ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সিজার পদ্ধতিতে সন্তান প্রসব আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে

প্রাইভেট হাসপাতাল ক্লিনিকে চলছে প্রসূতিবাণিজ্য

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ৯ জুন ২০১৬

প্রাইভেট হাসপাতাল ক্লিনিকে চলছে প্রসূতিবাণিজ্য

নিখিল মানখিন ॥ দেশে স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় সিজারিয়ান পদ্ধতিতে সন্তান জন্ম হওয়ার হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। সরকারী জরিপেও এ তথ্যটি উঠে এসেছে। পরিসংখ্যান এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিজারিয়ান পদ্ধতিতে যে সংখ্যক নবজাতক জন্ম হচ্ছে এর ৩৫ শতাংশই অপ্রয়োজনীয়। প্রতি একশ’ নবজাতকের মধ্যে ২৩ জনেরই জন্ম হচ্ছে সিজারের মাধ্যমে। অথচ সিজারিয়ান পদ্ধতিতে সন্তান জন্ম হওয়ার পর মা ও সন্তান দু’জনই যে দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে- সেই বিষয়টি জানানো হচ্ছে না। অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য এক শ্রেণীর চিকিৎসক অপ্রয়োজনে সন্তানসম্ভবা মায়েদের সিজারিয়ান পদ্ধতিতে ডেলিভারি করাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০১৩ সালের সরকারী তথ্য অনুযায়ী, ওই বছর দেশের প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সন্তান প্রসবের জন্য ভর্তি হয়েছিল এক লাখ ৬৬ হাজার ৭২১ জন প্রসূতি। তাদের মধ্যে এক লাখ ১৭ হাজার ১৬৪ জনের সিজার করে সন্তান হয়েছে। আর মাত্র ৪৭ হাজার ৮৬৮ জনের হয়েছে নরমাল ডেলিভারি। অর্থাৎ তখন সিজারিয়ানের হার ৭০ শতাংশ থাকলেও চলতি ২০১৫ সালে এ হার প্রায় ৮০ শতাংশে উঠে গেছে বলে জানিয়েছে প্রসূতিসেবা বিশেষজ্ঞরা। গবেষণায় দেখা গেছে- প্রকৃতপক্ষে ১০০ সিজারিয়ান প্রসূতির মধ্যে ১৫ থেকে ২০ ভাগেরও সিজারের দরকার ছিল না। ৮০ ভাগেরই নরমাল ডেলিভারি করা যেত। কিন্তু একটি মহলের প্রচারণার কারণে ক্ষতিকর এ পথটিই অনুসরণ করা হয়েছে সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক এ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস)-২০১৪-এর তথ্যানুযায়ী, দেশে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ১০টির মধ্যে ৬টি শিশুরই জন্ম হচ্ছে সিজারিয়ান পদ্ধতিতে। এক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ অস্ত্রোপচার হচ্ছে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে। সমাজে সবচেয়ে শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারের ৫০ শতাংশ শিশুর জন্ম হচ্ছে অস্ত্রোপচারে। প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান এবং সচ্ছল পরিবারে এই হার অনেক বেশি। ২০০৪ সালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম হতো ৪ শতাংশ শিশুর। ২০০৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ শতাংশে। ২০১১ সালে তা ছিল ১৭ শতাংশ। আর ২০১৪ সালে তা দেড়গুণের বেশি বেড়ে হয়েছে ২৩ শতাংশ। দেশে আশঙ্কাজনক হারে সিজারের প্রবণতা বেড়েই চলেছে- এমন মত প্রকাশ করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের প্রসূতি ও ধাত্রী বিভাগের পরামর্শক ডাঃ ফারজানা ডালিয়া বলেন, সিজার এখন স্বাভাবিক ঘটনায় দাঁড়িয়ে গেছে। দিন যত এগুচ্ছে এর প্রবণতাও বাড়ছে। যা মোটেই সুখকর সংবাদ নয়। এরজন্য শুধু এক শ্রেণীর অসাধু ডাক্তার-হাসপাতালকে দায়ী করলে সমস্যার সমাধান হবে না। আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ইদানীং শহরকেন্দ্রিক সিংহভাগ মা ও তার পরিবার সিজার নামক শর্টকাট পদ্ধতিতে সন্তান জন্ম দিতে চান। তারা স্বাভাবিক প্রসবের জন্য ২/৩ দিন অপেক্ষা এবং প্রসবের ব্যথা সহ্য করতে চান না। এটাই হলো বর্তমান সময়ের নির্মম বাস্তবতা। প্রসূতি মা নিয়ে বিভিন্ন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসকদের ব্যবসা ॥ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিজারিয়ান সেকশন এখন দেশের বেশিরভাগ প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকের বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এ প্রবণতা রোধ তো করা যাচ্ছেই না, বরং দিন দিন প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। কোন প্রসূতি পেলেই প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর এক শ্রেণীর চিকিৎসক থেকে শুরু করে সবাই বিভিন্ন অজুহাতে রোগীকে নরমাল ডেলিভারির ব্যাপারে কৌশলে মানসিকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে। এমনকি সিজার না হলে মা কিংবা নবজাতকের ক্ষতি হওয়ার ভয়ও দেখানো হয় অনেক ক্ষেত্রে। নিরুপায় হয়ে প্রসূতি ও তার স্বজনরা নিরাপদ মাতৃত্ব ও সুস্থ সন্তানের স্বার্থে হাসপাতালের প্রত্যাশায় সায় দেয়। আর সিজারিয়ানের মাধ্যমে প্রসব পদ্ধতিতে রাজি হলেই শুরু হয় টাকা হাতানোর হিসাব কষাকষি। অভিযোগ উঠেছে, নরমাল ডেলিভারির চেয়ে সিজারিয়ানে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক অনেক বেশি টাকা পায়। হাসপাতাল বা ক্লিনিক কর্তৃপক্ষেরও এতে ব্যবসা বেশি। কারণ বেশি সময় হাসপাতালে থাকতে হয়, ওষুধ বেশি লাগে, অপারেশন থেকে শুরু করে অন্যান্য খরচও বেশি আদায় করা হয়। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে অপারেশনের পর প্রসূতির অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের জীবাণু আক্রমণ দেখা দেয়। এতে হাসপাতালের ব্যবসা বেড়ে যায়। আর নরমাল ডেলিভারি হলে রোগী এক-দুই দিনের মধ্যে বাসায় চলে যেতে পারে। কিন্তু সিজারিয়ান হলে আগে-পরে মিলিয়ে রোগীকে প্রায় এক সপ্তাহ থাকতে হয়। এতে হাসপাতালের কেবিন বা বেড ভাড়া ও বিভিন্ন সার্ভিস চার্জের নামে অনেক বেশি টাকা আদায় করা সম্ভব। প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকের দেখাদেখি এখন সরকারী ও বিভিন্ন এনজিওর হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোয়ও সিজারিয়ানের প্রবণতা বাড়ছে। বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস পেয়ে প্রতি লাখে জীবিত জন্মে ১৯৪ এ কমে এসেছে বলে দাবি করে আসছে সরকার। কিন্তু সরকার ঘোষিত মাতৃহার হ্রাসের পরিসংখ্যান ও প্রচলিত মাতৃস্বাস্থ্য সেবার কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস পেলেও মায়েদের সার্বিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য দেশে এখনও স্থায়ী ব্যবস্থাপনা নেই। মায়ের গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসব পরবর্তী যতেœর অভাব প্রকট রয়েই গেছে। আর মায়েদের সার্বিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থাপনা না থাকায় তাদের বড় একটি অংশ সব সময় ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। মাতৃস্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম শুধু সন্তান প্রসবকেন্দ্রিক সেবার মধ্যেই সবাই সীমাবদ্ধ থাকছে। সন্তান প্রসবের ৪২ দিনের মধ্যে যারা মারা যান, তাদর ধরেই এ হিসাব করা হয়। কিন্তু একই ধারাবাহিকতায় এর পরবর্তীতে যারা মারা যান, তাদের হিসাব থাকে না, যা মোটেই সমীচীন নয়। তাই মাতৃমৃত্যুর হিসাব করলে সব মায়ের হিসাব করা দরকার। একইভাবে মাতৃস্বাস্থ্য সেবা বললে সব মায়ের স্বাস্থ্যসেবাকে বিবেচনায় নিতে হবে। মাত্র ৪২ শতাংশ প্রসব প্রশিক্ষিত সেবিকার হাতে হয়ে থাকে ॥ বাংলাদেশ ডেমোগ্রফিক এ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১৪-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩১ লাখ শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ৫ হাজার ২৭০ জন মায়ের মৃত্যু হয়। অর্থাৎ ৬০০ শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ১ জন মা মারা যান। মাত্র ৪২ শতাংশ প্রসব প্রশিক্ষিত সেবিকার হাতে হয়ে থাকে। বাকি ৫৮ শতাংশ গর্ভবতীর ডেলিভারি অপ্রশিক্ষিত ধাত্রী বা আত্মীয়-স্বজনের হাতে হয়ে থাকে। এর মধ্যে আবার ৬৩ শতাংশ গর্ভবতীর প্রসব বাড়িতে হয়ে থাকে। আর মাত্র ৩৭ শতাংশ গর্ভবতীর ক্লিনিক বা হাসপাতালে প্রসব হয়ে থাকে। মা ও শিশু মৃত্যুর অন্যতম কারণ বাড়িতে অপ্রশিক্ষিত ধাত্রী বা আত্মীয়স্বজনের দ্বারা প্রসব করানো।
×