ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর হুঁশিয়ারি ;###;‘মনে রাখবেন আমি সরকারপ্রধান, আমার কাছে নিশ্চয়ই তথ্য আছে’

কোন হত্যাকারীই রেহাই পাবে না

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৯ জুন ২০১৬

কোন হত্যাকারীই রেহাই পাবে না

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুপ্তহত্যাকারীদের দমনে দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করে বলেছেন, সম্প্রতি দেশে জঙ্গী কর্মকাণ্ড এবং একের পর এক গুপ্তহত্যার পেছনে বিএনপি-জামায়াতের যোগসূত্রতা রয়েছে। যারা প্রকাশ্যে মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে তারাই কৌশল পাল্টে এখন মানুষ হত্যা করছে। আমরা যখন যা বলি, কোন অমূলক কথা বলি না। একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না, আমি ‘হেড অব দ্য গবর্নমেন্ট’ (সরকারপ্রধান)। আমার কাছে নিশ্চয়ই তথ্য আছে। সব তথ্য হয়ত তদন্তের স্বার্থে প্রকাশ করা যাবে না কিন্তু আমি অমূলক কথা বলি না। গুপ্তহত্যাকারীদের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জঙ্গী-সন্ত্রাসী ও গুপ্তহত্যাকারীরা যে দলেরই হোক, আমাদের হাত থেকে রেহাই পাবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ আমাদের গোয়েন্দারা তৎপর রয়েছেন। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট, দেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত এবং দেশ এগিয়ে যাচ্ছে যারা চায় না- তাদেরই নীলনক্সা অনুযায়ী এসব ঘটনা ঘটছে। দেশবাসীর কাছে আমার উদাত্ত আহ্বান- যেভাবে মানুষ পুড়িয়ে হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে আপনারা গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে গুপ্তহত্যা-নাশকতাকারী ও তাদের মদদদাতাদের খুঁজে বের করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করুন। কেননা দেশের জনগণ সচেতন হলে ষড়যন্ত্রকারীরা কোনদিনই তাদের নীলনক্সা বাস্তবায়ন করতে পারবে না। বুধবার দুপুরে গণভবনে আয়োজিত জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বুলগেরিয়া, জাপান ও সৌদি আরব সফর নিয়ে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। লিখিত বক্তব্যের পর গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নগুলো ছিল মূলত দেশে সাম্প্রতিক গুপ্তহত্যা, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতা, বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ নানা প্রসঙ্গে। তবে সবচেয়ে বেশি কথা হয় সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একের পর এক গুপ্তহত্যা নিয়ে। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মূল মঞ্চে উপস্থিত ছিলেনÑ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। এ সময় সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, সংসদ সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতেই পরিকল্পিতভাবে টার্গেট কিলিং করা হচ্ছে। তবে সরকার বসে নেই, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর আছে। তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই গুপ্তহত্যাকারীদের ধরা হচ্ছে এবং এর সঙ্গে দুটি রাজনৈতিক দলের জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের যোগসূত্র রয়েছে। এগুলো তারা খুব পরিকল্পিত ঘটাচ্ছে। আমরা এটা কখনই মেনে নেব না। এ ধরনের পরিকল্পনা বাংলাদেশে স্থান পাবে না। বাংলাদেশে সন্ত্রাস এবং জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান সুদৃঢ়। এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী গুপ্তহত্যায় বিএনপি-জামায়াতের জড়িত থাকার কথা ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, গুপ্তহত্যার বিষয়ে আপনারা নিজেরা চিন্তা করে দেখেন, কারা টার্গেট কিলিং করছে? কারা বলে- গুলি কর, বৃষ্টির মতো গুলি কর, বাঁচলে গাজী, মরলে শহীদ। