ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

টুটুল মাহফুজ

কিংবদন্তি সঙ্গীতজ্ঞ রজার ওয়াটার্স

প্রকাশিত: ০৭:২৯, ৯ জুন ২০১৬

কিংবদন্তি সঙ্গীতজ্ঞ রজার ওয়াটার্স

কিংবদন্তি সঙ্গীতজ্ঞ রজার ওয়াটার্স। যিনি ছিলেন সর্বকালের ইতিহাসের সেরা রক ব্যান্ড পিংক ফ্লয়েডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। পুরা নাম জর্জ রজার ওয়াটার্স। ১৯৪৩ সালে ইংল্যান্ডের গ্রেট বুকহাম শহরে জন্মগ্রহণ করেন এই বহু বাদ্যযন্ত্রী ব্যক্তিত্ব। ১৯৬৫ সালে তিনি সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে, ড্রামার নিক মেসন, কিবোর্ডবাদক রিচার্ড রাইট এবং গীটারবাদক, গায়ক ও গীতিকার সিড ব্যারেটের সহযোগে প্রগ্রেসিভ রক ব্যান্ড পিংক ফ্লয়েড গঠন করেন। ওয়াটার্স প্রাথমিকভাবে দলটির বেসবাদক এবং সহ-প্রধান গায়ক হিসেবে কাজ করেছেন, তবে ১৯৬৮ সালে, বারেট দল ত্যাগ করলে তিনি পিংক ফ্লয়েডের গীতিকার এবং অগ্রদূত হয়ে ওঠেন। ‘দ্য ডার্ক সাইড অব দ্য মুন’, ‘উইস ইউ ওয়ার হেয়ার’, ‘এ্যানিমেলস’, ‘দ্য ওয়াল’ এবং ‘দ্য ফাইনাল কাট’ এ্যালবামের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সাফল্য অর্জন করেন। আশির দশকের শুরুতে, তারা সমালোচকদের কর্তৃক প্রশংসিত এবং পৃথিবীব্যাপী জনপ্রিয় সঙ্গীত ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ বিক্রয়ের ব্যান্ড হিসেবে গৌরব অর্জন করে। ২০১৩ সালের হিসেবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৭৫.৫ মিলিয়নসহ, বিশ্বব্যাপী তাদের ২৫০ মিলিয়নের অধিক এ্যালবাম বিক্রি হয়েছে। ওয়াটার্স ১৯৮৫ সালে পিংক ফ্লয়েড থেকে প্রস্থান করেন এবং অবশিষ্ট সদস্যদের সঙ্গে ব্যান্ডের নাম এবং উপাদান ব্যবহার নিয়ে আইনী বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৮৭ সালে তারা আদালতের বাইরে এ-বিষয়ের নিষ্পত্তি ঘটান এবং আঠার বছর পর ওয়াটার্স পুনরায় পিংক ফ্লয়েডের সঙ্গে কাজ শুরু করেন। এছাড়া ‘দ্য প্রস এ্যান্ড কনস অফ হিচ হাইকিং’, ‘রেডিও কেএওএস’ এবং ‘এমিউজড টু ডেথ’ ওয়াটার্সের একক এ্যালবাম। ১৯৯০ সালে, তিনি দ্য ওয়াল লাইভ ইন বার্লিন নামে, ইতিহাসের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে ব্যয়বহুল রক কনসার্ট মঞ্চস্থ করেছিলেন, যেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রায় ২ লাখ দর্শক উপস্থিত ছিল। রজার অতি বড় মাপের সঙ্গীতব্যক্তিত্ব। তিনি খুব সক্রিয়ভাবে ইসরাইলের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি নিজে গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক দীর্ঘ সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘১৯৮০ সালে আমি একটি গান লিখি, ‘এ্যানাদার ব্রিক ইন দ্য ওয়াল পার্ট-২’। দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার এটি নিষিদ্ধ করে। সেদেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গ শিশুরা সম-অধিকারের কথা তুলতে এ গানটি ব্যবহার করত বলে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। তখনকার বর্ণবাদী সরকার আমার গানসহ বেশ কিছু গানের ওপর একধরনের সাংস্কৃতিক অবরোধ আরোপ করেছিল। ২৫ বছর পর ২০০৫ সালে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে এক উৎসবে যোগ দেয়া ফিলিস্তিন শিশুরা পশ্চিম তীরকে ঘিরে ইসরাইলের দেয়াল তোলার প্রতিবাদ জানাতে সেই গানটি ব্যবহার করে। তারা গায়Ñ ‘ইউ ডোন্ট নিড নো অকুপেশন! উই ডোন্ট নিড নো রেসিস্ট ওয়াল!’ (আমাদের কোন দখলদারির দরকার নেই! দরকার নেই কোন বর্ণবাদী দেয়াল!) আমি তখনও স্বচক্ষে দেখিনি গানে তারা কিসের কথা বলতে চাইছে। পরের বছর তেল-আবিবে গান পরিবেশন করার ব্যাপারে আমার সঙ্গে চুক্তি হয়। চুক্তিটি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানান কিছু ফিলিস্তিনী। তারা ইসরাইলকে শিক্ষায়তনিক ও সাংস্কৃতিক বয়কটের আন্দোলনে সক্রিয়। দেয়ালের বিরুদ্ধে আমি আগেই জোরালো অবস্থান নিয়েছিলাম। কিন্তু সাংস্কৃতিক বয়কটের পথ ঠিক কিনা, তা নিয়ে তখনও আমি দ্বিধাগ্রস্ত। বয়কটের পক্ষের ফিলিস্তিনীরা আমার কাছে আহ্বান জানালেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে স্বচক্ষে দেয়াল দেখতে আমি যেন পশ্চিম তীরে যাই। আমি রাজি হলাম। জাতিসংঘের নিরাপত্তাধীন জেরুজালেম ও বেথলেহেম সফর করলাম। সেদিন যা দেখলাম, তার জন্য কোনভাবেই প্রস্তুত ছিলাম না। দেয়ালটি দেখতে মর্মান্তিক। ইসরাইলী তরুণ সেনারা দেয়ালের পাহারায়। তারা আমাকে বাইরে থেকে আসা নৈমিত্তিক কোন দর্শক ভেবেছে। আমার প্রতি তাদের আচরণ ছিল ঘৃণাপূর্ণ আগ্রাসী। আমি বিদেশী, একজন দর্শক। আমার প্রতিই যদি এমন আচরণ করা হয়, তাহলে একবার ভাবুন তো কেমন আচরণ করা হয় ফিলিস্তিনীদের প্রতি, নিম্নশ্রেণীর মানুষের প্রতি কিংবা পাসবুক বহনকারীদের প্রতি। তখন বুঝলাম, সেই দেয়ালের থেকে, আমার দেখা সেই ফিলিন্তিনীদের ভাগ্যের থেকে আমাকে পালিয়ে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে দেবে না আমার বিবেক। আমার দেখা সেই ফিলিন্তিনীদের জীবন নিত্য চূর্ণ-বিচূর্ণ হচ্ছে ইসরাইলী দখলদারিতে। তাদের প্রতি সংহতি জানিয়ে (আর কিছুটা অক্ষমতা থেকেও) সেদিন আমি দেয়ালে লিখলাম, ‘উই ডোন্ট নিড নো থট কন্ট্রোল’ (আমাদের চিন্তা নিয়ন্ত্রণের কোন দরকার নেই)। সেই মুহূর্তে উপলব্ধি করলাম, তেল-আবিবের মঞ্চে আমার উপস্থিতি ইচ্ছানিরপেক্ষভাবে আমার দেখা নিপীড়নকেই বৈধতা দেবে। সেই অনুভব থেকে তেল-আবিব স্টেডিয়ামে গান পরিবেশনের চুক্তি বাতিল করে সরিয়ে নিলাম ‘নেবে শালমে’। (নেবে শালমের অর্থ শান্তির মরূদ্যান। ইসরাইলী আরব আর ইসরাইলী ইহুদীদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের চেষ্টায় গড়ে তোলা সম্প্রীতির গ্রাম)। এখানকার বাসিন্দারা কৃষিজীবী আর বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে নিবেদিত। এখানে মুসলমান, খ্রীস্টান ও ইহুদীরা পাশাপাশি সম্প্রীতির বন্ধনে বসবাস করে।’ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়ে গেছে পিংক ফ্লয়েড দলটি। ঘোষণা দেয়া হয়েছে, আর গাইবে না পিংক ফ্লয়েড। দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য গীটারিস্ট সিড ব্যারেট অনেক আগেই চলে গেছে সঙ্গীত ছেড়ে। ড্রামার নিক মেসন, কীবোর্ডবাদক রিচার্ড রাইটও আর পৃথিবীতে নেই। বাকি আছে দলপতি গীটারিস্ট ডেভিড গিলমোর এবং রজার ওয়াটার্স। এরা সবাই বেঁচে থাকবেন হাজার বছর।
×