ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মগবাজার-মৌচাক সড়ক

এটা কি সত্যিই রাস্তা! বেহাল দশা দেখে মন্ত্রীর প্রশ্ন

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৯ জুন ২০১৬

এটা কি সত্যিই রাস্তা! বেহাল দশা দেখে মন্ত্রীর প্রশ্ন

রাজন ভট্টাচার্য্য ॥ ‘সড়ক ও সেতুমন্ত্রী এবং ঢাকা দক্ষিণের মেয়রের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। মালিবাগ মোড়-মৌচাক মোড় পর্যন্ত রাস্তার উভয়পাশ দুই দিনের মধ্যে ঠিক করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করছি। অন্যথায় আমাদের মাথায় হাত। প্রচারে স্থানীয় বাসিন্দা ও বণিক সমিতি আয়েশা শপিং কমপ্লেক্স।’ রাস্তার উপর বিশাল বিশাল গর্ত। সেখানে জমেছে বৃষ্টির পানি আর কাদা। এই পরিস্থিতি প্রায় আট মাসের। বর্ষা মৌসুমে দুর্ভোগের মাত্রা আরও বেড়েছে। তাই সঙ্কট সমাধানে ব্যানার হাতে পানিতে দাঁড়িয়ে এভাবেই মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলেন মৌচাক-মালিবাগসহ আশপাশের মানুষ ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। রাস্তার চিত্র দেখতে মন্ত্রী আসছেন। সকাল থেকে এমন খবর ছড়িয়ে পড়ে গোটা মালিবাগ, মৌচাক ও রাজাবাগ এলাকায়। তাই তড়িঘড়ি করেই সকালেই ব্যানার নিয়ে নেমে গেলেন কাদা পানিতে। গুরুত্বপূর্ণ সড়কের ভয়াভয় চিত্র দেখে চোখ কপালে উঠেছিল পরিদর্শনে আসা দুই মন্ত্রীরও। রাস্তার বেহাল অবস্থা দেখে তারাও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। স্থানীয়দের দাবির প্রতি জানিয়েছেন সমর্থন। সর্বশেষ রাস্তা মেরামতে এক সপ্তাহের সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে মগবাজার-মৌচাক উড়াল সড়কের ঠিকাদার তমা কনস্ট্রাকশনকে। বিশাল গর্ত। থই থই পানি। পিচ ওঠে গেছে। ইট খোয়াও নেই। বেরিয়ে এসেছে মাটি। পাকা সড়কের কোন স্মৃতি চিহ্ন দেখা যায় না। গর্তে পড়ে প্রতিদিনই গাড়ি উল্টে যাচ্ছে। ঘটছে দুর্ঘটনা। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে হেঁটেও চলা দায়। অনেক ক্ষেত্রে বিকল্প সড়কে চলছে গাড়ি ও মানুষ। সত্যিই কি এটি কোন রাস্তা? দূর থেকে দেখলে মনে হবে ছোট্ট ডোবা অথবা পুকুর। যেখানে অনায়াসে মাছ চাষ সম্ভব। এটি কোন গল্প নয়। কিংবা চলচ্চিত্রের শূটিংয়ের কোন বর্ণনাও নয়। মগবাজার-মৌচাক উড়াল সড়কের নিচের রাস্তার দৃশ্য ঠিক এ রকম। ঈদকে সামনে রেখে ফের প্রকল্প এলাকার প্রায় নয় কিলোমিটার রাস্তা নিয়ে আলোচনা। সমালোচনা। আর মানুষের অন্তহীন ভোগান্তি। যা চরম পর্যায়ে উঠেছে। কবে রাস্তাটি মেরামত হবে? অপেক্ষায় সবাই। সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় নয় কিলোমিটার প্রকল্প এলাকার মধ্যে পাঁচ কিলোমিটারের বেশি এখন ব্যবহারের অনুপযোগী। অথচ এ নিয়ে কারও কোন মাথা ব্যথা নেই। প্রতিবছর ঈদের আগে আগে এ নিয়ে হৈচৈ শুরু হয়। একপর্যায়ে শুরু হয় জোড়াতালির কাজ। ঈদ শেষ তো সব ঠা-া। প্রকল্পের একটি অংশ ঢাকা দক্ষিণ ও অপ অংশটি উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আওতায়। কর্পোরেশনের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত রাস্তা মেরামতের দায়িত্ব সমবায় মন্ত্রণালয়ের। সমবায় বলছে প্রকল্পটি আমাদের হলেও রাস্তা মেরামতের দায়ভার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশনের। উড়াল সড়কের টেন্ডারের সময় রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয়ও ধরা হয়েছে। তমা কর্তৃপক্ষ বলছে, রাস্তা সচল রাখতে সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। অথচ চেষ্টার নমুনা হলো-সড়কটি একেবারেই ব্যবহারের অনুপযোগী। তাহলে চেষ্টাটি আসলে কোন ধরনের সে প্রশ্ন? রয়েই গেল। বাস্তবতা হলো এর আগেও এই রাস্তাটি মেরামতের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। একবার