ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

বাজেট ২০১৬-১৭ ॥ আয়কর প্রস্তাবগুলো পুনর্বিবেচনাযোগ্য

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ১০ জুন ২০১৬

বাজেট ২০১৬-১৭ ॥ আয়কর প্রস্তাবগুলো পুনর্বিবেচনাযোগ্য

মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ। অভিনন্দন, কারণ তিনি ৮৩ বছর বয়সে ‘বিশাল’ এক বাজেট জাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন যা তার দশম বাজেট। এটা একটা বিরল ঘটনা এবং তার জন্য সম্মানের বিষয়ও। অন্যদিকে ধন্যবাদ, বাজেটের পর পর বাজারে যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে তা এবার হয়নি। বাজেটের কারণে চাল, ডাল, নুন, তেলের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস অথবা শাক-সবজির দাম বাজারে বাড়েনি। বেড়েছে অনেক জিনিসের দাম, তবে এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় ও ভোগ্যপণ্য নয়। বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কা-টি ঘটে গেছে বাজেটের আগেই। এই ক্ষেত্রে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এবার অসফল। গতবার কিন্তু এমন হয়নি। এবার বাজার তার কথা শোনেনি। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা তার কথা শোনেননি। এই বাস্তবতা অস্বীকার করা ঠিক হবে না। দেখা যাচ্ছে উনি বলছেন বাজারে অতিরিক্ত চাহিদার সৃষ্টি হয়েছে। সরবরাহ ঠিক আছে। এ কথাই যদি সত্যি হয় তাহলে তো পরোক্ষভাবে তিনি স্বীকারই করলেন মূল্যবৃদ্ধির কথা। কারণ তিনি জানেন অতিরিক্ত চাহিদা, অতিরিক্ত সরবরাহ দ্বারা বাজার মোকাবেলা করতে হয়। তবে এও ঠিক, আমাদের ব্যবসায়ীরা তাদের ইজ্জতও রাখতে জানেন না, ধর্মীয় চেতনার ইজ্জতও রাখতে জানেন না। কারণ দেখা যাচ্ছে রোজার মাসে তাদের একটা বিরাট অংশ ধর্মপ্রাণ লোকদের কষ্ট দেন। শুনেছি অনেক দেশের ব্যবসায়ীরা ধর্মীয় উৎসবকালে দোকানে দোকানে ন্যায্যমূল রক্ষা করেন। আমরা কেন সেই দলে নই, মাঝে মাঝে একথা ভাবি। মুশকিল হচ্ছে আমার ও পাঠকদের ভাষা দিয়ে তো কাজ হবে না। আমরা ভাবি রোগীদের, অসুস্থদের, বয়স্কদের ওষুধের দাম যেন না বাড়ে। ওষুধ ভোগ্যপণ্য নয়, বাঁচা-মরার জন্য প্রয়োজনীয়। এবারের বাজেটে কোন ফাঁকে কী কর বসেছে, দেখা যাচ্ছে প্রায় সব ওষুধ কোম্পানি ওষুধের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ‘ইসিজি’র রিডিং লেখার কী কাগজের ওপর কর বসেছে, শুনলাম ‘ইসিজির’ চার্জ বেড়েছে। এসব মানুষকে ভাবায়, সাধারণ মানুষকে ভোগায়। তাই বলে কী বাজেটের প্রশংসার কোন দিক নেই? আমি বাজেটের (২০১৬-১৭) আকার নিয়ে কথা বলি না। কারণ আকার আমাদের সমস্যা নয়, সমস্যা খরচের গুণগতমান। মাননীয় অর্থমন্ত্রী সংসদেই বলেছেন শিক্ষার গুণগতমান সম্পর্কে। এমপিওভুক্ত এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই নাকি কোন কাজের নয়- খামোখা। অথচ এর জন্য অর্থবরাদ্দ আছে। উন্নয়ন বাজেটের অর্থ তো ‘হরিলুট’ হয়। এক টাকার কাজ দুই টাকায় হতো, এখন কততে হয় কেউ জানে না। জেলখানার কয়েদিদের পর্যন্ত খাবার দেয়া হয় না। টাকা মেরে খাওয়া হয়, কয়েদিরা নিজের টাকা দিলে তারপর খাবার মিলে। হাসপাতালে রোগীদের খাবার থেকে ‘লুট’ করা হয়। এসবই বাজেটের দুর্বল দিক। গুণগতমান না- রক্ষার দিক। অথচ এটি হলে এতবড় বাজেটের দরকার হতো না। অথবা এই বাজেটেই কাজ হতো দেড়গুণ-দ্বিগুণ। কী কা- হতো বলুন। দুঃখ লাগে যখন দেখি সরকারের আকার বড় হচ্ছে। আমাদের বলা হতো বেসরকারীকরণ হলে, কম্পিউটারায়ন হলে শ্রমের দক্ষতা বাড়বে। কর্মীর দক্ষতা বাড়বে। ছোট দেশ, ঢাকা থেকে মোবাইলে দেশ চালানো হবে। না, এখন দেখছি ‘সচিবরা’ কাজ করতে পারছেন না, লাগছে সিনিয়র সচিব। এক সচিবের স্থলে লাগবে দুই সচিব, এক যুগ্মসচিবের স্থলে লাগছে দুই যুগ্মসচিব। থানার পর থানা হচ্ছে। একটার পর একটা সরকারী অফিস হচ্ছে। সরকারের নাকি এখন জনবল ১২-১৫ লাখ। ফল? ফল খুবই নেতিবাচক। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ টাকা যাবে প্রশাসনকে পুষতে। দিন দিন অবসরভোগী লোক বাড়ছে। তাদের পুষতে আগামীতে লাগবে বিশাল অঙ্কের টাকা। এসব দিক আমাদের বাজেটের দুর্বল দিক। তবে দিন দিন উন্নয়ন বাজেটের আকার বড় হচ্ছে, এটা ভাল দিক। অবশ্য উন্নয়ন বাজেট সরকারী ব্যয়নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। কারণ, বেসরকারী বিনিয়োগ কমছে অথবা বাড়ছে না। বাজেটে মাননীয় অর্থমন্ত্রী বেসরকারী খাতের কর্মজীবীদের ব্যাপারে উদ্বেগ দেখিয়েছেন। তাদের জন্য ‘পেনশন’ প্রকল্প করবেন তিনি, খুব ভাল খবর। প্রতিবন্ধীদের যারা চাকরি দেবে তাদেরকে তিনি আর্থিক সুবিধা দেবেন। খুবই উৎসাহব্যঞ্জক খবর। কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়িয়েছে- এটাও ভাল খবর। কারণ, এর সুবিধাভোগী আমরা সবাই। পেটে দুটো ভাত আছে এটা বড় সুখবর। তা না হলে কথা বলা যেত না। কৃষির অগ্রগতি এখনও বহাল আছে। শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে তিনি বরাদ্দ বাড়িয়েছেন এর জন্য অর্থমন্ত্রী ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখেন। কারণ শিক্ষার অবনতি ঘটছে। জিপিএ-৫ পাওয়া ছেলেমেয়েরা বিজয় দিবস কবে তা জানে না। খুবই নৈরাশ্যজনক অবস্থা। এই অবস্থার অবনতি যাতে আর না হয়। মূল্যস্ফীতির হার ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। তিনি এটা কমিয়ে ৫ দশমিক ৮ শতাংশে আনবেন। প্রবৃদ্ধির হার আরও বাড়াবেন, করবেন ৭ দশমিক ২ শতাংশ। এসব আনন্দের খবর। এর জন্য তিনি বড় বাজেটের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু রাজস্বের ক্ষেত্রে বড় বেশি এগোতে পারেননি। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা তাকে আটকে দিয়েছেন। তিনি যে ‘ভ্যাট’ দিয়ে রাজস্ব বাড়ানোর বড় পরিকল্পনা করেছিলেন তা নিয়ে এগোতে পারেননি। ব্যবসায়ীরা প্রতিবাদমুখর। তারা চান না ১৫ শতাংশ গড় ভ্যাট হোক। ভ্যাটে এগোতে না পেরে তিনি বিচ্ছিন্নভাবে নানা জায়গা থেকে রাজস্ব বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু দিনের শেষে দেখা যাচ্ছে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি হবে ৯৭,৮৫৩ কোটি টাকা, সংশোধিত (২০১৫-১৬) বাজেটে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৮৭,১৬৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি বছরে বাজেট ঘাটতি জিডিপির তুলনায় ৫ শতাংশ, আগামী বছরেও তাই হবে। কিন্তু ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ৩ দশমিক ৯ শতাংশ ছিল। এটা খারাপ লক্ষণ। তবে ঘাটতি এখনও উদ্বেগজনক স্তরে যায়নি। ঘাটতি বাজেটের অন্যতম কারণ রাজস্ব আহরণের মাত্রা কম, আবার উন্নয়ন বাজেট বড়। সবচেয়ে বড় কারণ কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি। ‘না চাইতেই বৃষ্টি’। কেউ বেতন বাড়বে দ্বিগুণ আশা করেনি। কিন্তু তা করেছে। কিন্তু এর প্রতিদানে কী কর্মচারীরা দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ করছে, বিশেষ করে পহেলা বৈশাখে ‘ইলিশ’ বোনাস দেয়ার পর? না, এর কোন নিশ্চয়তা নেই। সরকার চলবে সরকারের মতো। ঘাটতি পূরণে সরকার নির্ভর করবে ব্যাংক ঋণের ওপর। এর এবার সুবিধা দুটো। সুদের হার কম। দ্বিতীয়ত ব্যাংকে ব্যাংকে প্রচুর টাকা। তৃতীয়ত সুবিধাটা খুবই বড়। ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিলে খেলাপী ঋণ বাড়ার সম্ভাবনা নেই। বেসকারী খাতে ঋণ দিলে খেলাপী ঋণ বাড়ে। ‘ব্যাংক ঋণ নির্ভর’ শিল্পায়ন নীতি যে খেলাপী ঋণ বাড়ার বড় কারণ এ কথা কেউ বলে না। নিজের টাকায় শিল্প ও ব্যবসা কর, স্টক এক্সচেঞ্জের টাকায় ব্যবসা করÑ না, একথা কেউ বলে না। সবার অভিযোগ খেলাপী ঋণ নিয়ে। এখানে দেখা যাচ্ছে সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রিও নিরুৎসাহিত করবে না। মজার বিষয় সবাই বলে সরকারের সুদ ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। অথচ তথ্যে দেখা যাচ্ছে সুদ ব্যয় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে হ্রাস পাবেÑ অবশ্যই তা জিডিপির অনুপাতে। বাজেটে (২০১৬-২০১৭) বড় বড় ‘মেগাপ্রকল্প’ এর দিকে নজর বেশি দেয়া হয়েছে। ক্ষতি নেই যদি দেশের ছোট ছোট চাহিদা মেটানোর পর তা হয়। গ্রাম-গঞ্জের রাস্তাঘাট অচল রেখে শহরের অলিগলি অচল রেখে মেগাপ্রজেক্ট করলে ফল কিন্তু পরিণামে ভাল হবে না। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট দেখে করদাতারা হতাশ। সাধারণ করদাতারা হতাশ। দেশে মূল্যস্ফীতি হলো ৬ শতাংশের। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। অথচ করদাতাদের কোন রেয়াত দেয়া হলো না। করমুক্ত আয় একই রাখা হলো না। এতে কোন নড়ন-চড়ন নেই। ঠিক আছে। কিন্তু পোশাক ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে কী করা হলো? রাজস্ব বোর্ডই বলছে এরা ‘ট্যাক্স রিটার্ন’ দেয় না। অর্থাৎ কর দেয় না, হিসাব দেয় না। কিন্তু বাজেটে কী- করা হলো? কোন কোম্পানির কর হ্রাস নেই, কিন্তু পোশাক কারখানার মালিকদের কোম্পানির কর হার ৩৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে হ্রাস করা হলো। এর অর্থ কী? এরা ‘ধমক’ দিতে পারে বলে, এরা সংগঠিত বলে? এরা সংসদে ভালো সংখ্যায় আছে বলে? উত্তর পাই না। ঠিক আছে উত্তর নেই। তাহলে সাধারণ করদাতাদের কিছু একটা দিলে কী হতো? উল্টো বরং দেখা যাচ্ছে সাধারণ করদাতাদের কর বাড়ানোর আয়োজন করা হয়েছে। একজন করদাতা তাদের আয়ের ৩০ শতাংশ পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে পারত। এই বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগের ওপর ‘ট্যাক্স ক্রেডিট’ পাওয়া যেত ১৫ শতাংশ। বাজেটে এর ওপর আক্রমণ করা হয়েছে। বিনিয়োগের সীমা ৩০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে হ্রাস করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ‘ট্যাক্স ক্রেডিট’ বা কর রেয়াতের পরিমাণও হ্রাস করা হয়েছে। ১৫ শতাংশ কেউ কেউ পাবে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে রেয়াতের পরিমাণ হবে ১০ শতাংশ। এই পদক্ষেপের ফলে মধ্যবিত্ত করদাতাদের করের বোঝা যে বৃদ্ধি পাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তারপর বলা হয়েছে এখন থেকে সঞ্চয়পত্রে প্রদত্ত সুদের ওপর থেকে ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর কেটে রাখা হবে। এটাও যে একটা বোঝা হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। সঞ্চয়পত্র কেনে কারা? সঞ্চয়পত্র কেনার উর্ধসীমা আছে। যে কেউ যথেচ্ছ পরিমাণ সঞ্চয়পত্র ক্রয় করতে পারে না। সঞ্চয়কারীদের শ্রেণীভেদে উর্ধতম সীমা নির্ধারিত করা আছে। এখানে ধনীদের সঞ্চয়ের কোন ব্যবস্থা নেই। এমতাবস্থায় বলাই যায় এই পদক্ষেপও মধ্যবিত্ত সঞ্চয়কারী-করদাতাদের বিরুদ্ধে যাবে। সবচেয়ে প্রশ্নের বিষয় হচ্ছে প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটির বিষয়টি। এগুলো অবসরপ্রাপ্তরা নিয়োগদাতাদের কাছ থেকে পান অবসরের সময়। এ দুটো অবসরপ্রাপ্তদের সারা জীবনের সঞ্চয়। রাজস্ব বোর্ডের অনুমোদন নিয়েই এসব ফান্ড তৈরি করা হয়। এর ওপর করের প্রস্তাব বিষয়টা বুঝলাম না। সরকার কী চায় আসলে? সঞ্চয় বলে কিছু থাকবে না, অবসরপ্রাপ্ত লোকদের সুবিধা-অসুবিধা বলে কিছু থাকবে না? সরকারকে এসব বিষয়ে ভাবতে হবে। মনে হয়, সরকার রাজস্ব বৃদ্ধির কোন পথ না পেয়ে বর্তমান করদাতাদের ওপরই চড়াও হচ্ছেন। সাধারণ করদাতারাই ভরসা ভ্যাটের ক্ষেত্রে। ভ্যাট পরোক্ষ একটা কর। আয়কর প্রত্যক্ষ কর। কিন্তু এটি অগ্রিম আয়কর কাটার বেনামীতে পরোক্ষ করে পরিণত হয়েছে। এর অর্থ এসব করের বোঝা সাধারণ লোক বহন করবে। আবার সাধারণ করদাতাদের আয়করও বাড়ানো হচ্ছে। সরকার মনে হচ্ছে দিশেহারা হয়ে পড়ছে। অথবা কেউ না কেউ সরকারকে দিশেহারা বানাচ্ছে। বিষয়টি খুবই দুশ্চিন্তার। লেখক : সাবেক শিক্ষক ঢাবি
×