ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হেইলী সুকায়ামা

ইন্টারনেট আসক্তিতে সারাবিশ্ব

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ১১ জুন ২০১৬

ইন্টারনেট আসক্তিতে সারাবিশ্ব

ইন্টারনেটের একটা অন্ধকার দিক আছে। সেই দিকটির জন্য তরুণরা চাকরি হারাচ্ছে, সামাজিক জীবন হারাচ্ছে। ইন্টারনেট আসক্তির কথাটা উড়িয়ে দেয়া সহজ। যুক্তরাষ্ট্রে এই ব্যাপারটি সমস্যা না বৈকল্য হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত নয়। চিকিৎসা বিজ্ঞান এখনও পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে নির্ণয় করতে পারেনি ইন্টারনেট আসক্ত মস্তিষ্কের ভেতর কি চলে। তাছাড়া ইন্টারনেট আসক্তি বলতে ঠিক কি বোঝায় তারও কোন সুস্পষ্ট সংজ্ঞা নেই। তথাপি ক্রমবর্ধমান সংখ্যক বাবা-মা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে স্ক্রিনের প্রতি আসক্তি অনেক তরুণ আমেরিকানের জন্য বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা স্কুল থেকে বাদ পড়ছে, পরিবার পরিজন ও বন্ধু-বান্ধব থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে এবং সামাজিক পরিবেশে গভীর উদ্বেগের অভিযোগ করছে। বাবা-মার স্বার্থ নিয়ে কথা বলে এমন একটা সংগঠন আছে যার নাম ‘কমন সেন্স মিডিয়া’। সংস্থার সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে শতকরা ৫৯ ভাগ বাবা-মা মনে করেন তাদের কিশোর বয়সী ছেলেমেয়েরা মোবাইলের প্রতি আসক্ত। ৫০ শতাংশ কিশোর-কিশোরীও একই কথা মনে করে। এ বছর প্রায় ১ হাজার ৩০০ বাবা-মা ও তাদের সন্তানদের ওপর এই সমীক্ষা চালানো হয়। রিস্টার্টের মতো কেন্দ্রগুলোর চাহিদা থেকে প্রমাণ হয় যে ইন্টারনেটের একটা অন্ধকার দিক আছে যার বিরুদ্ধে অনেকেই সংগ্রাম করছে। বাবা-মায়ের কাছ থেকে শত শত আবেদন পাওয়ার পর কেন্দ্রটি কিশোরদের ইন্টারনেট আসক্তি ছাড়ার কর্মসূচী চালু করতে যাচ্ছে। কিছু কিছু বাবা-মা মনে করেন যে এই আসক্তি এমনই গুরুতর আকার ধারণ করেছে যে চিকিৎসা নেয়ার জন্য এসব কেন্দ্রে সন্তানদের পাঠাতে তারা হাজার হাজার ডলার ব্যয় করতে প্রস্তুত। কারণ ইন্স্যুরেন্সে এমন আসক্তি ছাড়ার ব্যবস্থা নেই। পাঁচ দিন রিস্টার্টে ছিল এমন এক ২২ বছরের তরুণ এলেক্স বলে এটা ঠিক নেশাসক্তির মতো ব্যাপার নয় তবে অতি, অতি বাস্তব এক সমস্যা। এলেক্স কলেজ থেকে বাদ পড়েছিল কারণ ক্লাসে বা কাজে যাওয়ার চাইতে সে গেম খেলা বা ইন্টারনেট ব্যবহারকে প্রাধান্য দিত। ওর বাবা-মা সর্বদাই ইন্টারনেট ব্যবহারে তাকে উৎসাহিত করত। এতে ওর কি ক্ষতি হতে পারে তারা তা বুঝতে পারেননি। এলেক্সের ভাষায় : ‘আমরা এক গিনিপিগ প্রজন্ম। আমি সম্পূর্ণ ইন্টারনেটনির্ভর হয়ে পড়েছিলাম।’ বিশেষজ্ঞদের মতে, যারা ইন্টারনেট নেশা বা আসক্তিতে ভুগছে বলে থাকে অন্য ধরনের নেশাসক্ত মানুষদের সঙ্গে তাদের অনেক লক্ষণ মিলে যায়। যেমন একই ধরনের রাসায়নিক উপাদান তাদের মস্তিষ্কে গিয়ে ঢোকে। এসব রাসায়নিক উপাদান উদ্দীপক শক্তির মতো। এগুলোর সংস্পর্শে এলে মস্তিষ্কের আনন্দ-বিনোদনের কেন্দ্রগুলোতে আলো জ্বলে ওঠে। নেশাসক্তরা তখন অন্যান্য শখের বিষয় বা কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কিংবা কখনও কখনও তাদের কোন শখই জাগে না। অনলাইনে যেতে না দেয়া হলে তাদের মধ্যে গুটিয়ে নেয়ার লক্ষণ দেখা দেয় যেমন বিরক্তি, বিষণœতা এমনকি শারীরিক অস্থিরতা। বিশেষজ্ঞরা বলেন তখন তারা হটে যায় ইন্টারনেটের প্রান্তে যেখানে তারা ত্বরিত সাফল্য খুঁজে পায়। যা তারা বাস্তব জগতে পায় না। যেমন কোন খেলায় বড় ধরনের র‌্যাঙ্কিং অথবা বেশ পছন্দের ফেসবুক পোস্ট। পিটার নামে ৩০ বছরের এক যুবক রিস্টার্ট কর্মসূচী শুরু করার আগে ছিল গৃহহীন ও বেকার। এ্যালকোহলের নেশা ছাড়াতেও তাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। তবে সে বিশ্বাস করে যে নেশার মতো ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে তার জীবনে কিছু অন্ধকারতম মুহূর্ত থেমে এসেছিল। তার নিজের ভাষায় : ‘আমি সম্পূর্ণ ইন্টারনেটনির্ভর হয়ে পড়েছিলাম। এতে সম্পর্কের দিক থেকেও আমাকে চড়া মাসুল দিতে হয়েছে।’ ১৩ বছর বয়সে বাবার মৃত্যুর পর পিটারের ইন্টারনেটনির্ভরতা শুরু হয়। বিয়োগব্যথা সামলে নিতে সে গেমিংয়ের রাজ্যে নিমগ্ন হয়। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খেলে চলে। কখনও কখনও খাওয়া-দাওয়া এমনকি বাথরুমে যাওয়াও ভুলে যায়। গেমিং তাঁকে বাস্তবতা থেকে আনন্দদায়ক পরিত্রাণ এনে দেয়। অধিক থেকে অধিকতর সময় সে খেলায়, অনলাইন ভিডিও দেখায় এবং সোশ্যাল মিডিয়া ও ফোরামে আলোচনা এবং যুক্তিতর্কে লিপ্ত হয়ে পড়ে। সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে গিয়ে সে ব্যর্থ হতে থাকে এবং নিজেকে সম্পূর্ণ অকর্মার ধারি হিসেবে মনে হয়। এই অনুভূতির যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণের জন্য সে অবশিষ্ট জগত থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। স্কুলের লেখাপড়ার ক্ষতি হয়। কখনই রান্নাবান্না, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা ও ব্যায়াম করা অর্থাৎ একজন প্রাপ্তবয়স্ক যেভাবে জীবনযাপন করে তা শেখেনি বিধায় তার শারীরিক স্বাস্থ্যেরও অবনতি ঘটে। সবকিছু মিলিয়ে মায়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভাঙ্গনের দিকে চলে যায়। রিস্টার্টের যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা হিলারি ক্যাশ এসব আচরণ বেশ ভালমতোই জানেন। ১৯৯৪ সালে ইন্টারনেট নেশাসক্ত একজনকে তিনি প্রথম চিকিৎসা করেছিলেন। অনলাইন গেমিংয়ের নেশায় সেই মানুষটি এতই আচ্ছন্ন থাকত যে তার দাম্পত্য জীবন ভেঙ্গে গিয়েছিল। তাঁর অনেক তরুণ ক্লায়েন্টের আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দুর্বল। এমনকি ভবিষ্যতের কোন পরিকল্পনা করতেও তারা অপারগ। আহারের পরিকল্পনার কথা ভাবতে গেলে কারোর কারোর মধ্যে রীতিমতো আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এসব সমস্যা একত্রিত হয়ে বিশেষ কোন অবস্থার জন্ম দেয় কিনা কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ সে সম্পর্কে অত নিশ্চিত নন। যুক্তরাষ্ট্রে ইন্টারনেট নেশার নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা নেই। ডায়াগনস্টিক এ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়েল অব মেন্টাল ডিসঅর্ডারস-এ (ডিএসএম) এটা সমস্যা হিসেবে স্বীকৃত নয়। মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ন্যান্সি পেট্রি বলেন, ইন্টারনেট আসক্তি বলতে ঠিক কি বোঝায় বর্তমান গবেষণা থেকে তা একেবারে বাতিল করে দেয়া কঠিন। যেমন ধরুন, অনলাইন পর্নোগ্রাফির প্রতি আসক্তিটি কি ইন্টারনেট নেশার প্রমাণ নাকি যৌন বৈকল্যের পরিচায়ক? নাকি দুটোই হতে পারে? পেট্রি বলেন, এমনকি ভিডিও গেমের প্রতি আসক্তির মতো বিষয়টির পর্যালোচনা করতে গিয়ে গবেষকরা এখনও পর্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলতে পারেন না খেলার কোন্ কোন্ দিক একান্তভাবে নেশার উদ্রেক করে। আমেরিকায় ইন্টারনেট নেশার কথা সরকারীভাবে স্বীকার করা না হলেও অন্যান্য দেশে কোন না কোন ধরনের ইন্টারনেট আসক্তিকে গুরুতর অবস্থা বলে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করা হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় ইন্টারনেট নেশার একটা আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা আছে। সেখানে ছাত্রদের এই নেশা থাকলে তা নির্ণয় করা হয় এবং সরকারী চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়। চীনে সরকারী ‘বুট ক্যাম্পগুলোতে’ লাখ লাখ কিশোরের চিকিৎসা করা হয়েছে। জাপানেও তরুণদের ইন্টারনেট ‘ফাস্টিং ক্যাম্পে’ রেখে তাদের আসক্তি পরীক্ষা করা হয়। তবে গবেষকরা বলেন যে, আমেরিকায় এই সমস্যাটা নিয়ে আরও গবেষণা করা প্রয়োজন। কমনসেন্স মিডিয়ার পরিচালক জিম স্টেইয়ার বলেন ‘আমরা বহুলাংশে অন্ধের মতো উড়ে চলেছি কেননা এ বিষয়ে আমাদের গবেষণা খুবই কম।’ সংস্থার গবেষণা পরিচালক মাইকেল রব বলেন, প্রযুক্তির সুষম ব্যবহার নিয়ে সন্তানদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা সব বাবা-মায়েরই উচিত। বেশি ব্যবহার করলেই যে সমস্যা হবে এমন কোন কথা নেই। তবে বাবা-মার উচিত তাদের বাচ্চাদের জানা ও বোঝা। প্রযুক্তির ব্যবহার যেহেতু অনিবার্য, সেহেতু সেটা এড়িয়ে যাবার উপায় নেই তাই এর ব্যবহারের সুস্থ অভ্যাস গড়ে তুলতে বাবা-মায়েরা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। অনুবাদ ॥ এনামুল হক ষ ওয়াশিংটন পোস্ট
×