ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৫:১০, ১০ জুন ২০১৬

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ রমজান মাস বলে কথা, অনেক কিছুই বদলে গেছে। সারা দেশের মতো শহর ঢাকাও নতুন চেহারায় দৃশ্যমান। প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। এখন খুব বেশি রাত জাগছেন না কেউ। আগেভাগে ঘুম। আগেভাগেই জেগে ওঠা। শেষ রাতে মোবাইল ফোনে এ্যালার্ম বেজে উঠছে। শুরু হয়ে যাচ্ছে ডাকাডাকি। পরিবারের এক সদস্য অপর সদস্যকে ডেকে তুলছেন। এক বাড়ির লোক খবর নিচ্ছেন অন্য বাড়ির। এখানেই শেষ নয়। এভাবে দারুণ সরব হয়ে উঠছে বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর ঢাকা। সেহরির এ আয়োজন চলছে ফজরের আযানের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। এখন অফিস-আদালত চলছে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত। দিনের সমস্ত কাজ এ সময়ের মধ্যে শেষ করতে হচ্ছে। অন্যান্য পেশার লোকজনও সন্ধ্যা নামার আগেই বাড়ি ফিরতে ব্যাকুল হয়ে উঠছেন। এ কারণে শহরজুড়ে বিশেষ এক ধরনের ছোটাছুটি দৃশ্যমান। একই সময় অধিকাংশ মানুষ বাড়ি ফেরার তাগিদ অনুভব করছেন। ফলে ওই সময়ে যানজট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। বেলা ৩ টার পর থেকে মানুষের রাস্তায় নেমে আসা শুরু। চলছে ইফতারের আধাঘণ্টা আগ পর্যন্ত। এ সময় যানবাহনের তীব্র সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। গত বুধবার ইফতারের একঘণ্টা আগে শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, মানুষ আর মানুষ। কেউ হন্যে হয়ে সিএনজি অটোরিক্সা বা টেক্সিক্যাব খোঁজ করছেন। কেউ দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় আছেন বাসের জন্য। একটি বাস আসতেই শত শত যাত্রী সেটি ধরতে দৌড়াচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাদিরাও ছিলেন এই দলে। বললেন, সাধারণত ভার্সিটির বাসেই যাই। কিন্তু আজ লাইব্রেরিতে সময় বেশি দিতে হয়েছে। ততক্ষণে আমার রুটের বাস ছেড়ে গেছে। এখানে আধা ঘণ্টার বেশি সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, সব বাস আগেই যাত্রী ভর্তি হয়ে আসছে। তার ওপর অন্যদের সঙ্গে দৌড়ে পারছি না। ছেলেরা যেভাবে খুশি যেতে পারে। মেয়ে হয়ে তো আর তা পারি না। আর কথা এগুলো না। নাদিরাকে খুব ক্লান্ত মনে হলো। পাশেই দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছিলেন জিল্লুর রহমান। বয়সে প্রবীণ। হাতে ধরা ঠোঙ্গা দেখিয়ে বললেন, ইফতার বাসে বসেই করতে হবে। প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। ফার্মগেট এলাকায় একটি ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। ইফতারের সময় যাত্রীদের সহায়তা করতে রাস্তায় নামছে পুলিশ। ডিএমপি তেজগাঁও জোনের পক্ষ থেকে নেয়া উদ্যোগটি প্রশংসা করার মতো। অধিকাংশ বাস যাত্রীদের নিতে রাজি হয় না। দরজা বন্ধ করে দ্রুত পালানোর চেষ্টা করে। পুলিশ সদস্যরা এসব বাস হাতের ইশারায় থামাচ্ছেন। অপেক্ষাকৃত প্রবীণ ও দুর্বল যাত্রীকে বাসে উঠিয়ে দিচ্ছেন। কিছু বাসে দাঁড় করিয়ে যাত্রী নেয়া হয় না। কিন্তু ইফতারের পূর্ব মুহূর্তে বহু মানুষ বাসায় ফেরার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। তাদের কথা বিবেচনা করে ওই সময়টাতে স্পেশাল সার্ভিসের পরিবর্তে সাধারণ বাসের মতো যাত্রী পরিবহনের পরামর্শ দিচ্ছে পুলিশ। মজার ব্যাপার হলো, ব্যস্ত ঢাকার চেহারা আমূল বদলে যায় ইফতারের সময়। সবাই যখন ইফতার সামনে নিয়ে বসেন, শহরের সব রাস্তাই তখন যানবাহন শূন্য! ফাঁকা রাস্তায় দু’একটা গাড়ি সাঁই সাঁই করে ছুটে যায়। ভিআইপি সড়কগুলোয় রিক্সা প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু ইফতারের আগে সব নিয়ম শিথিল হয়ে যায়। সব সড়কেই বেদম ছুটে চলে রিক্সা। অনেকে এ সময়টাকে বিশেষ কাজে লাগিয়ে অনায়াসে দূরের গন্তব্যে পৌঁছে যান। এমনি বেড়ানোর জন্য, বুক ভরে বাতাস নেয়ার জন্যও কেউ কেউ রিক্সা করে এ সময় বের হয়ে পড়েন। রমজানের প্রতিদিনই রাজধানীতে আয়োজন করা হচ্ছে ইফতার পার্টির। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ইফতারকে উপলক্ষ করে একত্রিত হচ্ছে। চলছে মতের আদান-প্রদান। বৃহস্পতিবার গণভবনে ইফতারের আয়োজন করা হয়। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও এতিমদের সঙ্গে ইফতার করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টিএসসির বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও চলছে ইফতার আয়োজন। একই দিন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ইফতার করেন আইনজীবীদের সঙ্গে। এর আগে প্রথম রোজায় এতিমদের সঙ্গে নিয়ে লেডিস ক্লাবে ইফতার করেন তিনি। রমজানে রাজধানীর সব কিছু স্বাভাবিক রাখতে নানা তৎপরতা চোখে পড়ছে। সরকার প্রশাসন এখন বিশেষ সজাগ বলেই মনে হয়। চলছে ভেজালবিরোধী অভিযান। বৃহস্পতিবার বেইলি রোড এলাকার একাধিক রেস্তরাঁয় অভিযান চালায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। এখানকার কয়েকটি নাম করা রেস্তরাঁর খাবারে এমনকি পোকা মরে পড়ে থাকতে দেখে ভ্রাম্যমাণ আদালত। জরিমানাও করা হয়। ঢাকার মেয়ররাও যথাসম্ভব কাজ করছেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে গুলিস্তান এলাকা পরিদর্শনে বের হন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাইদ খোকন। অগ্রণী ব্যাংকের গলি থেকে শুরু করেন তিনি। পরে সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের সামন দিয়ে এগিয়ে যান মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের দিকে। এসময় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়াসহ কর্মকর্তারা মেয়রের সঙ্গে ছিলেন। এ সময় সাঈদ খোকনকে সন্তুষ্টই মনে হয়। মেয়র বলেন, এলাকাটি পরিচ্ছন্ন করতে অনেকদিন ধরে আমরা কাজ করছিলাম। এখন বেশ পরিচ্ছন্ন মনে হচ্ছে। এখন লাখ লাখ মানুষ গুলিস্তানে আসা-যাওয়া করছেন। তাদের চলাফেরা স্বস্তির হচ্ছে। এ সময় ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, রমজানের সাত দিন আগে থেকে নগরী যানজটমুক্ত এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য কাজ করে যাচ্ছে পুলিশ প্রশাসন। শহরকে আর নোংরা করতে দেয়া হবে না বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
×