ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অটোয় ‘চালক নৈরাজ্য’ ॥ ইচ্ছেমতো মানুষের পকেট কেটে টাকা আদায়

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ১০ জুন ২০১৬

অটোয় ‘চালক নৈরাজ্য’ ॥ ইচ্ছেমতো মানুষের পকেট কেটে টাকা আদায়

রাজন ভট্টাচার্য ॥ রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে সবুজবাগ আসতে অটোরিক্সা সংগ্রহের চেষ্টা। অন্তত ১০টি অটোরিক্সা নির্দিষ্ট গন্তব্যে আসতে নারাজ। ২০টির বেশি অটোরিক্সার চালক মিটারে যেতে অস্বীকৃতি জানান। অনেকের বক্তব্য ‘মিটার নষ্ট’। আরও অন্তত সাত চালকের দাবি চুক্তি ভাড়া ৩০০ টাকা। শেষ পর্যন্ত ঢাকা মেট্রো-থ-১৪-১৩০৭ এই নম্বরের গাড়িতে ২৫০ টাকায় গন্তব্যে এলেন একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কামাল আহমেদ। অথচ গন্তব্যে পৌঁছার পর মিটারে ভাড়া ওঠে মাত্র ১৭০টাকা। অর্থাৎ ৮০ টাকা বেশি গুনতে হলো। তিনি অভিযোগ করেন, বাস টার্মিনালে ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন থাকলেও এ নিয়ে কারো কোন মাথাব্যথা নেই। ইচ্ছেমতো মানুষের পকেট কেটে টাকা আদায় করছেন অটোরিক্সা চালকরা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, অটোরিক্সার ক্ষেত্রে মিটারে চলার নিয়মকানুন বলতে কিছু নেই। চুক্তিতে চলছে গাড়ি। ইচ্ছেমতো চলছে ভাড়া আদায়। শতাধিক অটোরিক্সা চালকের সঙ্গে কথা বলে একটিও মিটারে চলার নজির মেলেনি। এ নিয়ে সাধারণ যাত্রী চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তবে গাড়িতে যাত্রী পরিবহনের সময় মিটার সচল থাকে। এছাড়াও স্বল্প দূরত্বে যাওয়া বাধ্যতামূলক হলেও কেউ যান না। সর্বনিম্ন ভাড়া ৪০ টাকা দিয়ে যাত্রী পরিবহনের উদাহরণ নেই। সব মিলিয়ে এসব পরিবহনের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে? এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীতে পরিবহনের নৈরাজ্য থামাতে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) নিয়মিত চারটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করত। যার একটিও এখন আর সচল নেই। তাছাড়া ট্রাফিক পুলিশও অটোরিক্সা চালকদের নৈরাজ্য থামাতে এখন আর আগের মতো তৎপর নয়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রমজান ও আসন্ন ঈদ উপলক্ষে রাজধানীতে বাড়তি মানুষের চাপ। সেই সঙ্গে গণপরিবহন সঙ্কট। এসব সুযোগে একেবারেই বেপরোয়া অটোরিক্সা চালকরা। বাধাহীন গাড়ি চলছে তাদের ইচ্ছেমতো। বলার কেউ নেই। যাত্রী প্রতিবাদ করলে চালকের সাফ কথা ‘গেলে যান, না গেলে নাই।’ নেত্রকোনা থেকে হাওড় এক্সপ্রেসে কমলাপুর আসার পর বাসায় ফেরার বিড়ম্বনায় ডাঃ রতন প-িত। তিনি জানান, অটোরিক্সা চালককে মিটারে যেতে বলা মাত্রই সরল উত্তর মিটার নষ্ট। যাব না। গেলে চুক্তিতে। অথচ ভাড়া হাঁকানো হচ্ছে তিনগুণের বেশি। পাশাপাশি নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে অনিহা। তিনি জানান, নিরুপায় হয়ে চালকের চাহিদামতো ভাড়া গুনে গন্তব্যে পৌঁছতে হচ্ছে। যাত্রী ও চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অটোরিক্সা মালিক ও শ্রমিকের ঐকমত্যের ভিত্তিতেই মিটার প্রথা বাতিল করা হয়েছে। