ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গারোদের সামাজিক বন্ধন

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ১০ জুন ২০১৬

গারোদের সামাজিক বন্ধন

গারো সমাজ কাঠামোতে রয়েছে নারীর স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য। তারা ঘরে ও মাঠে দারুণভাবে কাজ করে। গারোদের জীবন-জীবিকা এখনো কৃষিনির্ভর এবং এতে গারো নারীদের বিশেষ ভূমিকাই প্রধান। পাহাড় ও মাঠ থেকে ফসলসহ নানা কিছু সংগ্রহ করে জোঙ্গায় গাছের ছাল বেঁধে তা কপালে ঝুলিয়ে মাইলের পর মাইল পথ বেয়ে চলে গারো নারী, এ দৃশ্য সত্যিই কষ্টকর ও চমকপ্রদ। যা প্রমাণ করে গারো নারীদের কষ্টসহিষ্ণুতা। জুমচাষেও রয়েছে নারীর একচ্ছত্র সহযোগী ভূমিকা। বাংলাদেশের গারো অধ্যুষিত অঞ্চলে পাহাড় ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় জুম চাষ তেমন না হলেও কৃষির সমস্ত কাজেই নারীরা অধিক পরিশ্রম করে থাকে। এছাড়া ঘর গৃহস্থালি, বাজারঘাট, সন্তান লালন পালন, চাকরি, ব্যবসা, নদী ও খনি থেকে কয়লা ও পাথর উত্তোলন, কুুটির শিল্প, এনজিও কার্যক্রম, সংগঠন পরিচালনা, সামাজিক কার্যক্রম এবং পরিবার পরিচালনায় গারো নারীরা একচ্ছত্র ভূমিকা পালন করে থাকে। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে নতুন ঋতুর উপকরণের খুঁজেও ব্যস্ত থাকে গারো নারী। পুরুষরা অনেকটা অলস জীবন যাপন করে থাকে। গারো সমাজ মাতৃতান্ত্রিক। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কারণে মেয়েরাই ভূসম্পত্তির অধিকারী হয়। কারো মেয়ে সন্তান না থাকলে বোনের মেয়ে উত্তরাধিকার হয়। গারোরা ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের ব্যক্তিসত্তার অধিকারী মনে করে না। গারো সমাজে মনোগামী বিবাহরীতি অধিক লক্ষণীয়। প্যারালাল কাজিন বিবাহ নিষিদ্ধ তবে ক্রস কাজিন বিবাহ অনুমোদিত রয়েছে। নৃবিজ্ঞানী ফ্রেডরিক এঙ্গেলস দু’শ’ বছর আগে গারোদের মাতৃসূত্রীয় ধারার কথা উল্লেখ করেছেন। জন্মনির্ধারকের বিষয় মায়ের দিক থেকেই একমাত্র সুনিশ্চিত। একটি স্তরের পূর্ব পর্যন্ত মানুষের মধ্যে বিয়ের ধারণা ছিল না। নারী পুরুষের মধ্যে অবাধ মেলামেশা ছিল। ফলে সন্তানদের পিতৃত্ব নির্ধারণ করাও কঠিন ছিল তখন মায়ের পরিচয়ে সন্তান বড় হতো। সন্তানের সঙ্গে মায়ের শারীরিক যোগসূত্র এবং পরবর্তী সময়ে পিতার সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক তৈরি হয়। পিতার সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি সামাজিকভাবে অনেক পরে স্বীকৃত হয়েছে। মাতৃসূত্রীয় সম্পর্কে জানা যায় যে, একে অপরের সঙ্গে অথবা গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকত। এতে অনেক পুরুষের মৃত্যু হতো ফলে সম্পত্তির মালিকানায় সমস্যা তৈরি হতো। নারীরা ঘরে থাকত এবং দূরে কোথায় যাবে না ফলে বাড়িতে থেকে সম্পত্তি দেখাশোনা করে রাখতে পারবে, এজন্য নারীকে সম্পত্তির মালিকানা দেয়া হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায় একপর্যায়ে এসে ভাই বোনদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ হয়। সে সময় থেকেই গোষ্ঠীর রূপান্তর ঘটে এবং গোত্র তৈরি হয় এবং মায়ের দিক দিয়ে রক্ত সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়ের সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠী গড়ে ওঠে যাদের নিজেদের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ হয়। ক্রমান্বয়ে সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে সাধারণ প্রতিষ্ঠান মারফত সংহতি তৈরি হয় এবং একই জাতির অন্যান্য গোত্র থেকে পৃথক হয়ে ওঠে। গারো সমাজেও এ অবস্থা থেকে মাতৃসূত্রীয় ধারা অব্যাহত থাকে। নারীর দিক থেকে আত্মীয়তা নির্ধারিত হয়। গোত্রের নাম, সামাজিক ও রাজনৈতিক পদবী মায়ের দিক থেকে হয়। তিন প্রজন্মের নারীদের নিয়ে মাতৃক্ষেত্র তৈরি হয়। মায়ের বংশ সকল স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির মালিক হয়। গারো সমাজ কাঠামোর উল্লেখযোগ্য দিক ‘মাহারীবাদ’। মাহারীর কর্তৃত্বে পরিবার পরিচালিত হয়। মাহারীবাদ মাতৃতান্ত্রিক সমাজের পরিচয় বহন করে। তাই সন্তানরা মায়ের চাটটি (ঝবঢ়ঃ) ও মাহারী (গড়ঃযবৎযড়ড়ফ) এর পরিচয়ে বড় হয় এবং মায়ের বংশ ও পদবীর মাধ্যমে তারা পরিচিত হয়। মাতৃসূত্র রীতিতেই তারা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। পরিবারের সম্পত্তি যাতে বাইরে না যায় এজন্য মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ধরে রাখা হয়েছে। মেয়েরা মায়ের সকল সম্পত্তির অধিকারী হয়। পুরুষরা কোন সম্পত্তির মালিক হয় না। তাকে সম্পত্তিহীনভাবে জীবন কাটাতে হয়। মাতৃতান্ত্রিক উত্তরাধিকারে ছোট মেয়ে মায়ের সকল সম্পত্তির মালিক হয়। ছোট মেয়ে নকনা নামে পরিচিত। তাঁর স্বামীকে বলা হয় নকরম। ছোট মেয়ের কদর সবচেয়ে বেশি। নকনার স্বামী হওয়া সৌভাগ্যের বিষয়। ছেলেরা বিয়ের পূর্বে মায়ের সম্পত্তির প্রতি আগ্রহ দেখায় না। সম্পত্তির মালিকানা ভবিষ্যতে বোনের হাতে বর্তাবে এই ভেবে অমনোযোগী থাকে। স্ত্রীর মৃত্যু ঘটলে অনেক সময় বিপতœীক স্বামীকে রিক্ত হস্তে গৃহত্যাগ করতে হয়। তাই পুরুষরা সংসারে তেমন মনোযোগী হয় না। বোন ভাইয়ের কাজের অবহেলা এবং অপব্যয় সহ্য করতে চায় না। তাই ভাইকে বিয়ে দেয়ার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে। ছেলে ঘরজামাই হয়ে চলে গেলে মেয়েরা নিজেদের ইচ্ছেমত সংসার সাজায়। পুরুষ স্ত্রীর সম্পত্তির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করে। তিনি স্ত্রীর অনুমতিক্রমে কাজ করে থাকেন। তবে যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। গারো সমাজে একই মাহারীর পুরুষ ও মহিলার বিবাহ নিষিদ্ধ। কারও স্বামী মারা গেলে স্ত্রীর জন্য নতুন বর নির্ধারণের ক্ষেত্রে মাহারীর লোকেরা দায়িত্ব পালন করে। এ প্রথাকে আখম প্রথা বলে। বিপতœীক বা বিধবা কেউ নিজের খেয়াল খুশি মতো বিয়ে করতে পারে না। তাদের সমাজ ব্যবস্থা এখনও টিকে রয়েছে জাতি ব্যবস্থায়। সন্তান পিতার জ্ঞাতি ব্যবহার না করে মায়ের জ্ঞাতি ব্যবস্থা অনুসরণ করে। মায়ের ভাই পিতার সামাজিক দায়িত্ব পালন করে। পিতা নিজ সন্তানের চেয়ে বোনের সন্তানের দায়িত্বের প্রতি বেশি মনোযোগী হয়। বর্তমানে গারো সমাজে পুরুষতন্ত্রের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মাতৃতান্ত্রিকতায় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং খ্রীস্টান চার্চের প্রধানদের সিদ্ধান্ত পুরুষরাই নিচ্ছেন। ধর্মীয় এবং