ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পুরাণের তপোবন এবং রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ ভাবনা শামসুদ্দোহা চৌধুরী

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ১০ জুন ২০১৬

পুরাণের তপোবন এবং রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ ভাবনা শামসুদ্দোহা চৌধুরী

জোড়াসাঁকোর প্রাসাদোপম অট্টালিকায় বসবাস করা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের পরাণের গহীনে মহাকবি কালিদাসের গুপ্ত যুগের উজ্জয়িনী নগরে নির্বাসনের করুণ চেহারা রেখাপাত করত। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘সবার মাঝে আমি ফিরি একেলা, কেমন করে কাটে সারাটা বেলা ইটের পর ইট মানুষ মাঝে কীট-নাইকো ভালবাসা, এ কেমন তরো খেলা’ এ কথা তো রবীন্দ্রনাথের নিজ মনের কথা। শতাধিক বছর আগে পরিবেশ চিন্তা-ভাবনায় আধুনিক ধ্যান-ধারণার কথা তিনি অনুভব করেছেন, চিন্তা-চেতনায়, মনন-মানসে ধারণ করেছেন, ভোগবাদী মানুষের অপরিকল্পিত চিন্তাধারায় ইটের পর ইটের সাজানো সৌধমালায় তো মানুষ কীটের মতোই বসবাস করছে। আজ আমরা পরিবেশবাদীরা ফিরায়ে দাও অরণ্য লও হে নগরের যে সেøাগান তুলে মানুষকে প্রকৃতির দিকে ধাবিত করার চেষ্টা করছি, সেই প্রকৃতি, কালিদাসের উজ্জয়িনী নগরীর পাশে দীর্ঘ নিবিড় তপোবন, শান্তি-প্রশান্তময় আশ্রমের কথা রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন আগেই। ভোগবাদী মানুষ জানে না অথবা বুঝতে পারে না সম্পদ এবং প্রাচুর্য নিজ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য প্রকৃতি নিধন করে যে নগর নির্মাণ করে সে সম্পদ ও স্বাচ্ছন্দ্যের ভারে চাপা পড়ে যায় মাটি ও মানুষের চিরন্তনী শেকড়। মানুষ নিজকে সফল ও প্রাচুর্যময় ভাবলেও প্রকৃতপক্ষে সে কিন্তু নির্বাসিত হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ এই নির্বাসনের যন্ত্রণা অনুভব করেছিলেন বলেই পুরাকালের মুণী ঋষীদের নির্জন আশ্রম, নিবিড় বনরাজি এবং তপোবনের কাছে বারে বারে ফিরে গিয়েছেন। স্নেহধন্য ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বীরভূমের শালবনে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে কৈশোরের স্বপ্নের দায়দেনা কিছুটা হলেও মিটায়েছেন, অন্যদিকে তার নিগূঢ় মনে নির্বাসনের যন্ত্রণা লাঘব করার জন্য তাঁর পিতৃপুরুষের সৃষ্ট ব্রহ্মাচার্য্য আশ্রমকে প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্যের মাঝে ঠাঁই করে দিয়েছেন। পরবর্তীকালে তাঁর স্বপ্নের মানসভূমি গড়ে ওঠে শ্রীনিকেতন-শান্তিনিকেতন। এই যে প্রকৃতি থেকে নির্বাসন। এই নির্বাসনের সংজ্ঞা রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন এইভাবে ‘রাশি রাশি সম্পদ এবং স্বাচ্ছন্দ্যকে যোগাতে গিয়ে মানুষ তার পশ্চাৎ পটটিকে খুইয়েছে। আদিকাল থেকে এখন পর্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যের পেছনে ফেলে আসা খোয়ানো নির্যাস বা উচ্ছিষ্টতা হলো প্রকৃতি।’ রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় সে সময়ের প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা প্রকৃতি ধ্বংসের ভয়াবহতার কথা আঁচ করতে পারেনি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর দীর্ঘ জীবনের প্রবাহে, লেখালেখিতে প্রকৃতির মধ্যে নিমগ্ন থেকে বেঁচে থাকার কথা বলেছেন। কবি হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর দৃষ্টিনিবদ্ধ হয়েছে পুরাণের কাব্য ও নাটকের দিকে। সেখানে তিনি নিজ জীবনের শেকড়ের ছবি বার বারই খুঁজে পেয়েছেন ‘মানুষকে বেষ্টন করে এই যে জগত প্রকৃতি আছে এ অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে মানুষের সকল চিন্তা ও সকল কাজের সঙ্গে জড়িত হয়ে আছে। এই যে প্রকৃতি আমাদের মধ্যে নিত্যনিয়ত কাজ করছে অথচ দেখাচ্ছে যেন সে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে যেন আমরাই সব মস্ত কাজের লোক আর সে নিতান্তই একটা বাহানা মাত্রÑ এই প্রকৃতিকে আমাদের দেশের কবিরা ভাল করেই চিনে নিয়েছেন। এই প্রকৃতি মানুষের সমস্ত সুখ-দুঃখের মধ্যে যে অনন্তের সুরটি মিলিয়ে রাখছে সে সুরটি আমাদের দেশের প্রাচীন। কবিরা তাদের কবিতার মাঝে সর্বদাই বাজিয়ে রেখেছেন।’ রবীন্দ্রনাথের ধর্মচিন্তা এবং প্রকৃতি চিন্তার মাঝে কোন তফাত ছিল না। প্রকৃতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের আরেকটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য ‘মানুষের লোকালয় জনারণ্য যদি একান্তই মানবময় হয়ে ওঠে এর ফাঁকে ফাঁকে প্রকৃতি যদি কোনমতেই প্রবেশাধিকার না পায় তবে মানুষের সর্বক্ষণিক ধ্যান-ধারণা, সাংসারিক কাজকর্ম অতি তাড়াতাড়ি কলুষিত ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে নিজের অতল স্পর্শ আবর্জনার মধ্যে আত্মহত্যা করে।’ রবীন্দ্রনাথ স্বভাবতই বিশ্ব দৃষ্টির অসুস্থতার কথা বলেছেন। যেখানে মানুষ প্রকৃতির বিশাল অবদানের কথা ভুলে গিয়ে নিজের সঙ্কীর্ণ জৈব ভোগ-লালসা স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভাবছে। কিংবা বড়জোর এক সীমাবদ্ধ মানব জীবনের কথা ভাবছে। মানুষ সব কিছু ছাড় দিলেও প্রকৃতির বিষয়টিকে কেন জানি ছাড় দিতে চাচ্ছে না। প্রকৃতি নিধনকে ছাড় দিতে মানুষ কেন জানি নারাজ। এই ভোগবাদিতার পেছনে ফেলে আসা প্রকৃতি নামক জঞ্জাল বা আবর্জনার যে কত অপরিসীম মূল্য তা এখন এই সভ্যতার মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পেলেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর সারা জীবনের জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে তা অনুভব বা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এই অনুভব উপলব্ধির ফলশ্রুতিতে ঋতুবৈচিত্র্যের লীলাখেলায় তিনি তাঁর পবিত্র আশ্রম ‘শান্তিনিকেতনে’ উদযাপন করেছিলেন ষড়ঋতুর বহু রৈখিক প্রকৃতি উৎসব। উদযাপন করেছিলেন শান্তি নিকেতনে ‘বৃক্ষরোপণ’ উৎসব। চিন্তাবিদ গুডম্যান বলেছেন ‘প্রকৃতি হলো একটি সম্মিলিত নির্মাণ পরিবেশ, সে জিনিস শুধু ইট-কাঠ দিয়ে তৈরি হয় না, তার পেছনে থাকে একটা গোটা সমাজের আশা-আকাক্সক্ষা। এই সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে গোড়াতেই গলদ থাকে সব কিছুকে ছাপিয়ে যদি ভোগ-লালসাই প্রাধান্য পেয়ে যায় সেখানে ইটের পর ইট সাজিয়ে আবর্জনার আতিশয্য হবে, তার মধ্যে মানুষ কীট ঢাকা পড়ে মরবে তাই তো স্বাভাবিক।’ প্রজন্মকে উদ্দেশ করে রবীন্দ্রনাথ সদাই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন ‘আমাদের প্রকৃতিকে শাসিয়ে, প্রভুত্ব করা নয়, প্রকৃতিকে ভোগ করে নয়, প্রকৃতির সঙ্গে সম্মিলনী ঘটাতে হবে নিজেদের একাত্ম হতে হবে।’ যে বিষয়টি আমরা আদিবাসী সংস্কৃতিতে দেখি। অরণ্যচারী আদিবাসীরা যেমন অরণ্য থেকে নিজেদের জীবন নির্বাহের সব কিছু আরোহণ করে যাতে তাদের প্রয়োজনও মিটে আবার অরণ্যেরও যাতে ক্ষতি না হয়। অরণ্য সংরক্ষণের মূলনীতি হবে এটাই। বোলপুরের উন্মুক্ত প্রান্তরে রবীন্দ্রনাথ পিতার কাছ থেকে যে আশ্রমটি পেয়েছিলেন, তার চারদিকে ঘিরে আছে বিশাল আকাশ তালতমালঘেরা ছায়া মায়াময় অপূর্ব এক নিসর্গ ভূমি। জীবনের অর্ধেকটা সময় ব্যয় করেছিলেন এই আশ্রমটিকে পুরাণের তপোবনের কল্পিত আশ্রমে ফুটিয়ে তুলতে। অর্থাভাবে তাঁর কাজ থেমে থাকেনি। বরং নিজ মনোভূমের প্রকৃতিবিষয়ক চিন্তা-চেতনার পরাণের গহীনের ফল্গুধারায় অবগাহন করে আশ্রমকে করেছেন প্রকৃতির এক নৈসর্গিক লীলাভূমি। ১৯০৯ সালে ‘তপোবন’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেন প্রাচীন ভারতবর্ষে দেখতে পাই অরণ্যের নির্জনতা, মানুষকে অভিভূত করেনি, বরং তাকে এমনি একটি শক্তি দিয়েছিল সেই অরণ্যবাসিনী মৃত সভ্যতার ধারা সভ্যতা ভারতবর্ষকে অভিষিক্ত করে দিয়েছে আজ পর্যন্ত তার প্রবাহধারা বন্ধ হয়ে যায়নি’ পুরাণের তপোবনের আদলে শান্তিনিকতেন গড়তে চেয়েছেন। তাঁর নিজ বাড়ি উদীচী, শ্যামলী, কোনার্কের স্থাপত্য এবং প্রকৃতির নিসর্গ নির্বাচনে পুরাণের সঙ্গে আধুনিকতার এক উজ্জ্বল সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। যেখানে আকাশ, সূর্য, চন্দ্র, বাগান, বাগিচা ছিল দৃষ্টি সীমানায়। শুধু বাড়ি নির্মাণেই নয়, নিজ বাড়ির প্রাচীরকে প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর মনোরম পেন্টিংয়ে সুসজ্জিত ও সুবিন্যস্ত করেছিলেন। অন্তরের টানে প্রিয় বন্ধু বৃক্ষকে নিয়ে করেছেন ‘বৃক্ষরোপণ উৎসব’ বলেছেন ‘প্রকৃতিকে নিধন করে প্রকৃতিকে যে কষ্ট আমরা দেই, বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে সে কষ্ট এবং যন্ত্রণার কিছুটা হলেও প্রায়শ্চিত্ত করি।’ পার্সিভ্যাল গুডম্যানের ভাষায় ‘নির্মিত পরিবেশের ইট কাঠকে বলেছেন মানুষের রাষ্ট্রিক সামাজিক তথা নৈতিক সংস্কৃতির এক ঘনীভূত চেহারা।’ রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন ‘আকাশ তো সবখানেই আছে আমরা যেন আকাশের বিশালাত্বকে ইট কাঠের সৌধের আড়ালে আড়াল না করে ফেলি।’ কৌম কৃষি শাশ্বত বাঙালিয়।া নামে ধরে রাখতে তিনি ১৯২৫ সালে উদযাপন করলেন ‘হলকর্ষণ উৎসব’ ‘ধরা বিজয়ের কেতন উড়াও’ গানটি সেবারই প্রথম গাওয়া হয়। ১৯২৮ সালে বর্ষা মঙ্গলের অনুষঙ্গ উৎসবের পাশাপাশি ‘বৃক্ষরোপণ’ উৎসব শুরু করেন। পুত্রবধূ প্রতিমাদেবীকে লেখা এক চিঠিতে কবি বৃক্ষরোপণের বিবরণ দিয়েছেন এখানে হল বৃক্ষরোপণ, শ্রীনিকতনে হলো হলকর্ষণ। তোমার টবের বকুল গাছটিকে নিয়ে বৃক্ষরোপণের উৎসব অনুষ্ঠিত হলো। পৃথিবীতে কোন গাছের এমন সৌভাগ্য আছে কীনা তুমি হয়ত কল্পনা করতে পারবে না। সুন্দরী বালিকারা শাঁখ বাজাতে বাজাতে, গান গাইতে গাইতে গাছের সঙ্গে যজ্ঞক্ষেত্রে এলো শাস্ত্রীমশাই (বিধুশেখর শাস্ত্রী) সংস্কৃত থেকে শ্লোক আওড়ালেন আমি একে একে ছটি কবিতা পড়লুমÑ মালা দিয়ে ধুপধুনো জ্বালিয়ে অভ্যর্থনা হলো।... তারপর বর্ষামঙ্গল গান হলো আমি এই উপলক্ষে ছোট্ট একটা গল্প লিখেছিলুমÑ সেটি পড়লুম।’ রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন তার লেখালেখিতে প্রকৃতির মাঝে সৃষ্টি দেবতাকে খুঁজেছেন। প্রকৃতিই ছিল তার জীবন দেবতা এবং তপোবন ছিল তাঁর পরাণের গহীনের আরোধ্য ভূমি।
×