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা মিসকিন না, সম্ভাবনাময় জাতি। যার ম্যাজিক হচ্ছে জনগণ এবং জনগণের ভালবাসা, বিশ্বাস ও আস্থার আন্তরিকতা। আমাকে নিয়ে কে কী লিখল, কে কী আমাকে দিল বা বিশ্ব তালিকায় আমাকে কী মার্কিং দিল, সেটা আমার কাছে বড় কিছু নয়। আমার দেশের মানুষ ভাল থাকলেই এটা আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার। সরকারপ্রধান হিসেবে তথ্য নিয়েই কথা বলি ॥ গুপ্তহত্যার পর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কোন দলের ওপর দায় চাপালে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে কিনাÑ এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন কর্তাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘মনে রাখবেন আমি যখন যে কথাটা বলি, কখন কোন অমূলক কথা বলি না। একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না, আমি ‘হেড অব দ্য গবর্নমেন্ট’ (সরকারপ্রধান)। আমার কাছে নিশ্চয়ই তথ্য আছে। বরং যারা এ ধরনের চিন্তা করে, তারা যদি জানে জঙ্গী কারা, সেই তথ্যটা দয়া করে আমাদের দিয়ে দিতে বলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা যখন একজন আসামিকে ধরি, সমস্ত ক্লু বিশ্লেষণ করেই ধরি। টেলিফোন নাম্বারসহ সকল কিছু মিলিয়ে ধরি। আর যখন তার পরিচয়ের সূত্রটা পাই, এতেই আমরা যোগসূত্রটা পাই। তিনি বলেন, আমরা কিন্তু বসে নেই। যারা মনে করেন আমরা রাজনৈতিক হিসেবে এটা বলছি, আর অন্যদিকে জঙ্গীরা পার পেয়ে যাচ্ছে- তাহলে পার পেয়ে যাওয়া জঙ্গীরা কারা? তাদের নাম-ঠিকানা পরিচয় যদি জেনে থাকেন তাহলে তারা আমাদের দয়া করে জানান। জঙ্গী জঙ্গীই। তারা যে দলেরই হোক, আমাদের কাছ থেকে রেহাই পাবে না। এইটুকু আশ্বাস আমি দিতে পারি। গুপ্তহত্যাসহ বিভিন্ন নাশকতামূলক ঘটনায় কোন না কোনভাবে বিএনপি-জামায়াতের যোগসূত্র রয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, যেহেতু এ সমস্ত জঙ্গী তৎপরতা বাংলাদেশে আমরা সবসময় দেখেছি। যারা এ ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে কোন না কোনভাবে এদের যোগসূত্র রয়েছে। অন্তত দুটি রাজনৈতিক দলের (বিএনপি ও জামায়াত) সঙ্গে তো যোগসূত্র আছেই। এখন এই রাজনৈতিক দল দুটিকে যারা বাঁচাতে চায়, রক্ষা করতে চায়, তাদের অপকর্মগুলো ঢাকতে চায়Ñ তারাই এ ধরনের প্রশ্ন ওঠায়। আমি যদি একথা বলি, তার কী জবাব আছে তাদের কাছে পাল্টা প্রশ্ন রাখেন প্রধানমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারের আমলে জঙ্গী তৎপরতার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, ১৯৭১ সালে যারা মানুষ হত্যা করেছে, আমরা যখন এদের বিচার শুরু করলাম- তখন কী বলা হয়েছে? ২০০১ সালে যখন বাংলা ভাইয়ের সৃষ্টি হলো তখন কী বলা হয়েছে? তখন কারা বলেছিল? তখন কারা পুলিশ প্রহরা দিয়ে ওই সমস্ত জঙ্গীদের মিছিল করিয়েছে? আপনারা (সাংবাদিক) এত তাড়াতাড়ি ভুলে যান কিভাবে? আর যারা আজকে একথা বলছে তারাও এত তাড়াতাড়ি কিভাবে ভুলে যায়? তিনি আরও প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করার পর কারা তাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে? কারা লাখো শহীদের হাতে রঞ্জিত পতাকা তুলে দিয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের হাতে? ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার খুনীদের কারা ইনডেমনিটি জারি করে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়েছে? আসুন সব যোগসূত্র খুুঁজুন। যারা আত্মস্বীকৃত খুনীদের চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করতে পারে, তাদের সম্পর্কে এত ভাল ধারণা করার কোন যৌক্তিকতা আছেÑ আমি এটা বুঝি না। তাকে হত্যার লক্ষ্যে কোটালীপাড়ায় বোমা পুঁতে রাখার ঘটনাসহ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এসব হামলার পর তারা (বিএনপি-জামায়াত) কী বলেছে? কিন্তু আজকে তদন্তের পর কী বেরিয়েছে? আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যাকা-ের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তদন্ত করে বের করা হলো কারা খুনী? তারা কী বিএনপি-জামায়াত করে না? এসব ঘটনা একটার সঙ্গে অপরটার যোগসূত্রগুলো বিশ্লেষণ করলেই স্পষ্ট হবে সবটির সঙ্গেই ওই দুটি দলের যোগসূত্রতা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে তার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ করে হত্যা প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও ষড়যন্ত্র চলেছে। আমার ছেলে জয় কী অপরাধ করেছে? এফবিআই অফিসারকে টাকা দিয়ে কিনে ফেলল, ওই টাকা কোথা থেকে এলো? এই টাকা কে বহন করেছে? কারা দিয়েছে বা কারা বৈঠক করেছে, কারা চিঠি দিয়েছে? এটা তো আমরা নয়, আমেরিকাই বের করেছে। আমেরিকার তদন্তেই বেরিয়ে এসেছে কারা কারা এর সঙ্গে জড়িত। কারা এ ষড়যন্ত্র করছে। বিএনপি নেতারা করেছে। তাই গুপ্তহত্যার সঙ্গে আমরা যাদের যোগসূত্রতা পাই; সেটা কি মিথ্যা। তিনি বলেন, যারা প্রকাশ্যে মানুষ খুন করতে পারে, পুড়িয়ে মানুষ মারতে পারে, তারা এর সঙ্গে যুক্ত হবে নাÑ এ ধারণাটা কোথায় থেকে আসে? আমারও সেটাই প্রশ্ন। তার মানে এ ধরনের একটি সন্ত্রাসী-জঙ্গিবাদী পার্টিকে বাংলাদেশে জীবিত রেখেই দিতে হবে! আর বাংলাদেশের মানুষকে সব সময় একটা আশঙ্কার মধ্যে রাখতে হবে! প্রশ্ন করে তিনি বলেন, কাজেই আমি যখন যে কথাটা বলি, এটা মনে রাখবেন কখনও কোন অমূলক কথা বলি না। একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না আমি সরকারপ্রধান। আমার কাছে নিশ্চয়ই তথ্য আছে। হয়ত সব তথ্য সবসময় তদন্তের স্বার্থে প্রচার বা প্রকাশ করা যাবে না। কিন্তু সূত্রটা জানা যায়। সূত্র ধরেই আমরা কথা বলি। কাজেই যারা এ ধরনের কথা বলেন, তারা প্রকৃত জঙ্গীদের বাঁচাতে চান। রক্ষা করতে চান এবং জঙ্গিবাদী কর্মকা-কে উৎসাহিত করতে চান। মানুষ ভাল থাকলেই এটা আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার ॥ ‘বিশ্ব নারী নেতৃত্বের তালিকায় অগ্রগতি’ প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি রাজনীতি করি বাংলাদেশের জনগণের জন্য। আমার দেশের মানুষ তাদের জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারলেই আমার জীবনের সার্থকতা। আমি জীবনে কোনদিন মার্কিং (সংখ্যা) নিয়ে চিন্তাভাবনা করি না। চিন্তা করবও না। কি পেলাম আর কি পেলাম না; ওগুলো নিয়ে আমার চিন্তাভাবনা নেই। দেশের জনগণকে কী দিতে পারলাম সেটাই আমার কাছে বড়। তিনি বলেন, কে আমাকে মার্কিং দিচ্ছে, কী দিচ্ছে- এটা আমার ভাবার বিষয় না। দেশকে কতটুকু আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলাম, উন্নত করতে পারলাম, জাতি হিসেবে বিশ্বে আমরা কতটুকু সম্মান পেলামÑ সেটাই বড় কথা। তিনি বলেন, এই দেশ আমরা স্বাধীন করেছি লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে। তাই যখন এই দেশকে কেউ অবহেলার চোখে দেখে সেটাই আমার জন্য কষ্টের ছিল। সেজন্য আমাদের কষ্ট ছিল, আমরা কারও কাছে হাত পাতব না। কারও কাছে ভিক্ষা চাইব না। আমরা মাথা উঁচু করে চলব। আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াব। যেটা জাতির পিতা বলতেন সবসময়। এ সময় জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনের স্মতিচারণ করতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আজকে আমার সবচেয়ে বেশি আনন্দ লাগে যখন জি-৭ গেলাম প্রত্যেকটা ক্ষমতাধর দেশের রাষ্ট্রপ্রধান জানতে চায়, তাঁরা এসে বলে, বাংলাদেশ কীভাবে এগিয়ে গেল? এটা তো একেবারে মিরাকল (অলৌকিক)। এটা ম্যাজিকটা কী? জবাবে আমি বলেছি, ম্যাজিক একটাই জনগণ। জনগণের ভালবাসা, বিশ্বাস এবং আস্থা আর আন্তরিকতা সঙ্গে জনগণের জন্য কাজ করা। কারণ আমি নিজের স্বার্থের জন্য রাজনীতি করি না। রাজনীতি করি বাংলাদেশের মানুষ যাতে একটু ভাল থাকে, উন্নত থাকে। তাই দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নতি করতে পারছি, তারা ভাল আছে। রাজনীতির প্রয়োজনে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ আনাচে-কানাচে ঘোরার অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তখন যখন মানুষের কাছে গেছি, মানুষ হাত পেতেছে, খাবার চেয়েছে। পেটের ভাতের জন্য আকুতি করেছে। রাস্তাঘাট কিছু নেই, ধানক্ষেতের আল দিয়ে হেঁটে গেছি হাঁটু পানি দিয়ে। তখন মানুষকে লক্ষ্য করেছি, জানার চেষ্টা করেছি মানুষ কী চায়। তাই যখনই সরকারে এসেছি চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশের মানুষ পরনের বস্ত্র পাচ্ছে কি না? তার পায়ে একজোড়া স্যান্ডেল আছে কি না? সে একবেলা থেকে দুবেলা খেতে পারছে কি না? প্রত্যেকটা ধাপে ধাপে আমরা ওই জিনিসগুলো সেভাবে পরিকল্পনা নিয়েছি। পরিকল্পনা অনুযায়ীই পদক্ষেপ নিয়েছি। তিনি বলেন, একটা রাজনৈতিক দল হিসেবে যদি নিজস্ব পরিকল্পনা, চিন্তাভাবনা না থাকে বা ভবিষ্যত সুনির্দিষ্ট পান না থাকেÑ তাহলে এত দ্রুত উন্নত করা যায় না। আমরা দল হিসেবে সেভাবেই পেপার করেছি, সেইভাবেই আমরা প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়ে ধাপে ধাপে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আজকে দেশ যেমন এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের মানুষও সম্মান পাচ্ছে। এটাই আমার বড় পাওয়া। মাটি-মানুষের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা কাজ করছি। এটা ম্যাজিকও না, কিছু না। এটা হলো মানুষের প্রতি ভালবাসা, তাদের প্রতি দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যবোধ। কারণ আমার বাবা করে গেছেন। তাঁর কাছ থেকেই শিখেছি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোন পত্রিকা আমাকে নিয়ে কি লিখল, না লিখল- ওই নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। ওটা নিয়ে চিন্তা করলে তো ওটা নিয়ে থাকতে হয়। বায়োডাটা (জীবন বৃত্তান্ত) পাঠাতে হবে। নাম পাঠাতে হবে। ওর পেছনে কেন আমি ফালতু খরচ করব। তার চেয়ে ওটা দিয়ে দেশে দুইটা মানুষের ঘর করে দেব। কিংবা কাজের ব্যবস্থা করে দেব। সেটাই আমার বড় পাওয়া। কত প্রস্তাব আসে। তা দরকার কী আমার। আমার দেশের মানুষ ভাল থাকলেই এটা আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার। বিদেশীদের কাছে আমরাই মিথ্যা বলি ॥ ‘বিদেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা বাংলাদেশ নিয়ে প্রশংসা করে কিন্তু সেই দেশেরই এদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতরা বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক কথা বলেন’Ñ এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানে যাঁরা (কূটনীতিক) এমন কিছু বলে এটা জন্য নিজের (দেশের) লোকরাই দায়ী। কারণ অনেকেই দূতাবাসে যান, কোন পার্টিতে যান। দু’চার পেগ খান, তারপর বেতালা হয়ে নানা কথা বলেন। এ রকম ঘটনাও হয়। তিনি বলেন, বাঙালীদের স্বভাব হচ্ছে পরচর্চা করা, নিজের নিন্দা করা। এটা করতে গিয়ে তারা নিজের দেশকেই