্পের ফাঁকে সেটা এগিয়ে দিতে বললেন, দেখি কি এনেছেন। আরে এ তো দেখি অনেকটা, অত তো খেতে পারব না। আমার স্বামীর দিকে চেয়ে বললেন, মালেক ভাই একটা কাজ করবেন আমার জন্য? এরপর দুজনের জিজ্ঞাসু নেত্রের দিকে চেয়ে বললেন- আরতি আছে অত নম্বর রুমে। কিন্তু মুশকিলের কথা জানেন দুপুর থেকে কেউ খোঁজও নেয়নি তার। হয়ত এ যুগের নবীনরা আরতি মুখোপাধ্যায়কে চেনেই না। খাবার জল পর্যন্ত দেয়া হয়নি- রুমে যা আছে সেটা তো বাথরুমের জল। ভারি আপসেট হয়ে আছে সে। আমি বরং আমার মতো একটু খাবার রাখছি আলাদা করে। বাকিটা ওর রুমে নিয়ে গিয়ে প্লিজ বলুন আপনারা তার ভক্ত এবং নিজের রান্না করা একটু খাবার নিয়ে দেখা করতে এসেছেন। সারা ফ্লোরে অসংখ্য শিল্পী- বন্যা থেকে আইয়ুব বাচ্চু পর্যন্ত আছেন। তরুণরা বাচ্চুকেই আগলাচ্ছেন মনে হয়। কিন্তু ওসব গান বুঝি না বলে এখনও নিঃসন্দেহেই আমরা আরতিরই ভক্ত। তিনি তো সেই আরতি, অনুরোধের আসরে যার গান শুনে কতবার বন্ধ হয়েছে চোখের পাতা- ‘আমি যখন অষ্টাদশীর ছোঁয়ায়।’ শুধু বাংলা গানের গায়িকা তো তিনি ছিলেন না, বোম্বের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও জনপ্রিয়তা ছিল তার। বলিউডদের বিখ্যাত এক চিত্র পরিচালকের স্ত্রীও তিনি। আরতি যখন কোথাও গাইতে যেতেন তার সম্মানের কথা, ভক্তদের পাগলামির কথা না দেখলেও বুঝতে পারি। চাইলে কত গ্যালন গ্যালন জল গড়াত তার পায়ে। আর আগে জানলে আমরা কি শুধুই রুটি আর মুরগির ঝোল নিয়ে যাই? এমনকি সঙ্গে নেই ফুল কিংবা চকোলেট পযর্šÍ! দু’জনে বাইরে বেরিয়ে একটু দূরে গেলাম পানি কিনতে পাওয়া যায় কিনা দেখতে। পেয়ে একটা গ্যালন কিনে শিল্পীর দরজায় দাঁড়িয়ে টোকা দেয়া হলো। ভেতরের শব্দে মনে হচ্ছিল অভিমান নিয়েই রিহার্সেলে তাকে বসতে হয়েছে। কারণ ঘরে যন্ত্র বাজছে- থেমে থেমে গান শোনা যাচ্ছে। যিনি বেরিয়ে এলেন কোন যন্ত্রী বোধ হয়। বললাম, আমরা দিদির দুজন ভক্ত। জানি তিনি খুব ব্যস্ত, তবু দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই একটু চোখের দেখা দেখতে চাই। সামান্য পরেই দিদি এসে দাঁড়ালেন আর আমাদের মনে পড়ল অনুরোধের আসরের দিনগুলোকে। খুব সাধারণ এক সুতি শাড়ি পরনে, মুখটা মলিন। দুপুরে খাওয়া হয়েছে কিনা কে জানে। দাদার সেই শেখানো বুলি অক্ষরে অক্ষরে আউড়ে নিয়ে জল এবং খাবারটা তুলে দিলাম তার হাতে। আর কি আশ্চর্য শুধু এইটুকু এবং এইটুকুতেই? মনে হলো এক অবুঝ অভিমানের পাহাড় ভেঙ্গে ছলকে উঠল খুশি ভরা এক তরল নদীÑ ‘তখন তোমার একুশ বছর বোধ হয় আমি তখন অষ্টাদশী ছোঁয়ায়!’ লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী লেখিকা
×