ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গীবিরোধী কম্বিং অপারেশন শুরু

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৯ জুন ২০১৬

জঙ্গীবিরোধী কম্বিং অপারেশন শুরু

শংকর কুমার দে ॥ সরকারের নীতি নির্ধারক মহলের নির্দেশে দেশব্যাপী শুরু হয়েছে জঙ্গীবিরোধী কম্বিং অপারেশন। জিরো টলারেন্স দেখানো হবে জঙ্গীগোষ্ঠীকে। দেশব্যাপী বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক পরিধি। সমন্বয় করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সকল ইউনিটে। গোয়েন্দা নজরদারি করা হচ্ছে জামায়াত-শিবির প্রাধান্য এলাকায়। জামায়াত-শিবিরের অনেক ক্যাডার যোগ দিয়েছে জঙ্গীগোষ্ঠীতে। চট্টগ্রামে পুলিশের এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু খুনের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার উর্ধতন কর্মকর্তাদের মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। টার্গেট কিলিং ও জঙ্গী তৎপরতার বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে সরকারের নীতি নির্ধারক মহলে। আজ বৃহস্পতিবার পুলিশের আইজি শহীদুল হক বিদেশ থেকে ফেরার পর পুলিশ সদর দফতরে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে এবং এই বৈঠক থেকে জঙ্গীবিরোধী অভিযানের বিষয়ে কঠোর বার্তা পৌঁছে দেয়ার নির্দেশনা আসতে পারে বলে জানা গেছে। সরকারের উচ্চপর্যায় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের অনেকেই যুক্ত হয়ে টার্গেট কিলিং করছে। একের পর এক এসব ঘটনার ফলে বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের কাছে দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হচ্ছে। দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য একের পর এই ধরনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থা ও দেশের রাজনীতিকরা জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। চট্টগ্রামে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতুর খুনের মাত্র ছয় ঘণ্টা ব্যবধানে নাটোরে খুন হয়েছেন খ্রীস্টান ব্যবসায়ী খ্রীস্টান সুনীল গোমেজ খুনের ঘটনার পর জঙ্গীবিরোধী অভিযানকে জোরদার করা হয়। শুধু তাই নয়, এই দুইটি খুনের ঘটনার মধ্যেই ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নলডাঙা ইউনিয়নের মহিষারভাগাড় এলাকায় সনাতন ধর্মাবলম্বী ৭০ বছরের বৃদ্ধ এক পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলির গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়াও যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহে গত চব্বিশ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে চারজনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এসব ঘটনায় জঙ্গীবিরোধী অভিযান জোরদার করার সিদ্ধান্ত হয়। তবে জঙ্গীবিরোধী অভিযান শুরুর বিষয়টি প্রকাশ্যে ঘোষণা না দিয়েই শুরু করা হয়েছে বলে জানা গেছে। পুলিশের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা জানান, জঙ্গীবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে জঙ্গীদের বন্ধুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। এতে রাজধানীর পল্লবীতে তারেক হোসেন ও সুলতান আহমেদ নামে দুই জেএমবির জঙ্গী পুলিশের সঙ্গে বন্ধুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। এ ছাড়াও রাজশাহীর বাগমারায় আমদিয়া মসজিদে বোমা হামলাকারী জেএমবির সদস্য জামালউদ্দিনও বন্ধুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। কম্বিং অপারেশনে জঙ্গীপ্রবণ জেলাগুলোকে বিশেষ প্রাধান্য ও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানান, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন জামা’য়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাত উল জিহাদ (হুজি), হিযবুত তাহরীর ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সদস্যদের খুঁজে বের করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই জঙ্গী সংগঠনগুলোর সদস্যরা কোথায় থাকে, কারা তাদের আশ্রয় দিচ্ছে, কিভাবে এসে খুন করে যাচ্ছে সেই বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি ও প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানান, জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম পৃথক ‘সেল’ তৈরি করে টার্গেট কিলিং করছে বলে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে। এসব জঙ্গীগোষ্ঠীর সদস্যদের সহায়তা করছে জামায়াত-শিবির। টার্গেট কিলিংয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবিটির শীর্ষ পর্যায়ে আছেন পলাতক মেজর (চাকরিচ্যুত) জিয়াউল হক জিয়া। তার সেকেন্ড ইন কমান্ড হলেন শরিফুল ওরফে সাকিব ওরফে সালেহ ওরফে আরিফ ওরফে হাদী-১। শরিফুল একাই আটজন লেখক-প্রকাশক ও ব্লগার হত্যাকা-ে সরাসরি অংশ ও পরিকল্পনায় ছিলেন। এছাড়া লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ তিনজনকে হত্যাচেষ্টায় ঘটনায় তিনি জড়িত ছিলেন। এ ছাড়াও জেএমবির অন্তত চারজন সামরিক কমান্ডার রয়েছেন। তার মধ্যে আলবানি ওরফে হোজ্জা ও ফারদিন পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার পর বর্তমানে জেএমবির দু’জন সামরিক কমান্ডার বিভিন্ন অপারেশনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। জামায়াত-শিবিরের অনেক নেতাকর্মী উগ্রপন্থীদের সঙ্গে একত্র হয়ে কাজ করছে বলে তথ্য আছে সেই বিষয়ে গোয়েন্দা নজারদারি করে সত্যতা যাচাইপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্র জানান, চট্টগ্রামের পুলিশ সুপারের স্ত্রী খুনের ঘটনার পর পরই সরকার কঠোর অবস্থানে চলে গেছে। পরিস্থিতি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠক হয়েছে। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা বিভাগের উর্ধতনরা উপস্থিত ছিলেন। এসব বৈঠকে জঙ্গী তৎপরতার ঘটনায় জিরো টলারেন্স দেখানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরেও বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ পুলিশের আইজি দেশে ফেরার পর গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের মধ্য দিয়ে আরও কঠোর বার্তা দেয়া হতে পারে। গত কয়েকদিনে সরকারের উচ্চপর্যায়ে ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উর্ধতন কর্মকর্তাদের মধ্যকার বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চট্টগ্রামের পুলিশ সুপারের স্ত্রী মাহমুদা হত্যার ঘটনায় ছায়া তদন্ত পুলিশের সব ইউনিটের জন্য ‘ওপেন’ রাখা হয়। জঙ্গীবিরোধী কার্যক্রমে সারাদেশের সব থানার ওসিদের আরও সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়ার ব্যাপারে জোর তাগিদ দেয়া হয়। যেসব উগ্রপন্থী এরই মধ্যে জামিন পেয়েছেন, তাদের ব্যাপারে খোঁজ নেয়া ও জামায়াত-শিবির কর্মীদের তৎপরতার ব্যাপারে প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব স্থাপনা ও বসবাসের জায়গায় নিরাপত্তা জোরদার করার কথাও বলা হয়েছে। আইজিপি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার পর ৯ জুন উগ্রপন্থীদের তৎপরতা মোকাবেলার ব্যাপারে উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে আবার বৈঠক করার কথা রয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গীগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যে কোন সময় পুলিশের অপারেশনের দৃশ্যমান অগ্রগতি চোখে পড়বে। পুলিশ সদর দফতর থেকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা সব পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্ট ইউনিটে পাঠানো হচ্ছে।
×