ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ সালাতুত্ তারাবীহ্

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ১০ জুন ২০১৬

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ সালাতুত্ তারাবীহ্

রমাদান প্রাচুর্যের মাস। এ এক মহান মাস। সিয়ামের এই মাসে ইশার সালাত আদায় করার পরে এবং বিতরের সালাত আদায় করার পূর্বেই দুই রাকা’আত করে করে দশ সালামে যে বিশ রাকা’আত সুন্নাত মুআক্কাদা সালাত আদায় করতে হয় তাকে বলা হয় সালাতুত্্ তারাবীহ্ বা তারাবীহ্র নামাজ। তারাবীহ্ শব্দের অর্থ বিরাম বা বিশ্রাম। এই সালাতে প্রতি দুই রাকা’আত অন্তর কিছুক্ষণ বিরাম নেয়া হয়, যে কারণে একে সালাতুত্ তারাবীহ্ বলা হয়। এই সালাত আদায় বলে সায়িমের (রোজাদার) মননে এক অপূর্ব প্রফুল্লতা ও প্রশান্তি নেমে আসে। অন্তরের গভীরে এমন এক জ্যোতির বিচ্ছুরণ ঘটে যার আভা প্রস্ফুটিত হয় তার চেহারায়। দিবসের প্রায় সাড়ে তেরো ঘণ্টা কঠিন কৃচ্ছ্র সাধনের পর ইফতারের মধ্য দিয়ে সায়িমের যে আনন্দ আভা বিম্বিত হয় তা সুদৃঢ় হয়ে ওঠে কুড়ি রাকা’আত তারাবীহ্র সালাত আদায়ের মাধ্যমে। এ ছাড়াও এই সালাত পড়লে গোনাহরাশি ক্ষমা করা হয়। হাদিস শরীফে তারাবীহ্র সালাতের মাহাত্ম্য সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু থেকে বর্ণিত একখানি হাদিস আছে, কালা সামি’তু রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইয়াকুলুলি রমাদানা মান কামাহু ইমানানান ওয়া ইহতিসাবান গুফিরালাহু মা তাকাদ্দামা বিন যাম্বিহ্- তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ্র সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি রমাদানে ইমানের সঙ্গে সওয়াব লাভের আশায় তারাবীহ্র সালাত আদায় করবে, তাঁর পূর্ববর্তী গোনাহ্সমূহ মাফ করে দেয়া হবে (বুখারী শরীফ)। এখানে উল্লেখ যে, রমাদানের রাত্রিতে জাগরণ বা দ-ায়মান হওয়া দ্বারা তারাবীহ্র সালাতকেই বোঝানো হয়েছে। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারি মুতাবিক দ্বিতীয় হিজরীর শাবান মাসের শেষ তারিখের দিবাগত রাত তথা পহেলা রমাদান রাতে (বাদ ঈশা) সর্বপ্রথম তারাবীহ্র সালাত মসজিদুন্ নববীতে প্রিয়নবী রসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে আদায় করেন। হাদিস শরীফে আছে, আন্ আয়িশাতা রাদিআল্লাহু আন্হা যাওজিন্ নাবী রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আন্না রসূলুল্লাহ (সা) সাল্লাম ওয়া যালিকা ফী রমাদান-প্রিয়নবী রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সহধর্মিণী আয়িশা রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হা থেকে বর্ণিত আছে যে, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম সালাত (তারাবীহ্র সালাত) আদায় করেন এবং তা ছিল রমাদানে। মূলত আগে মসজিদুন্ নববীতে একাধিক জামা’আতে একই সময় তারাবীহ্র সালাত সাহাবায়ে কেরাম আদায় করতেন, কেউ কেউ একাকীও পড়তেন। তারাবীহ্র সালাতে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত সশব্দ হওয়াতে অনেকের কুরআন পাঠের আওয়াজ উত্থিত হতো, মসজিদে নববীতে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদি আল্লাহ তা’আলা আন্হু এক ইমামের নেতৃত্বে এই সালাতের জামা’আত ব্যবস্থা চালু করেন। আমরা জানি হযরত উমর ইবনুল খাত্তাবের দশ বছরের খিলাফত (৬৩৪-৬৪৪ খ্রি.) আমলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা গৃহীত হয় তার মধ্যে এই তারাবীহ্র সালাতের জামা’আত ব্যবস্থাও একটি। সম্ভবত এই জামা’আত ব্যবস্থা চালু হয় ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে। এখানে উল্লেখ্য যে, তিনি হিজরী সনের প্রবর্তন করেন ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে। একখানি দীর্ঘ হাদিসে আছে যে, হযরত রসূলুল্লাহু সাল্লাললাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি রমাদানে ইমানের সঙ্গে সওয়াব লাভের আশায় তারাবীহ্র সালাতে দাঁড়াবে তাঁর পূর্ববর্তী গোনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হবে। শিহাবের পুত্র বলেন যে, হযরত রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইন্তিকাল করলেন, তার পরও এটা এভাবে চলে আসছিল। এমনকি হযরত আবু বকর রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু (প্রায় আড়াই বছরের) খিলাফতকালে এবং হযরত উমর রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হুর খিলাফতের প্রথমভাবে এ রকমটাই ছিল। ইব্নে শিহাব উরওয়া ইব্নে যুবায়র সূত্রে আবদুর রহমান ইবনে আব্দ আল-কারী থেকে বর্ণনা করে তিনি বলেন, আমি রমাদানের এক রাতে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হুর সঙ্গে মসজিদে নববীতে গিয়ে দেখতে পেলাম যে, লোকেরা বিক্ষিপ্ত জামা’আতে বিভক্ত। কেউ একাকী সালাত আদায় করছে আবার একজন সালাত আদায় করছে আর তাঁকে ইক্তিদা করে একদল লোক সালাত্ আদায় করছে। হযরত উমর রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু (এসব দেখে) বললেন : আমি মনে করি যে, এই লোকদের একজন কারীর (ইমামের) পেছনে একত্রিত করে দিলে সেটাই উত্তম হবে। এরপর তিনি উবাই ইবনে কা’বের পেছনে সবাইকে কাতারবন্দী করে দাঁড় করিয়ে দিলেন। পরে আর এক রাতে আমি তাঁর সঙ্গে বের হলাম। তখন লোকেরা তাদের ইমামের সঙ্গে সালাত আদায়ত করছিল। হযরত উমর রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু এটা দেখে বললেন : অপূর্ব সুন্দর এই নতুন ব্যবস্থা (বুখারী শরীফ)। হযরত উসমান (রা), হযরত আলী (রা), হযরত তালহা (রা), হযরত যুবায়র (রা), হযরত আবদুর রহমান্ ইবনে আউফ (রা) সহ সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বিশ রাকা’আত তারাবীহ্র সালাত আদায় করার ব্যাপারে সবাই ঐকমত্য পোষণ করে তা আমল করতে থাকেন। এখানে উল্লেখ যে, এই সালাতে যিনি ইমাম ছিলেন সেই হযরত উবাই ইবনে কা’ব রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু প্রত্যাখ্যাত মুফতি। কুরআন মজীদ ব্যাখ্যার ব্যাপারে তিনি সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন। তিনি মদিনার সনদ লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর পা-িত্যের তারিফ প্রিয়নবী (সা) করেছেন। তাঁরই ইমামতিতে কুড়ি রাকা’আত তারাবীহ্র সালাত আদায় হয়েছিল। সেই যে বিশ রাকা’আত তারাবীহ্ সালাত জামা’আতের সঙ্গে শুরু হলো রমাদান মাসে মসজিদুুন নববীতে তা আজ আদায় হয়ে আসছে, মক্কার মসজিদুল হারামেও এই বিশ রাকা’আত সালাতুত্ তারাবীহ্ পড়া হয়। পৃথিবীর সব দেশেই বিশ রাকা’আতই পড়া হয়। তবে উপমহাদেশে সংখ্যায় কম একটি দল ৮ রাকা’আত তারাবীহ্র সালাত আদায় করে। তারা প্রধানত লা ময্হাবী নামে পরিচিত। তারা নিজেদেরকে আহলে হাদিস বলে পরিচয় দেয়। অন্যদিকে মালিকী ময্হাবের অনুসারীগণ ৩৬ রাকা’আত পড়ে