ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. এম হাসিবুল আলম প্রধান

উইমেন ডেলিভার সম্মেলন এবং কিছু কথা

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ১০ জুন ২০১৬

উইমেন ডেলিভার সম্মেলন  এবং কিছু কথা

১৬ মে ২০১৬ দুপুরে কোপেনহেগেন কাস্তরূপ বিমানবন্দরের রানওয়ে স্পর্শ করতে যাচ্ছে তখন দিনের আলোয় চোখের সামনে ধরা পড়ছিল বিশ্বের সবচেয় সুখী দেশ ডেনমার্কের সৌন্দর্যম-িত রূপ। বিমানবন্দরে নেমেই দেখা হলো উইমেন ডেলিভার ২০১৬-এর স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে। যারা কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত চার দিনব্যাপী (১৬ থেকে ১৯ মে) উইমেন ডেলিভারের ৪র্থ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে আসছেন তাঁদের সহযোগিতা করতেই উইমেন ডেলিভারের স্বেচ্ছাসেবকরা বিমানবন্দরে বিশেষ ডেস্ক স্থাপন করেছিলেন। বিমানবন্দরেই তাঁরা বলল কিছুক্ষণের মধ্যেই এসি হোটেল বেলা স্কাই থেকে তাদের নিজস্ব গাড়ি আসবে ডেলিগেটদের নিতে। বিমানবন্দরে পরিচয় হলো পাকিস্তান থেকে আসা ডেলিগেট ডা. সাদিয়া এবং নেপাল থেকে আসা অম্মিতা শর্মার সঙ্গে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের নেয়ার জন্য বিমানবন্দরে গাড়ি এলো। বিমানবন্দর থেকে বেলা সেন্টার এবং বেলা সেন্টারসংলগ্ন এসি হোটেল বেলা স্কাই খুব দূরের পথ নয়। যদিও ডেনমার্কে এখন গ্রীষ্মকাল, বিমানবন্দর থেকে বেরুতেই আমাদের দেশের মতো শীতের দমকা বাতাস এসে গায়ে লাগল। ইউরোপে এই একটা খুবই মজার বিষয়- তা হলো গ্রীষ্মকালেও আমাদের দেশের সাধারণ শীতের মতো আমেজ সেখানে বিরাজ করে। গাড়িতে যেতে যেতেই কোপেনহেগেনের চিরায়ত সৌন্দর্য ধরা পড়ছিল তার আপন মহিমায়। বেলা সেন্টারে পৌঁছে বেলা সেন্টার এবং এসি বেলা স্কাই হোটেলের সৌন্দর্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। বেলা সেন্টারটি হচ্ছে ডেনমার্কের সর্ববৃহৎ সম্মেলন কেন্দ্রগুলোর একটি যেখানে এক সঙ্গে ছয় হাজারের বেশি প্রতিনিধি কোন সম্মেলনে যোগ দিতে পারবেন। নিচের বড় বা মূল মিলনায়তনের উপরেও রয়েছে বসার জন্য আর একটি মিলনায়তন যেখান থেকে মূল মিলনায়তনের অনুষ্ঠান উপভোগ করা যায় অনায়াসে। মূল মিলনায়তন এবং দো’তলার মিলনায়তনের বাইরেও আরও অনেক মাঝারি হলরুম বা মিলনায়তন রয়েছে যেখানেও চমৎকারভাবে একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হতে পারে বিভিন্ন অধিবেশন। যেহেতু কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত এবারের উইমেন ডেলিভার সম্মেলনে (এ যাবতকালের সবচেয়ে বৃহত্তর নারী ও শিশু কন্যা অধিকার বিষয়ক সম্মেলন) বিশ্বের ১৫৯টি দেশ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজারের মতো প্রতিনিধি অংশ নিচ্ছেন সেজন্য এই বেলা সেন্টারটি নেয়া হয়েছে। এছাড়া বেলা সেন্টারসংলগ্ন ২৩ তলাবিশিষ্ট এসি হোটেল বেলা স্কাই কোপেনহেগেনের সবচেয়ে সুন্দর ও বড় হোটেলগুলোর একটি, যেখানে অনেক ডেলিগেটের থাকার আয়োজন করা হয়েছিল। এই হোটেল ছাড়াও ডেলিগেটদের জন্য বেলা সেন্টার থেকে আর একটু দূরে আরও বেশ কয়েকটি হোটেল ডেলিগেটদের জন্য নেয়া হয়েছিল। আমার সৌভাগ্য যে এই হোটেলের দশতলায় ১০৩৬ নং কক্ষটি আমার জন্য আগে থেকে নির্ধারিত ছিল। সম্মেলনের রেজিস্ট্রেশন শেষ করে রুমে এসেই মনটা আনন্দে ভরে যায়, নিমিষেই দূর হয়ে যায় দীর্ঘ কা¬ন্তির অবসাদ। রুম থেকে স্বচ্ছ কাচের দেয়াল ভেদ করে বার বার চোখ চলে যায় হোটেলের বাইরের সীমানায়, আবার দেখা মেলে কাপেনহেগেনের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের। ১৬ মে বিকাল চারটা ত্রিশ মিনিটে (আমাদের দেশে তখন প্রায় রাত ৯টা) উইমেন ডেলিভারের ৪র্থ আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধন ও প্রথম প্লেনারি সেশন। নিউইয়র্কভিত্তিক নারী অধিকার সংগঠন উইমেন ডেলিভার কর্তৃক আয়োজিত কোপেনহেগেনের এই সম্মেলনটিকে বলা হচ্ছে নারী ও শিশুকন্যার স্বাস্থ্য, অধিকার ও কল্যাণ বিষয়ক এ যাবতকালের বিশ্বের সবচেয়ে বড় সম্মেলন। এই সম্মেলনে এবার বিশ্বের ১৫৯টি দেশ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজারের মতো প্রতিনিধি যোগ দিয়েছেন বলে আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়। এই প্রতিনিধিদের মধ্যে রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রভাবশালী নেতা, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, আইনপ্রণেতা, শিক্ষাবিদ, মানবাধিকার নেতা, সাংবাদিক, নারী নেত্রী, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধি, জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রতিনিধি, তরুণ সংগঠক ও মানবাধিকার কর্মী। বিকাল চারটা ত্রিশ মিনিটের মধ্যে বেলা সেন্টারের মূল মিলনায়তন এবং দোতলার মিলনায়তন ভরে যায় কানায় কানায়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও প্লেনারি সেশনে উদ্বোধনী বক্তব্য দেন ডেনমার্কের ক্রাউন প্রিন্সেস মেরী এবং স্বাগত ভাষণ দেন ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী লারস লোকি রেসমুসেন। সম্মেলনে উপস্থিত হতে না পারলেও ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা ভাষণ দেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। এ পর্বে মডারেটরের দায়িত্ব পালন করেন ভারতের এনডিটিভির খবর উপস্থাপক এবং পরামর্শক সম্পাদক বারখা দত্ত এবং প্যানেল আলোচক হিসেবে ছিলেন উইমেন ডেলিভারির প্রধান নির্বাহী কাটজা আইভারসেন এবং প্রেসিডেন্ট জিল শেফিল্ড, নরওয়ের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী গ্রো হারমেন ব্রান্ডলেন্ড, হুর মহাপরিচালক মার্গারেট চান এবং প্রখ্যাত স্কটিশ গায়িকা ও গান রচয়িতা এ্যানি লেনমক্স প্রমুখ। প্লেনারি সেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় কনফারেন্সের নানামুখী কর্মকা-। এই কর্মকা-ের কর্মসূচীগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল প্লেনারি সেশন এবং প্লেনারি সেশন চলাকালে নারী ও কিশোরীদের অধিকার স্বাস্থ্য ও কল্যাণের জন্য বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন সেশন যাকে ইংরেজীতে বলা হয় কনকারেন্ট সেশন। এর পাশাপাশি আর একটি জায়গা ছিল যা স্পীকার কর্নার স্টেজ হিসেবে পরিচিত। এখানেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত রাজনৈতিক নেতা, বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা, আন্তর্জাতিক এনজিওসমূহের প্রতিষ্ঠাতা ও মানবাধিকার নেতারা বক্তব্য রাখতেন। স্পীকার কর্নার স্টেজের পাশে ছিল প্রদর্শনী কর্নার। এই প্রদর্শনী কর্নারে মূলত নারীর স্বাস্থ্য, অধিকার ও কল্যাণ নিয়ে কাজ করছে বিশ্বের এমন সব প্রতিষ্ঠান সেখানে স্টল দিয়ে তাদের নানা কর্মকা- সম্পর্কে অবগত করার