নৈতিক সিদ্ধান্ত অনেকাংশেই ফাদারা দিয়ে দিচ্ছেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণে গারো নারীদের ভূমিকা কমে যাচ্ছে। তবে পরিবারের কথা যাতে বাইরের লোক না জানতে পারে সে ক্ষেত্রে বয়স্ক নারীদের আমলে আনা হচ্ছে। প্রতিটি গারো পরিবার একেকটি যৌথ পরিবার তাই ছেলেমেয়ে শ্বশুর-শাশুড়ী, স্বামী-স্ত্রী, দাদু-দিদিমা নিয়ে পরিবার গঠিত। বর্তমানে গারোদের মধ্যে যৌথ পরিবার থাকছে না। শিক্ষার প্রসার, জীবিকার পরিবর্তন, প্রবল ব্যক্তিস্বার্থ প্রভৃতির ফলে যৌথ পরিবার ভেঙে গেছে। শুধুমাত্র স্বামী, স্ত্রী সন্তান নিয়ে পরিবার গঠিত হচ্ছে। কোথাও কোথাও শ্বশুর শাশুড়ীও একক পরিবারে স্থান পাচ্ছে না। আজ থেকে পাঁচ-ছয়শত বছর আগে গারোরা পিতৃতান্ত্রিক ছিল। বড় ছেলে সম্পত্তির মালিক হতো। ছেলেরা বিয়ের পর চলে যাওয়ায় এক গোষ্ঠী/পরিবারের সম্পত্তি আরেক গোষ্ঠী/পরিবারে চলে যেত। সম্পত্তি ও সত্তা রক্ষা করার জন্যই তখন গারোরা সমাজের ধরন পরিবর্তন করে মাতৃসূত্রীয় ব্যবস্থায় নিয়ে আসে। বর্তমানে নানা পরিবর্তনশীলতার কারণে মেয়েরা বিবাহ করে স্বামীর বাড়িতে চলে যাচ্ছে এতে অনেকেই যৌতুকও গ্রহণ করছে। বিজ্ঞানী হেনরী মেইনের মতে পুরুষতান্ত্রিকতা সমাজের সার্বজনীন এবং মৌলিক একক। গারো সমাজে এর প্রভাব পড়েছে। ফলে গারো সমাজ এখন নানাভাবে চলছে। সবাই এখন নিজ নিজ চিন্তা করছে তাই আর আগের মত সবকিছু করা সম্ভব হচ্ছে না। গারো সমাজের আশপাশে বাঙালী সমাজ ঢুকে পড়ায় প্রভাব পড়ছে। নিরাপত্তাহীনতার কারণে পুরুষরা পেশী শক্তি দিয়ে বাইরে মোকাবেলা করছে ফলে তারাই পরিবারের প্রধান হয়ে উঠছে। এখন সবাই গোত্রভিত্তিক একসঙ্গে থাকতে পারছে না ফলে গারো অধ্যুষিত এলাকাও আর থাকতে পারছে না। শিক্ষিত গারো ছেলেমেয়েরা বাইরের সংস্কৃতির সঙ্গে মিল রেখে মায়ের পরিবর্তে বাবার টাইটেল ব্যবহার করছে। ছেলেরা ঘরজামাই হতে চাচ্ছে না। গারো সমাজের নানা রীতি পরিবর্তনের ফলে নারীর ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। বাঙালী পরিবারে মেয়েদের বিবাহ, মিশনারী তৎপরতা ও বাঙালীদের আগমনের ফলে গারো নারীদের ক্ষমতা দিন দিন খর্ব হচ্ছে। নারীরা বহির্মুখী হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু হারিয়ে ফেলছে নিজেদের আদি ক্ষমতা। এক সময় গারো নারীরাই পুরো সংসার সামাল দিত। পুরুষরা অলস জীবন-যাপন করত। এতে কর্তৃত্ব থাকত নারীদের কাছে। বাঙালী সমাজে নারী অধিকারের জন্য আন্দোলন করতে হলেও হাজার বছর পূর্বেই গারো সমাজে নারীকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে এজন্য তাদের কোন আন্দোলন করতে হয়নি। সমাজব্যবস্থার কারণেই গারো নারী ক্ষমতার উৎস। আজকের দিনে ছেলেরা বাইরের জগত এবং শিক্ষিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে এই চালচিত্রে হাওয়া বদলের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে কিছু লোভী মানুষ গারো নকনাদের বিয়ে করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ক্ষমতাধর অসাধু ব্যক্তিরা গারো সমাজে প্রবেশ করে গারোদের আদি বিয়ে পদ্ধতির পরিবর্তন করেছে। অন্য ধর্মের লোকের প্রাদুর্ভাবে গারো সমাজে বিয়ের ক্ষেত্রেও ঐতিহ্যের নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে।
×