ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে

খনিজ সম্পদের বিপুল মজুদ

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ১১ জুন ২০১৬

খনিজ সম্পদের বিপুল মজুদ

বগুড়ায় যমুনার পশ্চিম তীরে যে তেলের মজুদ আছে তা গত শতকের শুরুতে জরিপ করে জানানো হয়েছে। এরপর খনন করা স্থান হঠাৎ বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৮২ সালের ১২ ডিসেম্বর সিলেটের হরিপুরে তেলের স্বর্ণদুয়ার উন্মোচিত হলে তেল মজুদের এলাকা নির্ণয়ের জন্য ওই সময়ের প্রযুক্তি ভূকম্পন জরিপের উদ্যোগ নেয়া হয়। এরপুর বগুড়া রংপুর পঞ্চগড়ে পেট্রোবাংলা ও শেল বাংলাদেশ বিডি লিমিটেড জরিপ শুরু করে। ওই সময় বলা হয়, বগুড়ার মাটির নিচে তেলের অনেক বড় মজুদ রয়েছে। তেল আছে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার শালবাহানে। তারপর হঠাৎ করেই জরিপ বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৮৭ সালে জরিপ দল বলেছিল যমুনার পশ্চিম তীরে তেল পাওয়া গেলে দেশের জ্বালানি চাহিদার অনেকটাই মেটানো সম্ভব। উল্লেখ করা হয়, হরিপুরে তেল উত্তোলন শুরু হয়েছে। গ্যাসের ক্ষেত্রে উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের যে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে বগুড়া পঞ্চগড়ে তেল প্রাপ্তিতে সেই বিচ্ছিন্নতা আর থাকছে না। কারণ যেখানে তেলের আধার মেলে তার আশপাশেই মাটির নিচে আছে গ্যাস, কয়লা, কঠিন শিলা, চুনা পাথর আকরিক লোহাসহ নানা খনিজ। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে সব সময় কম গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ফলে এ অঞ্চলে খনিজ উত্তোলনও হয়নি। এরই মধ্যে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় কয়লা খনি থেকে কয়লা ও মধ্যপাড়ায় কঠিন শিলা উত্তোলন শুরু হয় নব্বই দশকের শেষ প্রান্তে। বর্তমানে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির কয়লা দিয়ে স্টিম টারবাইনে আড়াইশ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদিত হয়ে জাতীয় গ্রিডে যোগ হচ্ছে। মধ্যপাড়ার কঠিন শিলা বিক্রি শুরু হয়েছে। এর বাইরে উত্তরাঞ্চলে আর কোন খনিজ উত্তোলনের খবর নেই। ভূতাত্ত্বিকগণের মতে উত্তরাঞ্চলে তেল গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনা বেশি। কারণ এই অঞ্চলের মাটি অনেক পুরনো। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ব-দ্বীপ বঙ্গ অববাহিকার বিশাল অংশ জুড়ে বাংলাদেশ। এই দেশের উত্তর ও উত্তর পশ্চিমে সিকিম কাঞ্চনজঙ্ঘার উপত্যকা খাসিয়া জয়ন্তিকা থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। গিরিপথ ছুঁয়ে সরল রেখায় সমুদ্র অরণ্যময় মালভূমি ও সমতল ভূমি নদীবাহিত পলি-গঠিত। এই বঙ্গীয় ব-দ্বীপে তেল গ্যাস না পাওয়াটাই বিস্ময়। দীর্ঘদিন ধরে ভূতাত্ত্বিকরা এই দেশে তেল প্রাপ্তির সম্ভাবনা প্রকাশ করছে। হরিপুরে তেল প্রাপ্তি ও বগুড়ার মাটির নিচে জরিপে তেলের আধার ও পঞ্চগড়ের শালবাহানে তেল খুঁজে পাওয়ায় সে সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ পেয়েছে। ১৯১০ সাল থেকে এই দেশে তেল অনুসন্ধান শুরু হয়। প্রথম শুরু করে বিদেশী কোম্পানি। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে বগুড়ায় যমুনার পশ্চিম তীরে এবং কুচমা ও কলাকোপায় ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড ভ্যাকুয়াম ওয়েল কোম্পানি কূপ খনন করে। তারপর তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১৯৮৭ সালে ভূকম্পন জরিপ শুরু করার পরও তা বন্ধ হয়। অথচ ভূবিজ্ঞানীরা বার বার বলছে দেশ বিপুল খনিজ পদার্থ ও তেলের ওপর ভাসছে। এই বিষয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুব ভালভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথ্য সার্ভিসের ওয়াশিংটন ফাইলের স্টাফ রাইটার জুডিথ ট্রানজো তাঁর নিবন্ধে বলেছেন, বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের রিজার্ভের পরিমাণ অন্তত ১১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে বাংলাদেশের তেল গ্যাসের হিসাব কষছে, সেখানে দেশের ভূবিজ্ঞানীরা উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে তেল গ্যাস তুলতে এগিয়ে আসছে না। মাঝে মধ্যে সরকারী সংস্থা বাপেক্স গ্যাস তেলের পুরনো জায়গাগুলোতে রুটিন জরিপ করে ফিরে যায়। এক সূত্র জানায়, বগুড়া ও পাবনার মধ্যে ৭০ কিলোমিটার এলাকায় প্রাথমিক জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে ভূস্তরে যেভাবে গ্যাস ও তেল থাকার কথা সেই অবস্থাই বিদ্যমান। ভূগর্ভে হাইড্রোকার্বনের উপাদান ও তা মজুদ হওয়ার কয়েকটি নিয়ম আছে। ভূস্তরে রয়েছে অসংখ্য ভাঁজ। সেখানে উৎস শিলার মধ্যে জৈব উপাদান তাপ ও চাপে বিবর্তনে তেল ও গ্যাসে রূপ নেয়। এইসব উপাদান শিলা থেকে বের হয়ে ফাঁক ফোকরে স্থান নেয়, পরে উর্ধমুখী হয়ে আরেক স্তরে ছোটে। ওপরে ছুটে চলায় তৈরি হয় ফাঁদ বা ট্র্যাপ। লুকিয়ে থাকা এই সম্পদ কাঠামোগত (স্ট্রাকচারাল ট্র্যাপে) ফাঁদে থাকলে তেল গ্যাস তুলতে ঝুঁকি কম। চট্টগ্রাম সিলেট কুমিল্লায় প্রাপ্ত স্ট্রাকচারাল ট্র্যাপেই অনুসন্ধান চলছে এবং গ্যাস পাওয়াও যাচ্ছে। বগুড়া ও পাবনার মধ্যে ভূস্তরে স্ট্রাটিগ্রাফিক ট্র্যাপ সাজানো নয়। এইসব ফাঁদেও বর্তমান প্রযুক্তির অগ্রসরতায় খনন চালানো যায়। বিভিন্নœ দেশে সেভাবেই খনন চলছে। দিনাজপুরের ফুলবাড়ি ও রংপুরে যে কয়লা আছে, তা তোলা হয়নি। এদিকে পঞ্চগড়ের শালবাহানে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তেলের সন্ধান পাওয়ার পর ফ্রান্সের ফস্টাল কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি হয়। ওই কোম্পানি ভূমির আট হাজার ফুট নিচে উন্নতমানের তেল স্তরের সন্ধান পায়। তেল প্রাপ্তি নিশ্চিত হওয়ার পর ১৯৮৮ সালের ১০ মে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ঢাকঢোল পিটিয়ে খননের কাজ উদ্বোধন করেন। তেল কূপ খননে ব্যয় হয় ৩৫ কোটি টাকা। ওই বছরই ২১ জুন ফস্টাল কোম্পানি কূপটিকে কংক্রিটের সিলে বন্ধ করে দেয়। সূত্র জানায়, খননের পর যেখানে তেল প্রাপ্তি নিশ্চিত, সেখানে হঠাৎ কূপ সিলড করার বিষয়টি আজও রহস্য হয়ে আছে। যেমন রহস্যজনক হয়ে আছে বগুড়ার যমুনার তীরে ভূকম্পন জরিপ চালিয়ে তা বন্ধ করা হয়। জয়পুরহাটের চুনাপাথর প্রকল্পটিরও একই দশা। খনন শুরু করেও তা বন্ধ করে দেয়া হয়। এভাবে উত্তরাঞ্চলে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×