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সরকার নির্ধারিত জমা যেমন মালিকরা মানেন না। তেমনি চালকরাও সরকার নির্ধারিত ভাড়া মেনে গাড়ি চালান না। এছাড়াও মালিক-শ্রমিকের সুবিধা নিশ্চিত করতে সরকারের কাছে কয়েকদফা দাবি তোলা হয়েছিল, যার একটিও পূরণ হয়নি। সব মিলিয়ে মালিক-শ্রমিকের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে মিটার প্রথা মানছেন না কেউই। পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এক নবেম্বর থেকে সিএনজিচালিত অটোরিক্সার ভাড়া ও জমা পুনর্নির্ধারণ করে সরকার। মালিকদের জমা বাড়িয়ে ৬০০ টাকার স্থলে করা হয়েছে ৯০০ টাকা। নতুন ভাড়া অনুযায়ী প্রথম দুই কিমি ভাড়া ২৫ টাকার স্থলে ৪০ টাকা করা হয়েছে। সর্বনিম্ন ভাড়াও তাই। পরবর্তী প্রতি কিমি ভাড়া সাত টাকা ৬৪ পয়সার স্থলে ১২ টাকা করা হয়। যানজট বা অন্য কোন কারণে রাস্তায় বিরতিকালে প্রতি মিনিটের ভাড়া এক টাকা ৪০ পয়সার স্থলে ২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা ও চট্টগ্রামে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল। এর পরও প্রায় ছয় হাজার অটোরিক্সা মালিকের বিরুদ্ধে বাড়তি জমা ও দুই শিফটে গাড়িভাড়া দেয়ার অভিযোগ ওঠে। তেমনি চালকের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগের শেষ ছিল না। চুক্তিতে চলা, স্বল্প দূরত্বে না যাওয়া, বাড়তি টিপস নেয়া ছিল প্রতিদিনের ঘটনা। অথচ এসব নৈরাজ্য বন্ধে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গঠিত ১১ সদস্যের টাস্কফোর্স শুরু থেকেই কার্যত নীরব ভূমিকা পালন করে আসছে। অপরাধ চলছে, অথচ দেখার যেন কেউ নেই। অটোরিক্সা নৈরাজ্য রোধ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএ সচিব শওকত আলী জনকণ্ঠকে বলেন, বাড়তি ভাড়া ও জমার বিরুদ্ধে বিআরটিএর পক্ষ থেকে আমরা তৎপর আছি। প্রয়োজনে অভিযান জোরদার করা হবে। কেউ আইন অমান্য করে গাড়ি পরিচালনার চেষ্টা করলে বিআরটিএ আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হবে। চালকরা বলছেন, সরকারী নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সর্বোচ্চ এক হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত জমা আদায় করছেন মালিকরা। নগরীতে চলা প্রায় ১৩ হাজার অটোরিক্সার বেশিরভাগই এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ভাড়া নির্ধারণী কমিটির সদস্যরা বলছেন, সঠিক ব্যয় বিশ্লেষণ করা হলে কোন অবস্থাতেই মালিকের জমা ৯০০ টাকা হবে না। তবুও পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা আনতেই মালিকের ক্ষেত্রে বাড়তি সুযোগ নিশ্চিত করা হয়েছে। তারা বলছেন, ব্যয় বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ৩০০ কার্যদিবসকে বছর ধরা হয়েছে। এ হিসেবে ব্যয় ধরা হয় ৮৫২ টাকা। এর মধ্যে প্রতিদিনের গ্যারেজ ভাড়া হিসেবে আটচল্লিশ টাকা যুক্ত হয়েছে। পরবর্তীতে মালিক সমিতির আবেদনের