ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ছন্দিত বর্ণের নিভৃত কথন আক্তারুজ্জামান সিনবাদ

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ১০ জুন ২০১৬

ছন্দিত বর্ণের নিভৃত কথন আক্তারুজ্জামান সিনবাদ

এ দেশের চিত্রকলার জগতে ছাপচিত্র একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। বহু শিল্পী সুনাম অর্জন করেছেন ছাপচিত্রের মাধ্যমে। ছাপচিত্র ইতিহাসের উপাদান হিসেবে কাজ করে। শিল্পরুচি উন্নত করতেও ছাপচিত্রের ভূমিকা কম নয়। চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারি-১ এর দেয়ালজুড়ে ঝুলছে ছাপচিত্র মাধ্যমে আঁকা বিভিন্ন শিল্পকর্ম। এ যেন স্বপ্নময় ছবির জগত। দেয়ালের কোথাও ফাঁকা জায়গা নেই। ছবি দিয়ে পরিপূর্ণ পুরো গ্যালারি। ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে চোখে পড়ে যায় অনেক গল্পই। অনেকগুলো ভাবনা যেন সাজিয়ে রাখা। ডাকছে তারা দেখতে, জানতে, বুঝতে। শিল্পী যা ভেবে ভেবে এঁকেছেন তাই দর্শক বুঝে নিচ্ছেন এমনও নয়। আবার কখনও কখনও এমনটিও হচ্ছে বটে। শিল্পীর সঙ্গেই খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে দর্শকের চিন্তার সুতো। এচিং এ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমে আঁকা শিল্পী রফিকুল ইসলাম রবির ‘চক্র’ ও ‘স্টাডি-৩’চিত্র দুটি ভাবনার অভিনবত্বে অঙ্কিত। ‘চক্র’ সাদা কালো রঙের বিন্যাস। যারা হয়তো সময়ের যাঁতাকলে পড়ে পিষ্ট। আছে নগরের ধ্বংসাবশেষ। মানবতা, বিবেক বোধ চাকার নিচে পিষ্ট। মিশমিশে কালো জমিতে আবৃত চিত্রপট। আশপাশের দৃশ্য সাদা রেখায় চিত্রিত। ‘স্টাডি-৩’ চিত্রে আছে কয়েকটি পরিত্যক্ত মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেলগুলো সারিবদ্ধভাবে সাজানো। মরীচিকা ধরা একটু স্পর্শ করলেই যেন মরীচিকা ঝরে পড়বে। যন্ত্রাংশগুলো খুব যতœ নিয়ে আঁকা হয়েছে। সামনের মোটরসাইকেলটির সামনের চাকার লাল ঢাকনা পুরনোর মাঝে যেন নতুনের আহ্বান। মূলত সময়, মানবতা, বিবেক বোধ প্রভৃতিকে শিল্পী রূপক অর্র্থে বোঝাতে চেয়েছেন। মোটরসাইকেল প্রতিমাকল্প অভিব্যক্তির দীপ্রতায় ও মাধ্যমে ব্যবহারের সৌকর্যে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শিল্পী কামরুল ইসলামের ‘বার্ডস প্যারডাইস উইথ মি’ সাদা ও কালচে বাদামি রঙে লিখোগ্রাফি মাধ্যমে আঁকা। প্রতিকৃতি চিত্র। উজ্জ্বল স্বর্গীয় আলো পড়েছে মুখের ওপর। কাঁধে পেঁচা, শার্টের কলারের ওপর ছোট একটি পাখি, স্বর্গীয় আবহ তৈরি করেছে। প্রতিকৃতির দৃষ্টি দর্শক বরাবর। রঙের কুশলী প্রয়েেিগর সঙ্গে সঙ্গে বিষয়-ভাবনার দারুণ সম্মিলন ঘটেছে। রূপ বিন্যাসে স্বকীয়তার মধ্য দিয়ে এই ভাঙ্গা বিশ্বে শিল্পী এক আশায় প্রতীক নির্মাণ করতে চেয়েছেন। মুক্তাকাশে শিল্পীরা নিজেদের সৃজন তুলে এনেছেন নবযাত্রার প্রতিচ্ছবি। যাদের কাজ প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে তারা সবাই তরুণ এবং বর্তমান ছাত্রছাত্রী ছাপচিত্র বিভাগের। গুরু-শিল্পীরা যেভাবে কাজ করেছেন তার ছায়াতলে দীক্ষিত হয়েছে নবীন শিল্পীরা। তাদের কাজের রশ্মিটুকু নিয়ে নবীনরা নতুন দিনের আলো জ্বালিয়েছে নিজস্ব শিল্পভুবনে। সূর্যহীন অন্ধকারের কোন ইতিহাস নেই। ইতিহাস আছে শুধু সূর্যোদয়ের আর সূর্যের আলোয় উজ্জ্বল প্রহরের। এভাবে শেষ থেকে শুরু হতে হতে এ দেশের শিল্পের প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়ে আরেক শাখা-প্রশাখায় প্রসারিত হয়ে পড়েছে। উডকাট মাদ্যমে আঁকা শিল্পী রুবাইয়া জামানের রিক্সা ল্যান্ডস্কেপ’ শিল্পকর্মটি তিনটি ভাগে বিভক্ত। প্রতিটি ভাগেই রয়েছে ঢাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় বাহন রিক্সা। উপরের অংশে লাল, হলুদ ও হাল্কা নীল রঙে আঁকা চলমান চারটি রিক্সা। মধ্যভাগে স্থির অবস্থায় চালকসহ একটি রিক্সা একেবারে নিচের অংশে রয়েছে চালকসহ তিনটি রিক্সা। দুটি চলমান এবং একটি স্থির। উজ্জ্বল রঙে আঁকা বলে রিক্সাচিত্রের গুণাবলী ফুটে উঠেছে। প্রতিটি ভাগেই দূরের ও কাছের প্রকৃতিকে পরিপ্রেক্ষিতের সুষম ব্যবহারে নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে একই সঙ্গে ফিগারগুলোকে রিয়েলিস্টিকভাবে আঁকা হয়েছে। কাপড়ের ভাঁজ ও ফিগারগুলোর অভিব্যক্তি প্রকাশে আলো-ছায়ার সুষ্ঠু বিন্যাস, রঙের স্বাবলীলতা এবং বাস্তব কল্পনা সহজেই ধরা পড়ে তার চিত্রে। নীরব চর্চার মাধ্যমে নিজের একটি আলাদা চিত্রভাষা নির্মাণে সচেষ্ট রুবাইয়া। প্রদশর্নীতে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক তুরুণ শিল্পীই তাদরে সৃজনে যে নবমাতা সঞ্চার করে চলেছে তা শিল্পানুরাগীদের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়েছে। ছাপাই ছবির জগতে এরা সবাই দক্ষ ও অভিজ্ঞ। ছাপাই ছবির যে নানা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দিক রয়েছে, শ্রম ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তারা সবাই ইতোমধ্যে তা খুব যতœ সহকারে আয়ত্ত করেছেন। সবাই একটা নিজস্বতা আনার প্রচেষ্টায়রত বলেই মনে হয়। মুখে পাইপ, মাথায় কারুকার্যময় হ্যাট, চোখে বড় চশমা, ফুলহাতা গ্রাউন পরা নারী প্রতিকৃতি। টেবিলের ওপর বাঁ হাতে ধরা পাতা উল্টানো একটি বই। ডান হাত টেবিলের ওপর ভর করে মুখের পাইপের দিকে। মনোযোগ বইয়ের