জন্য হাজির হয়েছিল। এর বাইরে আর্টস ও সিমেনা কর্নার নামে আর একটি জায়গায় বিভিন্ন চলচ্চিত্র প্রদর্শনের আয়োজন করা হয়েছিল। বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী ও সাংসদদের নিয়েও নির্দিষ্ট এজেন্ডাভিত্তিক আলাদা সেশন ছিল এই সেমিনারে। উইমেন ডেলিভারের এবারের কনফারেন্সের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘ইনভেস্ট ইন গার্লস এ্যান্ড উইমেন-ইট পেইস’। সম্মেলনে প্লেনারি সেশন এবং কনকারেন্ট সেশনে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে জাতিসংঘ কর্তৃক সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) বা টেকসই উন্নয়ন মাত্রা নির্ধারিত হওয়ার পর বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকা-ে নারী ও মেয়েদের স্বাস্থ্য বিশেষ করে নারীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকারের বিষয়টিকে কিভাবে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে, এই উন্নয়ন কর্মকা- নারী ও মেয়েদের উন্নয়নে কি প্রভাব রাখছে এবং ভবিষ্যতে নারী ও মেয়েদের বা শিশু কন্যাদের উন্নয়নে এসডিজিকে ভবিষ্যতে আরও কিভাবে কার্যকর করা যায়। তাই প্লেনারি সেশন ও কনকারেন্ট সেশনগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বিভিন্ন দেশের প্রাক্তন ও বর্তমান মন্ত্রী, জাতিসংঘের বিভিন্ন বডির প্রতিনিধি, মানবাধিকার নেতা, নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব, অর্থনীতিবিদ, গবেষক, শিক্ষাবিদ ও বিভিন আন্তর্জাতিক এনজিও প্রতিনিধিদের। প্লেনারি সেশনে অংশগ্রহণেকরী উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে ছিলেন নরওয়ের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী গ্রো হারলেম ব্র্যান্ডলেন্ড, অষ্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড, নেদারল্যান্ডসের রানি কুইন ম্যাক্সিমা, হুর মহাপরিচালক মার্গারেট চান, বিল এ্যান্ড মিলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের কো-চেয়ার মিলিন্ডা গেটস, গায়ক এ্যানি লেনক্স, জর্দানের প্রিন্সেস সারাহ জেইল্ড, নেদারল্যান্ডসের প্রিন্সেস মাবেল ভ্যান অরেঞ্জি, ইথিওপিয়ার পরররাষ্ট্রমন্ত্রী টারডেস আধানম গ্রেব্রিয়াসেস, নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইউনুস, ইয়েমেনের নোবেল বিজয়ী নারী নেত্রী তাওয়াক্কল কারমান, নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্ক, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসন, ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়ান জেনসেন, জাতিসংঘের ইউনিফের উপনির্বাহী পরিচালক গাতা রাও গুপ্তা, পপুলেশন কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট জুলিয়া বান্টিং, ফুটবল খেলোয়াড় এবং কোচ সুনীতা কুমারী, ফিকার কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোয়া ডড, উইমেন জেলিভারের সিইও কারজা আইভারসন এবং প্রেসিডেন্ট জিল শেফিল্ড, সেনেগালের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আওয়া ম্যারি কল সেক, ভারতের পপুলেশন ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পুনম মুত্রেজা, পাকিস্তানের সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী হিনা জিলানী, ভারতের এনডিটিভির খবর উপস্থাপক এবং পরামর্শক সম্পাদক বারখা দত্ত, ফোর্ড ফাউন্ডেশন