ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

তদন্ত কমিটি গঠন

শাহজালালের রানওয়েতে ধাতব বস্তু, প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইট নামতে বিলম্ব

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ৯ জুন ২০১৬

শাহজালালের রানওয়েতে ধাতব বস্তু, প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইট নামতে বিলম্ব

আজাদ সুলায়মান ॥ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়েতে ঝুঁকিপূর্ণ কিছু ধাতব বস্তু পড়ে থাকার দরুন আকাশে আধা ঘণ্টা চক্কর দিতে বাধ্য হয় প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমানের একটি ভিভিআইপি ফ্লাইট। ওই ফ্লাইট অবতরণের প্রাক্কালে বিষয়টি এসএসএফের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের নজরে আসে। এ সময় ফ্লাইটটিকে অবতরণ না করার সঙ্কেত পাঠানো হয়। এতে বাধ্য হয়ে আধা ঘণ্টারও বেশি আকাশে চক্কর দিতে হয়েছে ওই ফ্লাইটকে। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে- রানওয়েতে ওই বস্তু থাকাবস্থায় যদি ওই ফ্লাইট অবতরণ করত তাহলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা করতে পারত। এ ঘটনায় আবারও শাহজালাল বিমানবন্দরের রানওয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় সিভিল এভিয়েশনের গাফিলতি ও দৈন্যদশার চিত্র ফুটে ওঠে। মঙ্গলবার রাতের এ ঘটনায় দুটো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিভিল এভিয়েশনের পরিচালক (ফ্লাইট সেফটি) উইং কমান্ডার জিয়াউল কবির। মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন জানান, শাহজালাল বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন জাকির হাসানকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে একজনকে ক্লোজ করা হয়েছে। সূত্র জানায়, অপর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে সিভিল এভিয়েশনের ফ্লাইট এক্সিডেন্ট ইন্সপেকশন বিভাগ থেকে। ওই ধাতব বস্তু কিভাবে সেখানে পড়েছিল, এটা সাবোটাজ নাকি অন্য কিছু সেটা খতিয়ে দেখার জন্যই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। জানতে চাইলে বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন জনকণ্ঠকে বলেন, এক্সিডেন্ট ইজ এক্সিডেন্ট। একটা ঘটনা ঘটে গেছে। এ ধরনের ঘটনা কেন ঘটল সেটা বের করার জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারপর কে দোষী সেটা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিমানের চেয়ারম্যান এয়ারমার্শাল ইনামুল বারী বলেছেন, রানওয়ে ক্লিয়ার না থাকায় এ ঘটনা ঘটেছে। রানওয়ে পরিষ্কার ও নিরাপদ রাখার দায়িত্ব ছিল সিভিল এভিয়েশানের। বিমান সূত্র জানায়, সৌদি আরব সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সোয়া সাতটার দিকে বিমানের একটি ফ্লাইট বিজি (০৩৬) ফ্লাইটে ঢাকার আকাশে পৌঁছে। ওই ফ্লাইটটি ল্যান্ড করার জন্য এটিসি থেকে সঙ্কেতও দেয়া হয়। এদিকে প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য নির্দিষ্ট সময়ের আগেই শাহজালাল বিমানবন্দরে হাজির হন সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণ। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বাহিনী এসএসএফ-সদস্যরাও সেখানে হাজির হয়ে বিমানবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। এক পর্যায়ে তারা রানওয়েতে গিয়ে দেখতে পান- বেশকিছু ধাতব বস্তু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। এসব বস্তু দেখে তারা আঁতকে ওঠেন। তারা নিশ্চিত হন- এ অবস্থায় ফ্লাইট অবতরণ করাটা মোটেই নিরাপদ নয়। এতে তাৎক্ষণিক মেসেজ পাঠানো হয় টাওয়ারে। ভিভিআইপি ফ্লাইটটিকে অবতরণ না করার সঙ্কেত পাঠানো হয়। এতে বাধ্য হয়েই আকাশে চক্কর দিতে হয় অর্ধঘণ্টারও বেশি সময়। এদিকে এসএসএফ সদস্যদের তত্ত্বাবধানে এ সব ধাতব বস্তু সরিয়ে নেয়ার পর ফ্লাইটটিকে অবতরণের সঙ্কেত বার্তা পাঠানো ককপিটে। তারপর রাত আটটার দিকে সেটা নিরাপদে অবতরণ করে। এগুলো কিসের বস্তু? ভিভিআইপি ফ্লাইট নামার আগ মুহূর্তে কি করে সেখানে পড়েছিল, এগুলোর ওপর দিয়ে ল্যান্ড করা হলে কি ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারত- এ সব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে আমরা এভিয়েশন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলি। বিমান সূত্র জানায়, মঙ্গলবার বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে বিমানের দাম্মামগামী সিডিউল ফ্লাইট বিজি-০৪৯ (বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর) নিয়ে