নয়। ২০১২ সাল থেকেই এমন নির্দেশনা জারি হয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। প্রভাবশালী তমা গ্রুপ কোন কিছুই তোয়াক্কা করে না। না মানে মন্ত্রীর নির্দেশ। মানুষের দুর্ভোগ দুর্দশাতেও তাদের টনক নড়ে না। শাহাজানপুর চৌরাস্তা থেকে মৌচাক পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে অন্তত ৫০টি বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ভেঙ্গে গেছে ফুটপাথ। গর্তে জমেছে জল। পিচ, ইটের খোয়া উঠে গেছে। বৃষ্টিতে গলে গেছে রাস্তার পাশে জমিয়ে রাখা মাটি। অনেক স্থানে কাদাও জমেছে গোড়ালি ছাড়িয়ে। ফলে গর্ত আর জল ও কাদার ভোগান্তি চরমে উঠেছে গোটা এলাকায়। মালিবাগ মোড় থেকে শান্তিনগর ছাড়িয়ে কাকরাইল পর্যন্ত রাস্তার চিত্র প্রায় কাছাকাছি। গর্ত কিছুটা কম হলেও কাদা আর পানির সমস্যা আছেই। মালিবাগ চৌরাস্তা থেকে মৌচাক-মগবাজার পর্যন্ত রাস্তাটি ভাল নয়। অর্থাৎ সেখানেও কাদা, পানি আর রাস্তার দুর্দশা রয়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে, বড় বড় বাসও সড়কটি দিয়ে চলতে পারছে না। মালিবাগ মোড় থেকে মুগদা পর্যন্ত নিয়মিত চলাচল করত প্রায় শতাধিক লেগুনা। রাস্তার বেহাল দশার কারণে এখন চলছে মাত্র ৩০টি। চালক হুমায়ুন জানান, রাস্তা ভাঙ্গাচোড়া থাকায় অনেক গাড়ি ভেঙ্গে গেছে। সেগুলো মেরামতের জন্য এখন গ্যারেজে রাখা হয়েছে। বেশ কয়েকটি গাড়ি গর্তে পড়ে বিকল হয়েছে। কিছু গাড়ি চলছে। তাও আবার শান্তিনগর হয়ে মুগদা ও মালিবাগে যাওয়া আসা করে। রাজারবাগ হয়ে চলা খুবই কষ্টসাধ্য বলে জানান তিনি। বলাকা পরিবহনের চালক কাসেম জানান, গোটা শহরে এ রকম বেহাল রাস্তা চোখে পড়েনি। প্রায় ৪০ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করতে যত কষ্ট না হয় এরচেয়ে বেশি কষ্ট ও ঝুঁকি মগবাজার থেকে রাজারবাগ পর্যন্ত সড়ক পার হতে। এই এলাকায় বাস চলার সময় কাত হয়ে যায়। যাত্রীরা আতঙ্কে থাকে। নিয়মিত গাড়ি উল্টে যাওয়াও ঘটনাও ঘটছে বলে জানান তিনি। হোসাফ শপিং কমপ্লেক্সের ব্যবসায়ী পাভেল খান জানান, সামনে ঈদ। রাস্তা খারাপ তাই মার্কেটে এখনও ভিড় জমছে না। মৌচাক মার্কেটের ব্যবসায়ী কাদের জানান, রাস্তার বেহাল অবস্থার কারণে অন্য বছরের তুলনায় এখনও ক্রেতা কম। অন্য মার্কেট থেকে সবাই ঈদেও কেনাকাটা করছেন বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, রাস্তা মেরামত না হলে আমরা কঠোর কর্মসূচী দেব। ফরচুর শপিং মলের ব্যবসায়ী নেতা রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া জানান, মালিক সমিতির একটিই দাবি রাস্তাটি মেরামতের ব্যবস্থা করা। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে রাস্তাটি মেরামত না হলে এ বছর ঈদের বিক্রির লক্ষমাত্রা পূরণ হবে না। মালিবাগ রেলগেট মোড়ে গ্রামীণ সুইটমিটের ঠিক সামনের সড়কে দিনে কত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে এর কোন হিসেব নেই। যারা রাত-দিন দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তারাও জানেন না সঠিক পরিসংখ্যান। প্রশ্ন রাস্তা এখন আর চেনার উপায় নেই। দূর থেকে মনে হবে ছোট্ট একটি খাল। কারণ ছোট বড় শতাধিক গর্ত অল্প দূরত্বের মধ্যে। সেখানে এখন হাঁটু সমান বৃষ্টির পানি। গর্তে পড়ে হরদম উল্টে যাচ্ছে রিক্সা, অটোরিক্সাসহ ছোট ছোট বিভিন্ন যানবাহন। এই রাস্তাটি মালিবাগ কমিউনিটি সেন্টার পর্যন্ত বেহালর দশা। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রামপুরা ব্রিজের পর থেকে মালিবাগ রেল গেট পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশের চিত্র বেহাল। ছোট বড় গর্ত, পানি জমে একাকার। ভাঙ্গা ফুটপাথ। সঙ্গে কাদা তো আছেই। এসব কারণে রামপুরা থেকে সায়েদাবাদগামী বেশিরভাগ গণপরিবহন এখন মালিবাগ চৌধুরীপাড়া হয়ে সারাসরি খিলগাঁও দিয়ে গন্তব্যে চলে যায়। এ কারণে মালিবাগ মোড়ের যাত্রীদেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এমন অবস্থায় যানজটের নিত্য দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে চলতে হচ্ছে নগরবাসীকে। যার প্রভাব পড়ছে আশপাশের সড়কসহ গোটা রাজধানীতে। যেখানে ২৪ ঘণ্টার জনদুর্ভোগ চরমে উঠেছে। রাজধানীর যানজট নিরসনে সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পসমূহের অন্যতম মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার। ২০১২ সালে শুরু হয়ে প্রকল্প ২০১৩ সালের ডিসেম্বরেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। অর্থাৎ দুই বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা। মেয়াদ শেষে এখন বলা হচ্ছে আগামী বছর কাজ শেষ হতে পারে। মহাখালী আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম জনকণ্ঠকে বলেন, মগবাজার-মৌচাক উড়াল সড়ক এলাকার রাস্তাটি এখন ব্যবহারের অনুপযোগী। ঈদের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার হয়নি। ফলে জনদুর্ভোগ চরমে গেছে। স্বাভাবিক গতিতে যানবাহন চলতে পারছে না। যানজটতে আছেই। গাজীপুর-টঙ্গী সড়ক চলা প্রায় তিন শতাধিক বাস বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রামপুরা দিয়ে বিকল্প সড়ক ব্যবহার করছে। এ কারণে আয়ও কমেছে অনেক কম। যানজটের কারণে ট্রিপ নেমে এসেছে অর্ধেকে। সড়কটি স্থায়ীভাবে মেরামতের জন্য সড়ক পরিবহন মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। মালিবাগ রেলগেট এলাকায় কুমিল্লা ফার্মেসির সামনের রাস্তায়ও বিশাল গর্তে রাতদিন দুর্ঘটনা ঘটছে। কারণে অকারণে উল্টে যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের পরিবহন। এতে আহত হচ্ছেন অনেকে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, নিউম্যান হলার, মিনি পিকআপ পর্যন্ত কাত হয়ে উল্টে যাচ্ছে এখানে। রিক্সা উল্টে আহত হয়েছেন শাহজানপুরের করিম সিকদার। হাতে ও পায়ে প্রচ- আঘাত পেয়েছেন তিনি। একই ঘটনার শিকার খিলগাঁর বাসিন্দা হান্নান চৌধুরী। তিলপাড়ার পলাশ অটোরিক্সা উল্টে আঘাত পেয়েছেন। একটি মিনিবাস নষ্ট হয়ে যাওয়া সেখানে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। তমা কনস্ট্রাকশনের প্রকৌশলী মোঃ আশরাফুল আলম শিমুল জনকণ্ঠকে বলেন, ফ্লাইওভার প্রকল্পের কারণে যেসব এলাকায় রাস্তা নষ্ট হয়েছে তা মেরামতের দায়িত্ব আমাদের। যেখানে আমাদের প্রকল্প নেই, কিন্তু রাস্তা ভেঙেছে তা দেখার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। এক সপ্তাহের মধ্যে সড়ক মেরামতের নির্দেশ সড়ক মন্ত্রীর ॥ রাজধানীর মগবাজার-মৌচাক সড়কের বেহালদশায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সড়কটি মেরামত করে রাস্তা যান চলাচলের উপযোগী করা এবং পানি সরিয়ে দিতে তমা কনস্ট্রাকশন ও ঢাকা ওয়াসাকে এক সপ্তাহের আল্টিমেটাম দিয়েছেন তিনি। বুধবার স্থানীয় সরকার এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের যৌথ পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের হোসাফ টাওয়ারে বিফ্রিং করেন মন্ত্রী। এর আগে তিনিসহ স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা মালিবাগ-মৌচাক সড়ক পরিদর্শন করেন। রাস্তার বেহালদশার কথা তুলে ধরে ওবায়দুল কাদের বলেন, রাস্তায় পানি জমে যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ার জন্য ওয়াসা এবং ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজে নিয়োজিত তমা কনস্ট্রাকশন দায়ী। তারা রাস্তা ঠিক না করায় চূড়ান্তভাবে তাদের সাতদিনের সময় দেয়া হলো। এ সাতদিনের মধ্যে রাস্তা উপযোগী করে দিতে হবে, না হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×