প্রেসিডেন্ট ড্যারেন ওয়াকার, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডিন ক্যারিয়ান ও ঘানার জেন্ডার, শিশু ও সামাজিক নিরাপত্তামন্ত্রী ভানা ওয়াই ভিতুর প্রমুখ। ১৭ মে থেকে মূলত কনফারেন্সের মূল কর্মকা-গুলো একসঙ্গে শুরু হয় এর তা একই তালে ১৯ মে পর্যন্ত চলে। ১৭ মে সকালে প্লেনারি সেশন চলাকালে বেলা সেন্টারের কনফারেন্স হলে (মূল মিলনায়তনে) দেখা হলো বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপিসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এনজিওর বেশ কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গে যারা দেশে নারীদের স্বাস্থ্য অধিকার ও কল্যাণের জন্য কাজ করছে। তাঁদের সঙ্গে দেখা হলে মনটা আনন্দে নেচে ওঠে, দীপু মনি আপা অল্প সময়েই সবাইকে আপন করে নেন। সেখানেই একটা প্রাথমিক আলোচনা হলো যে আমরা বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা কোন একটা সময় যোগাযোগ করে কোন একটা জায়গাতে একসঙ্গে মিলিত হবো। ইতোমধ্যে এসি বেলা স্কাই হোটেলের লবিতে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে সিরাজগঞ্জের সাংসদ ডা. মোহাম্মদ হাবিব-এ মিল্লাত এবং সাংসদ ওয়াসিফা আপার সঙ্গে। তাদের কাছেই শুনেছিলাম যে আমাদের মাননীয় অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান এই সম্মেলনে এসেছেন এবং একই হোটেলে অবস্থান করছেন। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের কখনও প্লেনারি সেশনে, কখনও কনকারেন্ট সেশনে, আবার কখনও প্রদর্শনী কর্নারে, আবার কখনও কখনও স্পীকার কর্নার স্টেজে যোগ দিচ্ছেন। এ এক অনন্য আনন্দের শিহরণ এবং অভিজ্ঞতার ঝুলি। সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি প্রতিনিধি বেলা সেন্টারে প্রতিদিন একসঙ্গে এভাবে সম্মেলনের নানা কর্মসূচীতে যোগ দিচ্ছেন, কিন্তু খাবার পরিবেশনসহ অনুষ্ঠানের কোন কর্মসূচীতে নেই বিন্দুমাত্র বিশৃঙ্খলার ছোঁয়া। বেলা সেন্টারে কয়েকশ’ কর্মী ও সম্মেলনের শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক প্রতিদিন প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়েছে কিভাবে অতিথিদের সহায়তা করা যায়। ১৮ তারিখে সম্মেলনের বিভিন্ন কর্মসূচি চলাকালে মিডিয়া সেন্টারের সামনে দেখা হলো বাংলাদেশের কয়েকজন সাংবাদিক যাঁরা আমন্ত্রিত হয়ে এই সম্মেলনের যোগ দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে হলেন প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার মানসুরা হোসেইন, ডেইলি স্টারের পরিমল, নিউজ আওয়ার এর সম্পাদক ড. তারেক সালাহউদ্দিন এবং বিডিনিউজ ২৪ ডটকমের সিনিয়র রিপোর্টার নুরুল ইসলাম হাসিব। ঐদিন দুপুরেই দেখা হলো চ্যানেল আইর ফারজানা ব্রাউনিয়া এবং স্বর্ণ কিশোরী নেটওয়ার্ক ফাউন্ডেশনের পরিচালক মো. রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তাঁরা বাংলাদেশের স্কুল ও কলেজের চারজন ছাত্রীকে স্বর্ণ কিশোরী হিসেবে এই সম্মেলনে নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৮ তারিখ সন্ধ্যায় অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিদের সম্মানে আয়োজকদের পক্ষ থেকে কোপেনহেগেনের প্রসিদ্ধ টিভলী গার্ডেনসে আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার। সন্ধ্যায় দিনের মতো আলো এবং নানা রঙের বাতির আলোয় টিভলী গার্ডেন অপরূপ সাজ সজ্জিত হয়েছিল। রাত যত বাড়ছিল আলোর বন্যা ও ঝলকানিতে টিভলী গার্ডেন যেন সৌন্দর্যের অনন্য এক নগরীর রূপ ধারণ করছিল। ১৯ মে ছিল কনফারেন্সের সমাপনী দিন। সকাল থেকে প্লেনারি ও কনকারেন্ট সেশন চললেও বিচ্ছেদের এক করুণ সুর যেন বেলা সেন্টারে উচ্চারিত হচ্ছিল। সকাল ১০টার দিকে আমরা বাংলাদেশ থেকে আসা প্রতিনিধিরা বেলা সেন্টারের দোতলায় ১টি কনফারেন্স রুমে মিলিত হলাম। বাংলাদেশের পতাকা বুকে নিয়ে চলল সেখানে ফটো সেশন। ঐদিন সকাল সাড়ে দশটায় দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বেলা সেন্টারের হল রুম বি-থ্রি থ্রিতে একটি ককাসের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে এই অঞ্চলের বিদ্যমান বাল্যবিবাহ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয় এবং কী ধরনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে সেই পরামর্শ উপস্থাপন করা হয়। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে এশিয়ান অঞ্চলের এই ককাসে আমি আলোচনায় অংশ নেই। ঐদিন বিকেলে ৪টায় ‘বি দ্য চেঞ্জ ইউ ওয়ান্ট টু সী’ শীর্ষক প্লেনারি সেশনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ৪ দিনব্যাপী বিশ্বের এ যাবতকালের সর্ববৃহৎ নারী অধিকার বিষয়ক সম্মেলনের। সমাপনী অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শুভেচ্ছা বক্তব্য পাঠিয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন। ১৯ তারিখ বিকেলে থেকেই প্রতিনিধিগণ যে যার মতো করে দেশে ফেরা শুরু করেন। আমার ফ্লাইট ছিল ২০ তারিখ রাতে, কোপেনহেগেন থেকে কাতার হয়ে ঢাকা। ফলে ১৯ তারিখ সন্ধ্যা ও ২০ তারিখ পুরোটাই হাতে ছিল কোপেনহেগেন শহরটি ঘুরে দেখার। আমরা দেশে থাকা অবস্থায় আয়োজকদের পক্ষ থেকে মেসেজের মাধ্যমে মোবাইলে পেয়েছিলাম ট্রাভেল পাস যা দেখিয়ে যে কোন সময় বাস, মেট্রো ও ট্রেইনে চড়ে কোপেনহেগেনের যে কোন স্থানে আমরা অনায়াসে যেতে পারতাম। ফলে কোপেনহেগেনের বিভিন্ন জায়গা ঘুরতে গিয়ে আবারও দেখা হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ইউমেন ডেলিভার কনফারেন্সের প্রতিনিধিদের সঙ্গে। সত্যি কোপেনহেগেন শহরটি না দেখলে ডেনমার্কের সৌন্দর্য ও রূপ কোনটাই পর্যটকদের নিকট গভীরভাবে ধরা পড়বে না। ২০ তারিখ রাতে আবারও এসি হোটেল বেলা স্কাইয়ের মাইক্রোবাসে ফিরে আসছিলাম কোপেনহেগেন এয়ারপোর্টে দেশে ফেরার জন্য, পাশের সিটে ভারতের হায়দরাবাদ থেকে আসা বাঙালী মেয়ে সাংবাদিক স্টেলা পল। ক্রমশ চোখের সীমানায় অদৃশ্য হচ্ছিল কোপেনহেগেনের সৌন্দর্য ও চিরায়িত রূপ, কিন্তু স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছিল উইমেন ডেলিভার ৪র্থ আন্তর্জাতিক সম্মেলনের নানা ঘটনা ও অনন্য অভিজ্ঞতার স্বাদ। বার বার হৃদয় থেকে উচ্চারিত হচ্ছিল জয় হোক নারী ও মেয়েদের, উচ্চারিত হচ্ছিল সম্মেলনের গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ নারী ও শিশুকন্যাদের জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ হচ্ছে টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত। আরও উচ্চারিত হচ্ছিল নারী ছাড়া পুরুষের পূর্ণতা কোথায়? মনে পড়ছিল কবি কাজী নজরুলের ‘নারী’ কবিতার কালজয়ী পঙ্ক্তিমালা “কোন কালে এক হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারী/ প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।”
×