দিকে। হ্যাটের নিচ থেকে কাঁধের ওপর দিয়ে গড়িয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় সামনের দিকে বেরিয়ে এসেছে ঢেউ খেলানো কেশরাশি। টেবিলের ওপর বইয়ের কাছেই ডানপাশে একটি পটারি। পটারির ভেতরে রাখা পাতা ও ডালপালাসহ ফুলগুলো বেশ সতেজ। প্রতিকৃতির মাথার ওপরে পেছনের দিকে জ্বলছে লাইট। বাঁপাশে খোলা জানালা। জানালার ফাঁকে প্রকৃত উঁকি দিচ্ছে। কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে আলো-আঁধারির খেলা। ঊর্মি রায়ের উডকাট মাধ্যমে আঁকা চিত্রটিতে এসব দৃশ্যকাব্য উস্থাপিত হয়েছে। বিষয় নির্বাচন ও উপস্থাপনার জন্য চিত্র বিন্যাস করেছেন খানিকটা স্বতন্ত্রভাবে। বিন্যাসের নক্সা আর বর্ণবিন্যাস তার কাজকে নিয়ে গেছে এক ভিন্ন মাত্রায়। চেনা বস্তু, চেনা পরিবেশ হয়ে ওঠে অচেনা মায়াবী। একটু গিয়ে তৈরি হয় বৈকি। শিল্পে আমরা যে অধরাকে খুঁজি, মনে হয় তার কাছাকাছি অবস্থানে আছেন ঊর্মিরায়। এক খ- কাঠ বা এক খ- ধাতব পাত্র খোদিত করার শুরু থেকে প্রিন্ট নেয়া পর্যন্ত কেবলই বিশেষ মনোযোগের প্রয়োজন হয়। শিল্পী ফক্রুল ইসলাম মজুমদারের কাজে সেই ছাপ স্পষ্ট। তার চিত্রে প্রচ- মিনিসাইজড রেখা, ফর্ম, রঙের, মার্জিত ব্যবহার নতুন স্বকীয় ভাষা তৈরি করেছে। তার উডকাট মাধ্যমে আঁকা ‘সময় এবং বাস্তবতা’ সিরিজ চিত্রে দেখা যায় অর্ধশায়িত অবস্থায় একটি পুরুষ ফিগার। যার মডেল শিল্পী নিজেই। হাত-পা বিশেষ ভঙ্গিতে রাখা দৃষ্টি উপরের দিকে। ডান হাতে ও ডান পায়ের ওপর সমস্ত ভর। ডান হাতে ভর করে বাঁ হাত উপরের দিকে সামনে বাড়ানো। যেন সময়ের প্রতি আহ্বান। পরনের লাল কাপড়ের ভাঁজগুলো যতœসহকারে আঁকা। ব্যাক গ্রাউন্ডে একটি বড় প্রতিকৃতি। দর্শক বরাবর দৃষ্টি। অন্য ছবিটিও একই রকম। বাঁ হাত ও বাঁ পায়ের ওপর ভর করে ফিগারটি অর্ধশায়িত। ডান পা ও হাত উঁচু করে সামনের দিকে ভাঁজ করা। পরনে হলুদ রঙের কাপড়। ব্যাক গ্রাউন্ডে একই ধরনের প্রতিকৃতি। ছবিগুলোতে টেক্সচার ও পরিশীলিত রেখা বিন্যাসে যে অনুভূতি প্রতিফলিত হয় তা তার ছবির অনন্য বৈশিষ্ট্য। রঙের ব্যাকরণ মেনেছেন, কোথাও আবার পর মুহূর্তে অগ্রাহ্য করেছেন সব নিয়ম কানুন। চিত্রপটের সঙ্গে মানুষের ছবির বিষয়ের বস্তুগত বিভাজন করেছেন সুপরিকল্পিত স্থান বিভাজনের মাধ্যমে। তার ছবি কাব্যময়তায় সমৃদ্ধ। প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের মধ্যে অনেকের কাজেই সম্ভাবনার ইঙ্গিত রয়েছে। নির্মাণ পদ্ধতির দিক থেকে উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে অন্যতম শিল্পী মোঃ মিজানুর রহমানের ‘বাথ অব বাফেলো-২’ চিত্রকর্মটি। সাদা-কালো রঙের উডকাট মাধ্যমে আঁকা। রাখাল বালকের দুটি মহিষকে পুকুরের পানিতে গোসল করাবার দৃশ্য অঙ্কন করা হয়েছে। পানিতে অনেক খুঁটি। যার ছায়া পানির ওপর পড়ে প্রায় মিশে গেছে। কালো মহিষ দুটির মতো রাখালের ফিগারও কালো, ছায়ার মতো। রুপালি রোদ পানির ওপর পড়ে চিকচিক করছে। ছবিটি চিরচেনা গ্রামের দৃশ্যকল্পের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মহিষের গলার ঘণ্টা, দড়ি এবং পানির ওপর যে আলো-ছায়ার খেলা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এতে শিল্পীর ধৌর্যশীলতার পরিচয় মেলে। কুরি কুরি রেখার জাল, বিন্দুর বুনট, বর্ণ ছোপের হাল্কা ও গাঢ়তর প্রকাশের সহাবস্থান এবং সর্বোপরি মোটিফের সঙ্গে ওইসব অনুষঙ্গের পারস্পরিক সম্পর্ক শিল্পের এসব বিষয় স্থির মনোনিবেশে চিত্রায়িত করতে গিয়ে মিজান পারমিতার পরিচয় দিয়েছেন। ইমেজের এই সংযুক্তিতে শিল্পী প্রমাণ করতে চেয়েছেন চিররূপান্তশীল মানুষের মন। সাদা-কালোর রৈখিক বুনটে ও পরিসর বিন্যাসে স্বকীয় পদ্ধতিতে তিনি জটিলতার ি ভেতর সূক্ষ্ম আলো-ছায়াকে খেলিয়েছেন। মনের অধ্যুষিত পরিসরকে বিন্যাসকে শিল্পিত করেছেন। তার চিত্রের জমিন অবলোকন করার পর শিল্পপাঠে অভিজ্ঞ দর্শক অনুভব করবেন শিল্পীর হাতের জোর, মাধ্যমের প্রয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। এ ছাড়াও অন্য তরুণ শিল্পীদের ছাপচিত্রে উঠে এসেছে প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ, ফুল, বৃক্ষ, পাখি, ঘোড়া, কাক, সাইকেল, সিগারেটের প্যাকেট, প্রতিকৃতি, মাথার ভেতর থেকে গজিয়ে ওঠা ফুলের গাছ ইত্যাদি। চিত্রগুলো মোটা রেখা এবং সরল আকারে চিত্রিত করেছেন শিল্পীরা। পারিপার্শ্বিক নানা চরিত্রের দেখা যেমন মেলে তেমনি প্রকৃতির নানা উপাদানের যে প্রহেলিকাময় রসায়ন, তারও উপস্থিত দৃশ্যমান হয় এসব চিত্রে। মানবীয় সম্পর্কের নানা অদ্ভুত বৈপরীত্য তাদের শিল্পামানসে উত্তর-অন্বেষণ করে। বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন রুচির সংগ্রাহকের কাজের উপস্থাপনের ফলে দেশের ছাপচিত্রের বৈচিত্র্যময় বিকাশের ধারা এ প্রদশর্নীতে পাঠ করা সম্ভব। ছাপচিত্রের রস আস্বাদনই প্রদর্শনীর আসল উদ্দেশ্য। ছাপচিত্রের মর্ম উপলব্ধির জন্য আয়োজন করা হয়েছিল এ প্রদর্শনীর। শিল্পকে মানুষ অবধি পৌঁছানোর প্রয়াসের নামই প্রদর্শনী। শিল্পীর কাজ জনসাধারণ অবধি পৌঁছানোতেই এর সার্থকতা। সাম্প্রতি শেষ হয়ে গেল তরুণ প্রাণের উচ্ছ্বাসে বর্ণিল হয়ে ওঠা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদের ছাপচিত্র বিভাগের বার্ষিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী।
×