প্রেক্ষিতে ১০ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে জমা বাড়িয়ে ৯০০ টাকা চূড়ান্ত হয়। শ্রমিক নেতাদের অভিযোগ, সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করার পরও একশ্রেণীর গ্যারেজ মালিক চালকদের জিম্মি করে দারোয়ানের নামে গাড়িপ্রতি সর্বোচ্চ ৭০ টাকা পর্যন্ত প্রতিদিন আদায় করছেন। ফলে চালকদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। মূলত এসব কারণেই কিছু চালক মিটারে যেতে রাজি হন না। কখনও মিটারে গেলেও বাড়তি টিপস্ হিসেবে যাত্রীর কাছ থেকে ২০-৫০ টাকা পর্যন্ত আদায় করছেন চালকরা। সরেজমিন চিত্র ॥ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে অটোরিক্সা চালকদের চরম নৈরাজ্য লক্ষ্য করা গেছে। গাবতলী, মহাখালী, শাহবাগ, কমলাপুর, রামপুরা, মালিবাগ, বাড্ডা, খিলক্ষেত, বাসাবো, মগবাজার নগরীর অন্তত ২০টি পয়েন্টে ঘুরে একটি অটোরিক্সাও মিটারে চলতে দেখা যায়নি। অভিযুক্ত পরিবহনগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা মেট্রো-থ-১৪-২৩০৫, ঢাকা মেট্রো-থ-১৩-৩২২৯, ঢাকা মেট্রো-থ-১৪-০৫৯৩, ঢাকা মেট্রো-থ-১৩-৩৭১৯, ঢাকা মেট্রো-থ-১২-৬৭৫৬, ঢাকা মেট্রো-থ-১৩-৩০১৪, ঢাকা মেট্রো-থ- ১৩-০৩৩৩২, ঢাকা মেট্রো-থ-১২-৬২৩৫, ঢাকা মেট্রো-থ-১৩-৩২৬৯, ঢাকা মেট্রো-থ-১৪-০৫৯৩, ঢাকা মেট্রো-থ-১৩-৩৭১৯, ঢাকা মেট্রো-থ-১২-৬৭৫৬, ঢাকা মেট্রো-থ-১৩-৩০১৪, ঢাকা মেট্রো-থ-১৩০৩৩২, ঢাকা মেট্রো-থ-১২৬২৩৫, ঢাকা মেট্রো-থ-১৩৩২৬৯, ঢাকা মেট্রো-থ-১৩-৫১২৯, ঢাকা মেট্রো-থ-১৩৫২৫৭, ঢাকা মেট্রো-থ-১৪-০৭৩৩, ঢাকা মেট্রো-থ-১৪-১৫২৩, ঢাকা মেট্রো-থ-১৪-৩৭৩৩, ঢাকা মেট্রো-থ-১৪-২৬২৩, ঢাকা মেট্রো-থ-১৩-১২৭৯, ঢাকা মেট্রো-থ-১৩-১২৪১, ঢাকা মেট্রো-থ-১৪-৩৭৩৫, ঢাকা মেট্রো-থ-১৪-৩৮৩৬, ঢাকা মেট্রো-থ-১৪-৩৭৩৫, ঢাকা মেট্রো-থ-১২-৮৫৪৩, ঢাকা মেট্রো-থ- ১৪-০৮৩৭, ঢাকা মেট্রো-থ-১২-৬৫৩৫, ঢাকা মেট্রো-থ-১৪-২৬৩৬, ঢাকা মেট্রো-থ-১২-৯০০৩, ঢাকা মেট্রো-থ- ১৪-৩৩৪০, ঢাকা মেট্রো-থ-১১-০২১৯, ঢাকা মেট্রো-থ- ১৩-২০১৩, ঢাকা মেট্রো-থ- ১৪-৬৫৯৮, ঢাকা মেট্রো-থ-১৪-৩১২৮, ঢাকা মেট্রো-থ-১৪-৩৯৪৪, ঢাকা মেট্রো-থ-১২-৬০০৮, ঢাকা মেট্রো-থ-১২-৬৬১১, ঢাকা মেট্রো-থ- ১৪-০৮৯৭। প্রায় ছয় হাজার গাড়ি চলছে দুই শিফটে ॥ ঢাকা অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়নের হিসেব মতে, সরকারী নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে প্রায় ছয় হাজার অটোরিক্সা চলছে দুই শিফটে। এর মধ্যে দুই হাজার ২৩৩টি গাড়ির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়সহ বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের কাছে। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনুমোদিত অটোরিক্সা রয়েছে ১২ হাজার ৭১৫টি। মিশুকের পরিবর্তে আরও ৪১৫টি নতুন অটোরিক্সা নামানো হয়েছে। প্রাইভেট অটোরিক্সা নামে রাজধানীতে ভাড়ায় চলছে প্রায় ছয় হাজার গাড়ি। এছাড়াও গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ ঢাকা জেলা মিলিয়ে আরও চার হাজার অটোরিক্সা অবৈধভাবে রাজধানীতে চলাচল করছে।
×