ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মূল : গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস;###;অনুবাদ : খুররম মমতাজ

আমি শুধু টেলিফোনটা ব্যবহার করতে এসেছিলাম

প্রকাশিত: ০৬:২২, ১০ জুন ২০১৬

আমি শুধু টেলিফোনটা ব্যবহার করতে এসেছিলাম

(পূর্ব প্রকাশের পর) সিগারেটের সমস্যা শুরুতেই সমাধান হয়ে গেছে। একজন মেট্রন সোনার দরে তাদের কাছে সিগারেট বিক্রি করে। তবে টাকা-পয়সা ফুরিয়ে যাওয়ার পর সমস্যাটা আবার তীব্র হয়ে দেখা দিল। কেউ কেউ সিগারেটের গোড়া কুড়িয়ে নিয়ে তা দিয়ে কাগজের সিগারেট বানিয়ে কাজ চালায়। মারিয়াও সেগুলো ফোঁকায় অভ্যস্ত হয়ে গেল। টেলিফোনের মতো সিগারেটও তার জীবনে ভীষণ জরুরী একটা জিনিস হয়ে গেছে। পরের দিকে কৃত্রিম ফুল বানিয়ে সামান্য যে ক’টা পয়সা পাওয়া যেত, তা যেন মারিয়ার কাছে সাত রাজার ধনের মতো মনে হতো। সবচেয়ে কঠিন ছিল রাতের নিঃসঙ্গতাকে মানিয়ে নেয়া। অন্ধকারে আরও অনেকের মতো সে-ও চোখ মেলে তাকিয়ে থাকত, ভয়ে নড়াচড়াও করত না, কারণ শেকল আর তালাচাবি দিয়ে বন্ধ ভারি দরজার ওপাশেই পাহারায় থাকত রাতের মেট্রন। এক রাতে দুঃখ ভরা গলায় পাশের বেডের রোগীকে শুনিয়ে শুনিয়ে সে প্রশ্ন করল : ‘এ কোথায় এলাম আমরা?’ পাশের রোগী কাতর গলায় উত্তর দিল : ‘নরকের সবচেয়ে গভীর গর্তে।’ ‘ওরা বলে এটা নাকি মুরদের দেশ।’ দূর থেকে আরেকজন বলল, বেশ জোরালো গলা তার। ‘ঠিকই বলে ওরা। গ্রীষ্মকালে আকাশে যখন চাঁদ ওঠে, কুকুরগুলো সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে চিল্লায়।’ শেকলের শব্দটা শুনে মনে হলো যেন জাহাজের নোঙর ফেলার শব্দ হচ্ছে। ভারি লোহার দরজাটা খুলে গেল। নিষ্ঠুর পাহারাদার করিডরের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত পাঁয়চারি করতে শুরু করল। এই নিঃসীম নীরবতার মধ্যে মনে হচ্ছিল যেন সে-ই একমাত্র জীবিত ব্যক্তি। ভয়ে মারিয়ার হাত-পা ঠা-া হয়ে এলো, ঠা-া হওয়ার কারণটা একমাত্র সে-ই জানে। প্রথম সপ্তাহ থেকেই রাতের মেট্রন মারিয়াকে প্রস্তাব দিয়ে আসছিল সে যেন তার সঙ্গে গার্ডরুমে ঘুমায়। লেন-দেনের বিষয়টাকে খোলাখুলি জানিয়েছিল সেÑ সিগারেট চকোলেট যা চায় সব পাবে মারিয়া, বিনিময়ে তাকে ভালবাসা দিতে হবে। ‘সব পাবে তুমি,’ কামকাতর মেট্রন তাকে বলেছিল, ‘রানীর মতো থাকবে এখানে।’ মারিয়া প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে সে ভিন্ন পথ ধরল। মারিয়ার বালিশের নিচে কিংবা পোশাকের পকেটে অথবা অন্য কোন জায়গায় ছোট ছোট প্রেমপত্র রাখতে শুরু করল। সেই পত্রে থাকত ভগ্ন হৃদয়ের দুঃখ ভরা বেদনার করুণ আর্তি, যা শুনে পাথরও গলে যাবে। এটা প্রায় মাসখানেক আগের কথা, মারিয়া ভেবেছিল সে হয়ত প্রত্যাখ্যান মেনে নিয়েছে। সবাই ঘুমিয়ে গেলে মারিয়ার বিছানার কাছে এলো মেট্রন। ওর কানের কাছে মুখ নামিয়ে কোমল সুরে অশ্লীল কথাবার্তা বলতে লাগল আর সেই সঙ্গে আতঙ্কে