বলে জানা যায়। শীআ ফিক্হ-এ রমাদান মাসে অতিরিক্ত এক হাজার রাকা’আত সালাতের উল্লেখ আছে। তারাবীহ্র সালাতে প্রত্যেক দুই রাকা’আত শেষে একটা দরুদ শরীফ পাঠ করার রীতি রয়েছে আর তা হচ্ছে আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা সাইয়্যিদিনা মওলানা মুহম্মদ। তারাবীহ্র সালাতের চার রাক’আত পরে বিরামকালে যে দ্’ুআখানি পাঠ করা হয় তা হচ্ছে : সুবহানা যিল্ মুল্কি ওয়াল মালাকুতি সুবহানা যিল্ ইয্যাতি ওয়াল আযমাতি ওয়াল হায়বাতি ওয়াল কুদরাতি ওয়াল কিবরিয়ায়ী ওয়াল জাবারুত, সুবনাহাল মালিকিল হায়য়িল্লাযী লা ইয়ানামু ওয়ালা ইয়ামুতু আবাদান, আবাদান সুব্বুহুন কুদ্দুসুন রব্বুনা ওয়া রব্বুল মালায়িকাতি ওয়াররূহ্Ñ পবিত্রতা ঘোষণা করছি সেই মহান সত্তার যিনি রাজ্য ও রাজত্বের অধিপত্তি (রাজাধিরাজ), পবিত্রতা ঘোষণা করছি সেই মহান সত্তার যিনি তাবত ইজ্জ্ত, মহত্ত্ব, প্রতাপ-প্রতিপত্তি, শক্তিমত্তা, সৌকর্য ও মাহাত্ম্যের অধিপতি, পবিত্রতা ঘোষণা করছি সেই মহান সত্তার যিনি মালিক চিরঞ্জীব, যাঁর কোন নিদ্রা নেই, যাঁর কোন মৃত্যু নেই, তিনি বর্তমান চিরদিন চিরকাল, তিনি মহিমাময় পবিত্র, তিনিই আমাদের রব্ এবং ফেরেশতাদেরও আত্মার রব। এই দু’আ পাঠ শেষে মুনাজাত করতে হয়। তারাবীহ্র মুনাজাত হিসেবে বহুল প্রচলিত মুনাজাতটি হচ্ছে : আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকাল জান্নাতা ওয়া নাউযবিকা মিনান্নার, বিরাহমাতিকা ইয়া আযীযু ইয়া গাফ্ফারু ইয়া কারীমু ইয়া সাত্তারু ইয়া রাহীমু ইয়া জাব্বারু ইয়া খালিকু ইয়া র্বারু, আল্লাহুম্মা আজিরনা মিনান্নারি ইয়া মুজীরু ইয়া মুজীরু ইয়া মুজীরু বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমীনÑহে আল্লাহ্! হে জান্নাত ও দোজখের স্রষ্টা, আমরা আপনারই নিকট চাচ্ছি জান্নাত এবং আশ্রয় চাচ্ছি দোজখের আগুন থেকে। আপনার রহমত কামনা করছি। হে প্রবল ও প্রিয়, হে মহা ক্ষমাশীল, হে মহামান্য দয়াবান, হে দোষ গোপনকারী, হে পরম দয়ালু, হে মহাপরাক্রমশালী, হে মহান স্রষ্টা, হে মহাহিতকারী, আপনি আপনার রহমত দ্বারা আমাদের দোজখের আগুন থেকে রক্ষা করুন, হে রক্ষাকারী, হে রক্ষাকারী। হে পরম করুণাময় দয়ালুদাতা। জানা যায়, বিশ রাকা’আত তারাবীহ্র সালাতের সুবিধার্থে ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান ইবনে আফ্ফান রাদিআল্লাহ্ তা’আলা আন্হু ৩০ পারা কুরআন মজীদকে ৫৪০ রুকুতে বিভক্ত করেন- যাতে প্রত্যেক দিন বিশ রাক’আত তারাবীহ্র সালাতে ২০ রুকু পাঠ করে ২৭ রমাদানের অর্থাৎ লায়লাতুল কদরে এক খতম কুরআন সমাপ্ত হয়। রমাদানুল মুবারকের এই খাস সালাতে কুরআন মজীদের তিলাওয়াত শোনা মুস্তাহাব। এই সালাত একাকী গৃহে আদায় করা যায়, তবে জামা’আতে আদায় করা উত্তম। হাদিস শরীফে আছে যে, প্রত্যেক রমাদানে হযরত রসুলুল্লাহ্ ুসাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম হযরত জিবরাঈল আলায়হিস্ সালামকে সেই রমাদান পর্যন্ত নাযিল হওয়া কুরআন মজীদে শোনাতেন এবং নিজে শুনতেন। সালাতুত্ তারাবীহ্র জামা’আতকে ঐক্য ও সংহতি স্থাপনে প্রশিক্ষণ বললে অত্যুক্তি হবে না। মাহে রমাদানেই এই সালাত আদায় করতে হয়, যে কারণে এর গুরুত্ব ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অপরিসীম। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা) সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×