ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সন্ত্রাস ও গুপ্তহত্যার বিরুদ্ধে এবার যুদ্ধ ঘোষণা সরকারের

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ১০ জুন ২০১৬

সন্ত্রাস ও গুপ্তহত্যার বিরুদ্ধে এবার যুদ্ধ ঘোষণা সরকারের

শংকর কুমার দে ॥ জঙ্গীগোষ্ঠী ও সন্ত্রাসীদের গুপ্তহত্যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। পুলিশ সদর দফতরে দেশব্যাপী সপ্তাহব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করার ঘোষণা দিয়েছেন আইজিপি একেএম শহীদুল হক। দেশব্যাপী গুপ্তহত্যার পেছনে বিএনপি-জামায়াত ও ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সংশ্লিষ্টতা থাকার বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে দেশের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। চট্টগ্রামে পুলিশের এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু গুপ্তহত্যার শিকার হওয়ার পর অঘোষিতভাবে শুরু করা হয় কম্বিং অপারেশন। কম্বিং অপারেশনে দেয়া হচ্ছে ব্লক রেইড। সারাদেশে গত মঙ্গল থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তিন দিনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে সাতজন জঙ্গী ও সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে জিরো টলারেন্স দেখানোর নির্দেশ নিয়ে মাঠে নেমেছে বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা। সরকারের উচ্চপর্যায় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সারাদেশে বেছে বেছে প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, শিক্ষক, বিদেশী নাগরিক, মানবাধিকারকর্মী, খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী, ধর্মযাজক, পুরোহিত, ভিন্নমতাবলম্বীদের গুপ্তহত্যা করে যাচ্ছে জঙ্গীগোষ্ঠীর নামে সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা। গত দেড় বছরে সারাদেশে ৪৮টি জঙ্গী হামলায় টার্গেট কিলিং হয়েছেন অন্তত ৫১ জন। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি জঙ্গী হামলার ঘটনার অর্থাৎ ২৬টি ঘটনায় অর্ধেক টার্গেট কিলিংয়ের ২৮ জনের রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি তদন্তকারী পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা। মোটরসাইকেলযোগে এসে চোখের পলকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যার পর গুলি করে খুন নিশ্চিত করে পালিয়ে যাচ্ছে খুনীরা। তারপর আর খুনী কারা তা উদ্ঘাটন করা যাচ্ছে না। এভাবে গত দেড় বছরের মাথায় এসে এই একই কায়দায় খুন করা হয়েছে চট্টগ্রামে পুলিশের এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু ও একই দিনে নাটোরে খ্রীস্টান ব্যবসায়ী সুনীল গোমেজকেও। এতে সরকারের টনক নড়ে। শুরু হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অঘোষিত কম্বিং অপারেশন বা বিশেষ অভিযান, যা শুক্রবার থেকে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা শুরু হয়েছে বলে ঘোষণা দেন আইজিপি। এর আগে বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, গুপ্তহত্যা করে কেউই রেহাই পাবে না। দেশে একের পর এক যে গুপ্তহত্যাকা- ঘটানো হচ্ছে তার পেছনে বিএনপি-জামায়াতের যোগসূত্র রয়েছে। যারা প্রকাশ্যে মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে তারাই কৌশল পাল্টে এখন মানুষ হত্যা করছে। জাতীয় সংসদে বক্তব্যের পর একই দিনে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে সাম্প্রতিক গণহত্যার পেছনে দুটি রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারপ্রধান হিসেবে আমার কাছে নিশ্চয়ই তথ্য আছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সোমবার সচিবালয়ে নিজ দফতরে সাংবাদিকদের বলেছেন, আইএস নয়, দুটি আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থা ও স্থানীয় কয়েকজন রাজনীতিক দেশকে অস্থিতিশীল করতে টার্গেট কিলিং করছে। শীঘ্রই চট্টগ্রামে এসপির স্ত্রী হত্যায় জড়িতদের খুঁজে বের করা হবে। পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী খুনের ঘটনা টার্গেট কিলিং। এ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে গোয়েন্দা বাহিনী তৎপর রয়েছে। এ হত্যার সঙ্গে আইএস সম্পৃক্ত নয় বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এর আগেও বলেছেন, গুপ্তহত্যার পেছনে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র যুক্ত। জেএমবি, এবিটি, জামায়াত-শিবির আলাদা কিছু নয়। যারা জেএমবি-এবিটি, তারাই জামায়াত-শিবির। বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দফতরে আইজিপি একেএম শহীদুল হকের সভাপতিত্বে এক বৈঠকে দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। চট্টগ্রামে জঙ্গীবিরোধী অভিযানে নেতৃত্বদানকারী কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী হত্যাকা-ের পর বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দফতরে ‘জঙ্গীদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামছে পুলিশ’ শিরোনামে এ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানে নামছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার ওই বৈঠকে পুলিশের মহাপরিদর্শক জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবিরোধী প্রচারণা জোরদার করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ দেন এবং তথ্য সংগ্রহের জন্য কমিউনিটি পুলিশিংকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন। এ সময় শহীদুল হক বলেন, এ ঘটনার (বাবুলের স্ত্রী খুন) সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের অত্যন্ত দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় আমাদের আনতে হবে। এজন্য বাহিনীর সব সদস্যকে একতাবদ্ধ হয়ে, দৃঢ় মনোবল নিয়ে, পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান পুলিশপ্রধান। পুলিশ সদর দফতরে অনুষ্ঠিত সভায় অতিরিক্ত আইজিপি ফাতেমা বেগম, সিআইডির অতিরিক্ত আইজিপি শেখ হিমায়েত হোসেন, রেলওয়ে রেঞ্জের অতিরিক্ত আইজিপি আবুল কাশেম, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াসহ সব মহানগর পুলিশ কমিশনার, বিভিন্ন রেঞ্জের ডিআইজি এবং ঢাকা, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, নীলফামারী, বগুড়া, ঝিনাইদহ ও নাটোর জেলার পুলিশ সুপাররা উপস্থিত ছিলেন। দেশব্যাপী এ অভিযান শুক্রবার ভোর থেকে শুরু হবে, চলবে সাত দিন। গত দেড় বছরে যেভাবে লেখক, প্রকাশক, অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট, বিদেশীদের হত্যা করা হয়েছিল, সেই একই কায়দায় গত ৫ জুন কুপিয়ে ও গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় এসপিপতœী মাহমুদা খানম মিতুকে। এ হত্যাকা-ে জঙ্গীদের সন্দেহ করলেও পাঁচ দিনেও কারা খুনী তা শনাক্ত করা যায়নি। পুলিশের এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু খুনের পর গত মঙ্গল থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তিন দিনে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন অন্তত সাতজন। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় নিহত হয়েছেন চারজন, রাজশাহীতে একজন, বগুড়ায় একজন ও গাইবান্ধায় একজন। রাজধানীর রামপুরা ও তুরাগ থানা এলাকায় বুধবার রাতে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দু’জন নিহত হয়েছেন। রাজধানীর রামপুরা থানার পূর্ব রামপুরার বালুর মাঠ এলাকায় র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-৩-এর সঙ্গে রাত বারোটার দিকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন কামাল পারভেজ। তিনি রাজধানীর উত্তরখান এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি বরিশালের গৌরনদী উপজেলায়। রাত সোয়া ১টার দিকে নিহত ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে ঢামেকে আনা হয়। অপরদিকে রাজধানীর তুরাগ থানা এলাকার প্রত্যাশা সেতুর কাছে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নজরুল নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। রাত দুটোর দিকে এ ঘটনা ঘটে। র‌্যাবের ভাষ্য, নজরুল অজ্ঞান পার্টির নেতা। তার লাশ টঙ্গী সরকারী হাসপাতালে রাখা হয়েছে। রাতে তুরাগের প্রত্যাশা সেতুর কাছে একটি চেকপোস্টের কাছে ছিনতাইকারীদের সঙ্গে র‌্যাবের গোলাগুলিতে নজরুল আহত হন। পরে তাকে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। বন্দুকযুদ্ধের পর ঘটনাস্থল থেকে একটি বিদেশী পিস্তল ও দুটি গুলি উদ্ধার করা হয়। ঢাকা মহানগরসহ আশপাশের এলাকায় প্রতারণা করে এ রকম একটি অজ্ঞান পার্টির নেতা ছিলেন। এছাড়া ছিনতাই ও নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। গাইবান্ধা থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের মালঞ্চা গ্রামের জাহাঙ্গীরের বাড়িতে বুধবার রাত পৌনে ২টায় জেএমবির এক সদস্য (৩৭) পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে গোলাবারুদসহ দেশী অস্ত্র উদ্ধার করেছে পুলিশ। গোবিন্দগঞ্জ থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নিহত ব্যক্তি নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবির সক্রিয় সদস্য। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বৈঠককালে পুলিশ ওই বাড়িতে অভিযান চালায়। এ সময় পুলিশের উপস্থিতি বুঝতে পেরে সংঘবদ্ধ জেএমবির সদস্যরা পুলিশের ওপর গুলি ছোড়ে। পুলিশও পাল্টা গুলি চালালে ঘটনাস্থলে জেএমবির ওই সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। পুলিশ জানায়, নিহতের লাশ উদ্ধার করে গোবিন্দগঞ্জ থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নিহত জেএমবি সদস্যের পরিচয় পাওয়া যায়নি। তবে সে এ জেলার বাইরের লোক হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
×