অসাড় হয়ে যাওয়া মারিয়ার শরীরের সর্বত্র চুমু খেতে শুরু করল। মারিয়ার অসাড়তাকে হয়ত মেট্রন নীরব সম্মতি বলে ধরে নিয়েছিল, তাই সে আরও এক ধাপ এগোলো। তখন আচমকা হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে আঘাত করল মারিয়া। প্রচ- ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পাশের বেডে গিয়ে পড়ল মেট্রন। শব্দ শুনে রোগীরা জেগে উঠল। ক্রুদ্ধ ক্ষিপ্ত মেট্রন উঠে দাঁড়াল প্রবল হৈ-চৈয়ের মধ্যে। ‘শুয়োরের বাচ্চা!’ চিৎকার দিল সে, ‘এই নরকে আমরা দুজনেই পচে মরব। তখন তুই আমার জন্য পাগল হবি।’ গ্রীষ্ম এসে গেল হঠাৎ করেই, জুনের প্রথম রবিবারে। প্রচ- গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে রোগীদের অনেকেই কাপড়-চোপড় সব খুলে ফেলতে লাগল। কানা মুরগির মতো ছোটাছুটি করছে নগ্ন রোগীরা আর তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে মেট্রনরাÑ এ রকম দৃশ্য দেখে বেশ মজাই পাচ্ছিল মারিয়া। হৈ-চৈ আর মারামারির মধ্যে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিল সে। হঠাৎ মারিয়া নিজেকে একটা ঘরের মধ্যে আবিষ্কার করল, সেখানে একটানা বেজে চলেছে একটা টেলিফোন। কোনকিছু না ভেবেই টেলিফোনটা তুলল মারিয়া। শুনতে পেল অন্য প্রান্ত থেকে মিষ্টি একটা গলা টেলিফোন কোম্পানির টাইম সার্ভিসের নকল করে বলছে, ‘এখন সময় পঁয়তাল্লিশ ঘণ্টা, বিরানব্বই মিনিট, এক শ’ সাত সেকেন্ড...।’ ‘গাধা!’ মারিয়া বললো। বেশ মজা পেয়েছে সে। টেলিফোন নামিয়ে রাখল মারিয়া। চলে যাচ্ছিল, হঠাৎ ওর মনে হলো দারুণ একটা সুযোগ নষ্ট করছে। প্রবল উত্তেজনা নিয়ে ছয়টা সংখ্যা ডায়াল করল সে, এটা যে ওর বাড়ির নম্বর সেটা যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না। ধকধক করছে বুকটা, একবার দুবার তিনবার রিং হলো। তারপর সেই মানুষটার গলা শুনতে পেল মারিয়া, যাকে সে ভালবাসে। ‘হ্যালো?’ গলার কাছে উঠে আসা ব্যথাটা সামাল দেয়ার জন্য দু’-এক মুহূর্ত সময় নিল মারিয়া। ‘লক্ষ্মী, সোনা!’ ফিসফিস করে বলল সে। টপটপ করে ঝরছে ওর চোখের জল। অন্য প্রান্তে ক্ষণিকের জন্য ভয়ঙ্কর এক নীরবতা। তারপর জ্বলন্ত একটা কণ্ঠস্বর বমির মতো উগরে দিল শব্দটা: ‘বেশ্যা!’ সেই রাতে রাগে দুঃখে ক্ষিপ্ত মারিয়া ক্যান্টিনের দেয়াল থেকে জেনারেলের ছবিটা টেনে নামাল, আছড়ে ভাঙল ওটাকে জানালার কাঁচের গায়ে তারপর রক্তে মাখামাখি হয়ে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল। মেট্রনরা ওকে ডা-া মেরে ঠা-া করতে চেষ্টা করল, কিন্তু বৃথাই। হঠাৎ ওর নজর পড়ল দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে হারকুলিনা, বুকের ওপর হাত দুটো ভাঁজ করে ওকে দেখছে তাকিয়ে তাকিয়ে। থামল মারিয়া। ভায়োলেন্ট রোগীর ওয়ার্ডে ওকে নিয়ে যাওয়া হলো। হোস পাইপ দিয়ে বরফের মতো ঠা-া পানি ছিটানো হলো ওর গায়ে, টারপেনটাইনের ইঞ্জেকশন দেয়া হলো পায়ে। মারিয়ার পা ফুলে গেল। হাঁটা