ক্যাপ্টেন সোয়েব আলী টেক অব করতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় ওই উড়োজাহাজটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। ফলে বাধ্য হয়েই তিনি ফ্লাইট নিয়ে ফিরে আসেন হ্যাঙ্গারে। এরপর এসএসএফ সদস্যরা দূর থেকে দেখতে পান রানওয়েতে বোমাসদৃশ কিছু বস্তু। তারা গাড়ি নিয়ে তাৎক্ষণিক সেখানে ছুটে যান এবং এসব বস্তু দেখে আঁতকে ওঠেন। এ সময় বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলে (এটিসি) মেসেজ পাঠানো হয়। তারপর প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী ফ্লাইটটি অবতরণ না করার নির্দেশ পাঠানো হয়। এটিসির কাছ থেকে মেসেজ পেয়ে ক্যাপ্টেন জামিল আকাশেই চক্কর দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে রানওয়ে থেকে ওই সব বস্তু সরিয়ে নিয়ে নিরাপদ পরিবেশ তৈরির পর ককপিটে মেসেজ পাঠানো হলে ফ্লাইটটি অবতরণ করে। এ ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, বিকেল সোয়া পাঁচটায় দাম্মামগামী ফ্লাইট বোয়িং-৭৭৭ উড়োজাহাজটি উড্ডয়নের পূর্বমুহূর্তে যান্ত্রিক ত্রুটির কবলে পড়ে। এতে ওই উড়োজাহাজের ভেঙ্গে যাওয়া কিছু খুচরা যন্ত্রাংশ রানওয়েতে পড়ে যায়। এ সম্পর্কে শাহাজালালের একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা বেশ ক্ষোভের সঙ্গে জানান, এমনিতেই সাধারণত ভিভিআইপি ফ্লাইট নামার আগে বিশেষ নিষেধাজ্ঞা জারি ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। উড়োজাহাজ অবতরণের আগে চূড়ান্ত পরিদর্শন করে রানওয়ের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু বিকেল সোয়া পাঁচটায় একটি উড়োজাহাজ যান্ত্রিক ত্রুটির দরুন রানওয়ে থেকে ফিরে আসার পরবর্তী নিরাপত্তা পদক্ষেপ সঠিক ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইট নামার আগে রানওয়ে ক্লিয়ার করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ছিল এটিসির। সে দায়িত্ব যে ঠিক মতো পালন করা হয়নি- রানওয়েতে ধাতব বস্তু পড়ে থাকা তারই প্রমাণ। এগুলো থাকাবস্থায় ফ্লাইট অবতরণ করলে কি ঘটতে পারত প্রশ্ন করা হলে সিভিল এভিয়েশনের একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অনেক কিছুই ঘটতে পারত। আবার কিছু নাও ঘটতে পারত। বোয়িং-৭৭৭ এর মতো উড়োজাহাজ রানওয়েতে অবতরণের সময় এ ধরনের ধাতব বস্তুর সংস্পর্শে এলে তার ইঞ্জিন বিকল হয়ে কিংবা চাকা পাংচার হয়ে উড়োজাহাজটি রানওয়েতে ছিটকে পড়তে পারত। এমন আঙ্ককা ছিল বলেই তো এ ধরনের বস্তু রানওয়েতে রাখা বিপজ্জনক বলে বিবেচনা করা হয়। এদিকে প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দরে হাজির হওয়া ভিআইপিরাও এ খবর জেনে যান। এ সময় একজন মন্ত্রী জানতে চানÑ রানওয়ে ক্লিয়ার রাখা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার দায়িত্ব কার। তখন তাকে জানানো হয়, এটা সিভিল এভিয়েশনের এটিসির দায়িত্ব। আর নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত রয়েছেন সিভিল এভিয়েশনের নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মী ও সদ্য গঠিত এভসেক। সিভিল এভিয়েশনের মেম্বার (অপস) এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমানের সরাসরি তত্ত্বাবধানে থাকা এভসেক সদস্যদের পেশাগত কর্ম দক্ষতা ও দায়িত্ব পালনের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য অতিরিক্ত ইউনিট হিসেবে এভসেক মোতায়েন করার পরও কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটছে সে নিয়ে প্রশ্ন তুলেন একজন মন্ত্রী। এদিকে মঙ্গলবার শাহজালালে গিয়ে এ সম্পর্কে সাধারণ কর্মচারীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, অর্নাগোগ্রাম অনুমোদনের আগেই বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদারের অজুহাত দেখিয়ে তড়িঘড়ি করে এভসেক গঠন করা হয়। উচ্চ বেতনের নিয়োগপ্রাপ্ত এসব সদস্যরা নিরাপত্তার কাজের চেয়ে অলস বসে সময় কাটায় আর সাধারণর নিরাপত্তাকর্মীদের ওপর খবরদারি করে। এ নিয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দানা বাঁধছে। এ দুয়ের মধ্যে সমন্বয় না থাকার দরুন শাহাজালের নিরাপত্তা বিঘিœত হচ্ছে। বুধবার দুপুরে সিভিল এভিয়েশনের সদর দফতরে গিয়ে দেখা যায়, অন্য একটি নির্ধারিত বৈঠক শেষে বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এ বিষয়ে জানতে চান। এ সময় তিনি চেয়ারম্যানের রুমে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত শেষে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন।
×