বন্ধ হলো। তবু ওর মনে হচ্ছিল এই নরক থেকে পালানোর জন্য সবকিছু করতে রাজি আছে ও। পরের সপ্তাহে ওকে যখন ডরমিটরিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো, রাতের বেলা পা টিপে টিপে ও গেল নাইট মেট্রনের ঘরের সামনে, নক করল দরজায়। প্রথমেই শর্ত করে নিল মারিয়া। ওর স্বামীকে খবর পাঠাবে মেট্রন। মেট্রন রাজি হলো। শুধু বলল ওদের সম্পর্কটাকে গোপন রাখতে হবে। আঙ্গুল তুলে ওকে শাসালো মেট্রন : ‘কেউ যদি জানে, খুন করবো তোমাকে।’ সুতরাং পরদিন স্যাটুর্নো দি ম্যাজিশিয়ান তার ভ্যানে চড়ে মহিলাদের পাগলা গারদে হাজির হলো। ডিরেক্টর নিজে ওকে রিসিভ করলেন তার অফিসে। অফিসঘরটা যুদ্ধজাহাজের মতো ছিমছাম পরিষ্কার। ডিরেক্টর স্যাটুর্নোর স্ত্রী সম্পর্কে ভাল ভাল কথা বললেন। বললেন সে যখন আসে, কেউ জানত না কোত্থেকে এলো সে, কিভাবে এলো। অনেক চেষ্টা করেও এই বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। বিস্মিত ডিরেক্টর সাহেব জানতে চাইলেন স্যাটুর্নো কিভাবে তার স্ত্রীর খবর পেল? মেট্রনের কথা ফাঁস করলো না স্যাটুর্নো। ‘ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি আমাকে খবর দিয়েছে,’ বলল সে। স্যাটুর্নোর জবাব শুনে সন্তুষ্ট হলেন ডিরেক্টর। ‘সত্যি, অবাক হতে হয়,’ মন্তব্য করলেন তিনি, ‘কোত্থেকে যে খবর জোগাড় করে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো!’ মনোযোগ দিয়ে মারিয়ার ফাইলটা দেখলেন ডিরেক্টর, তারপর আবার মন্তব্য করলেন : ‘ওনার কন্ডিশন সত্যি খুব খারাপ।’ তারপর আশ্বাস দিলেন দেখা-সাক্ষাতের ব্যবস্থা তিনি করে দেবেন যদি স্যাটুর্নো কথা দেয় ডিরেক্টর সাহেব যেভাবে বলবেন সেভাবেই সে তার স্ত্রীর সঙ্গে কথাবার্তা বলবে। এ বিষয়ে কোন রকম প্রশ্ন করা চলবে না, এটা তার স্ত্রীর ভালর জন্যই। এই সাবধানতাটুকু খুব জরুরী, কেননা তার স্ত্রী ইদানীং খুব ঘন ঘন ভায়োলেন্ট আচরণ করছে। ‘আশ্চর্য তো!’ অবাক হলো স্যাটুর্নো। ‘ও বরাবরই একটু রাগী ছিল, কিন্তু সেটা কখনও প্রকাশ করত না।’ ডাক্তার সবজান্তার মতো মাথা নাড়তে লাগলেন। ‘সুপ্ত থাকে,’ বললেন তিনি। ‘বহু বছর সুপ্ত থাকে, তারপর হঠাৎ একদিন বিস্ফোরণ ঘটে। যাই হোক, এখানে এসে ওনার জন্য ভালই হয়েছে। এরকম রোগীর চিকিৎসা করাই আমাদের কাজ। এ বিষয়ে আমরা এক্সপার্ট।’ তারপর টেলিফোনের প্রতি মারিয়ার যে বিশেষ আকর্ষণ আছে সে ব্যাপারেও তিনি স্যাটুর্নোকে সাবধান করে দিলেন। সবশেষে বললেন, ‘ওকে ভাল ভাল কথা বলবেন, হাসিখুশি রাখবেন।’ ‘ঠিক আছে, চিন্তা করবেন না ডাক্তার,’ স্যাটুর্নো বলল, ‘এই বিষয়ে আমি একজন এক্সপার্ট।’ ভিজিটিং রুমটা বেশ বড়, মাঝখানে একটা টেবিল, টেবিলের ওপর শূন্য ফুলদানি, দুই পাশে দুটো চেয়ার। টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে মারিয়া। স্বামীকে দেখে সে যে খুব উৎফুল্ল হয়ে উঠল তা নয়। তবে ওকে দেখে মনে হচ্ছিল হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া। স্ট্রবেরি রঙের কোটটা পরে আছে সে, পায়ে হাসপাতাল থেকে দেয়া বিশ্রী একজোড়া জুতা। হারকুলিনা এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে এক কোণায়, তাকে প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। স্বামীকে দেখেও নড়ল না মারিয়া, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, জানালার কাঁচ লেগে কেটে যাওয়া মুখে আবেগের কোন চিহ্ন নেই। যন্ত্রের মতো চুমু খেল ওরা একে অন্যকে। ‘কেমন আছ?’ স্যাটুর্নো জিজ্ঞেস করল। ‘খুব খারাপ,’ মারিয়া জবাব দিল, ‘তোমাকে দেখে খুব ভাল লাগছে, সোনা।’ চেয়ারে বসল না ওরা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই দুই চোখে জল নিয়ে স্বামীকে জানাল মারিয়া হাসপাতালের জঘন্য পরিবেশের কথা, মেট্রনদের নিষ্ঠুরতার কথা, খাবারের কথাÑ যে খাবার কুকুরেও খাবে না। বলল নির্ঘুম রাত্রির আতঙ্কের কথা। ‘জানি না কতদিন এখানে আছি আমি, কত মাস কত বছর। শুধু এটুকু জানি প্রত্যেকটা দিন এসেছে আগের দিনের চেয়েও ভয়াবহ হয়ে,’ গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মারিয়া বলল, ‘আর কখনই আমি আগের আমি হয়ে উঠতে পারব না।’ ‘তোমার কষ্টের দিন শেষ হয়ে গেছে,’ আদর করে ওর মুখে আঙ্গুল বুলাতে বুলাতে বলল স্যাটুর্নো। ‘প্রতি শনিবার আমি আসব। যদি ডিরেক্টর সাহেব অনুমতি দেন, তাহলে অন্য দিনও আসব। সব ঠিক হয়ে যাবে, তুমি দেখ।’ ভয়ার্ত চোখ দুটো মেলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল মারিয়া। স্যাটুর্নো ওকে মিষ্টিমধুর ভঙ্গিতে বোঝাতে লাগল। বলতে লাগল ডাক্তারের শিখিয়ে দেয়া কথাগুলো। ‘আর ক’টা দিন,’ বলল সে। ‘পুরোপুরি ভাল হতে আর মাত্র ক’টা দিন লাগবে তোমার।’ ব্যাপারটা বুঝতে পারল মারিয়া। ‘কি বলছ তুমি সোনা!’ অবাক বিস্ময়ে বলল মারিয়া, ‘তুমিও কি বিশ্বাস কর আমি পাগল হয়ে গেছি?’ ‘কি যে বলো?’ হাসতে চেষ্টা করল জাদুকর। ‘আমি বলি কি আর কয়েকটা দিন তুমি এখানে থাকো। এটা আমাদের ভালোর জন্যই। আগের চেয়ে অনেক ভালো পরিবেশে থাকবে তুমি।’ ‘কিন্তু আমি তো তোমাকে বললাম, শুধু টেলিফোনটা ব্যবহার করতে এসেছিলাম আমি।’ মারিয়া বলল। ডাক্তারের সাবধানবাণী মনে পড়ল স্যাটুর্নোর...টেলিফোনে আসক্তি...। কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না জাদুকর। অসহায়ের মতো সে হারকুলিনার দিকে তাকাল। এই সুযোগে হারকুলিনা ইঙ্গিতে হাতের ঘড়িটা দেখিয়ে বুঝিয়ে দিল সময় শেষ। মারিয়ার চোখে পড়ে গেল ইঙ্গিতটা, ও বুঝতে পারল হারকুলিনা মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছে ওকে আক্রমণের জন্য। স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরল মারিয়া, তারপর পাগলের মতো চ্যাঁচাতে লাগল। যতটা কোমলভাবে সম্ভব নিজেকে ছাড়িয়ে নিল স্যাটুর্নো, হারকুলিনার হাতেই ওকে ছেড়ে দিল। পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল হারকুলিনা। মারিয়া কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওকে বাঁ হাতের বজ্র আঁটুনিতে আটকে ফেলল, চিৎকার করে স্যাটুর্নোকে বলল : ‘পালাও!’ ভয়ে পালিয়ে গেল স্যাটুর্নো। প্রথম সাক্ষাতের ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠে পরের শনিবার আবার সে স্যানাটরিয়োমে এলো। সঙ্গে বিড়ালটাকেও নিয়ে এলো। বিড়ালটাকে জাদুকর ঠিক নিজের মতোই পোশাক পরিয়ে এনেছেÑ গ্রেট লিওতার্দো যেমনটা পরতেন লাল-হলুদ টাইটস, টুপি আর এমন এক চাদর যা দেখে মনে হয় উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই ওটা তৈরি করা হয়েছে। পাগলা গারদের উঠানে ভ্যানটাকে দাঁড় করাল স্যাটুর্নো। তারপর সেখানে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে দারুণ এক শো দেখাল। ব্যালকনি থেকে রোগীরা শোটা উপভোগ করল। হঠাৎ করেই ওরা চিৎকার দিয়ে উঠছিল অথবা অকারণেই হঠাৎ তালি বাজাতে শুরু করছিল। সবাই ওখানে ছিল, সব রোগী, শুধু মারিয়া ছিল না। মারিয়া জানিয়ে দিয়েছিল স্বামীর সঙ্গে সে দেখা করবে না, এমনকি ব্যালকনিতে এসেও সে দাঁড়ায়নি। স্যাটুর্নোর আত্মাভিমানে প্রচ- আঘাত লাগল। ‘এমন আচরণ খুবই স্বাভাবিক,’ সান্ত¡¡না দিলেন ডিরেক্টর, ‘শীঘ্র ঠিক হয়ে যাবে।’ কিন্তু ঠিক হলো না। বার বার চেষ্টা করল স্যাটুর্নো দেখা করার, শেষে একটা চিঠি পৌঁছাতে চেষ্টা করল মারিয়ার কাছে। কিন্তু বৃথা। চারবার চিঠি ফিরিয়ে দিল মারিয়া, কোন মন্তব্যও করল না, কিছুই না। হাল ছেড়ে দিল স্যাটুর্নো। তার পরও সে পোর্টারের অফিসে মারিয়ার জন্য সিগারেট রেখে গেল বহুদিন, অবশ্য সিগারেটগুলো মারিয়া পাচ্ছে কিনা সেটা জানার কোন চেষ্টা সে করেনি, তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটাও একদিন থেমে গেল। এরপর স্যাটুর্নোর কি হলো তা আর জানা যায়নি, শুধু জানা গেছে সে আবার বিয়ে করেছে, তারপর নিজের দেশে চলে গেছে। যাওয়ার আগে বিড়ালটাকে দিয়ে গেছে এক বান্ধবীর কাছে। কথা ছিল সেই বান্ধবীই মারিয়াকে সিগারেট পৌঁছে দেবে। একদিন বান্ধবীও হাওয়া হয়ে গেল। রোসা রেগাসের মনে আছে তাকে একবার দেখেছিল প্রায় বারো বছর আগে, কর্তে ইঙ্গলেস ডিপার্টমেন্ট স্টোরে। পাশ্চাত্য ভিক্ষুদের মতো কমলা রঙের আলখাল্লা পরে ছিল অন্তঃসত্ত্বা মহিলাটি, তার মাথাও ছিল ন্যাড়া। সে-ই রোসাকে জানায় মারিয়ার জন্য সে ঘন ঘনই সিগারেট নিয়ে গেছে যত দিন সম্ভব, এমনকি দু’-একবার জরুরী প্রয়োজনে তাকে সাহায্যও করেছে। তারপর একদিন গিয়ে দেখে হাসপাতালটা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে, পড়ে আছে শুধু একরাশ ধ্বংসস্তূপ, অতীতের বিষণœ স্মৃতির মতো। শেষবার সাক্ষাতের সময় মারিয়াকে বেশ সহজ স্বাভাবিক মনে হয়েছে তার, কিছুটা ওজনও বেড়েছিল মারিয়ার, আর ওকে দেখে বেশ সুখীই মনে হচ্ছিল। সেদিনই মারিয়াকে বিড়ালটা দিয়ে দিয়েছে মহিলা, কেননা বিড়ালের জন্য যে টাকা দিয়েছিল স্যাটুর্নো, তা ফুরিয়ে গিয়েছিল। (শেষ)
×