হেয় করেন। প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রেখে বলেন, আমরা দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি কেন? আমাদের দেশটাকে বিশ্বের কাছে একটা সম্মানজনক অবস্থায় নিয়ে আসার জন্য। আর সেখানে আমাদের ভেতর থেকে কেউ দেশে এটা হয়নি, ওটা হয়নি, ওটা হতে পারত বলে বেড়ান। অথচ তারা (কূটনীতিক) যখন প্রশংসা শুরু করেন তখন আমরা করি তার উল্টোটা। তখন তো তাঁরাও উল্টোটা শুরু করবে। এটাই তো বাস্তবতা যোগ করেন তিনি। এ সময় সাংবাদিক শফিক রেহমানের নাম উল্লেখ না করে শেখ হাসিনা বলেন, হয়ত দেখা গেল কেউ একজন জঘন্য কাজের সঙ্গে জড়িত। হয়ত তাঁকে আমরা গ্রেফতার করলাম। তখন আপনারা (সাংবাদিক) তাকেই বাহ্বা দিয়ে গেলেন! কিন্তু সে কি কাজটি করতে যাচ্ছিল, সেটা সম্পর্কে আপনাদের কোন অনুভূতি বা উপলব্ধি আছে সেটা আমি দেখতে পাই না। এখানে একজন ব্যক্তিও যে অপরাধ করতে পারে তখন সেটা আর আপনারা দেখতে পারেন না। এ ধরনের ঘটনাও ঘটে। সেটাও তো আমরা দেখেছি। কাজেই এখানে যারা বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের তো একটু সংযত, সতর্ক বা সাবধান হয়ে কথা বলা উচিত উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, বাংলাদেশ যে উন্নত হচ্ছে, এটা তো একটা দেখাতে বা বলতে পারতেন। অবশ্য বাঙালীর স্বভাবজাতভাবে পরনিন্দা করতে পছন্দ করে। তবে পবিত্র রমজান মাসে তো কেউ মিথ্যা কথা বলবেন না এটাই আশা করি। তিনি বলেন, আমরা দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি দেশের উন্নয়নের জন্য। এখন আমরা মিসকিন না। আমরা একটা সম্ভাবনাময় জাতি। এটা সবাইকে মনে রেখে মাথা উঁচু করে চলতে হবে। এ ধারণাটিই মাথায় রেখে চলতে হবে। আমরা সেভাবেই কাজ করে যাচ্ছি। মক্কা-মদিনা রক্ষায় প্রয়োজনে সামরিক সহযোগিতা ॥ সন্ত্রাসবিরোধী সৌদি জোটে বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগের চেয়ে সৌদি আরবের অবস্থানের গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। শুধু সেখানে লোক পাঠানো নয়, সৌদি আরব বাংলাদেশে এখন বিনিয়োগে আগ্রহী। আর মনে রাখতে হবে সৌদি বাদশাহ শুধু বাদশাহ নয়, পবিত্র মক্কা ও মদিনা শরিফের গার্ডিয়ানও (অভিভাবক)। তারা যে সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থান নিয়েছে, তাতে আমরাও সম্মতি দিয়েছি। মুসলিম অধ্যুষিত ৪০টি দেশ এ ব্যাপারে একত্রিত হয়েছে। সে দেশে পবিত্র কাবা শরিফ, নবীজীর রওজাসহ অনেক পবিত্র স্থাপনা রয়েছে। এগুলোর নিরাপত্তার বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছি। সৌদি আরব এসব ক্ষেত্রে সহযোগিতা চাইলে আমরা তা করতে প্রস্তুত। এমনকি সামরিক সহিযোগিতা চাইলেও আমরা তা দেব। ইতোমধ্যে আমাদের সেনাপ্রধান সৌদি আরব ঘুরে এসেছেন। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের যে কোন দেশের সঙ্গে সহযোগিতামূলক অবস্থান নিতে পারে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলামে সন্ত্রাসের কোন স্থান নেই। একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই শেষ বিচারের মালিক। বিচারের ভার মানুষকে তিনি দেননি। তাই ধর্মের নামে যারা মানুষ খুন করছে প্রকৃত অর্থে তারা ইসলামেই বিশ্বাস করে না। হাতেগোনা মুষ্টিমেয় কিছু গোষ্ঠী ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করে পুরো মুসলিম ধর্মকেই কলুষিত করছে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী ধর্মপ্রাণ মুসলমান, ধর্ম প্রচারক ও মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিমদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, তাদের পরিবারের কোন সদস্য জঙ্গীবাদের পথে যাচ্ছে কিনা, সেটা দেখাও তাদের কর্তব্য। মানুষের মধ্যে এই চেতনাটা জাগ্রত করতে হবে। আর দেশের মানুষের প্রতি আমার আহ্বান, যেভাবে মানুষ পুড়িয়ে হত্যাকারীদের যেমন প্রতিরোধ করেছেন, ঠিক তেমনিভাবে গুপ্তহত্যাকারী ও নাশকতাকারীদের খুঁজে বের করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করুন। দেশের জনগণ সচেতন হলে ষড়যন্ত্রকারীরা কোনদিনই তাদের নীলনক্সা বাস্তবায়ন করতে পারবে না। ইউপি নির্বাচনে সহিংসতা কাম্য নয় ॥ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতা নিয়ে সাংবাদিকদের অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচনে গ-গোল এটা নতুন কিছু নয়। ’৮৮-এর গণভোট, ’৮৬ সালের নির্বাচন, ৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচন এবং বিএনপির আমলে ইউনিয়নসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোর চিত্র একটু বিশ্লেষণ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এখন নির্বাচনের সকল ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের হাতে। ইউপি নির্বাচনে কিছু ঘটনা ঘটেছে যা গ্রহণযোগ্য নয়, অনভিপ্রেত। আগামীতে সহিংসতা কীভাবে কম হয় এখন থেকেই আমরা তার ব্যবস্থা নেব। দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের কারণেই ইউপি নির্বাচনে সহিংসতা বেশি হয়েছে এমন প্রশ্নের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একথার সঙ্গে আমি একদমই একমত নই। তৃণমূল থেকে গণতান্ত্রিক চর্চা যেন হয় সেজন্যই আমরা প্রথম দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছি। প্রথম নির্বাচন সেজন্য কিছু সমস্যা হতেই পারে। তবে আগামীতে যেন না হয় সেই ব্যবস্থা নেব। আর দলের যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধেও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে সবাই বিস্মিত হয়েছে ॥ জাপান, সৌদি আরব ও বুলগেরিয়া সফরে দেশগুলোর নেতাসহ বিশ্বনেতাদের সঙ্গে আলোচনার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পর পর তিনটি সফর আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেকটি সফরে বাংলাদেশের অনেক অর্জন আছে। তিনি বলেন, এই তিনটি সফরে যেসব নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, সেই বিশ্বনেতাদের সবাই বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তাদের অবাক করেছে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ওপরে থাকাটা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সৌদি আরব সফর অত্যন্ত ফলপ্রসূ ছিল। সফরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আলোচনায় সৌদি সরকার বাংলাদেশ থেকে দক্ষ-অদক্ষ বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রমিক নেবে বলে জানিয়েছে। সৌদি ব্যবসায়ীরাও বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, বুলগেরিয়া সফরে দেশটির সোফিয়ায় ‘গ্লোবাল উইমেন লিডার্স ফোরামে’ বাংলাদেশের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। ফোরামে বাংলাদেশে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতায়নে সরকারের নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরা হয়েছে। সেসব পদক্ষেপ তুমুল প্রশংসিত হয়েছে ফোরামে। জাপান সফর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেখানে জি-৭ অর্থাৎ বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক সাতটি দেশের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তারা সবাই বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রশংসা করেছেন। কোন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাই না ॥ গুপ্তহত্যাসহ নানা সন্ত্রাস-নাশকতার সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোট জড়িত এবং পাকিস্তান এতে মদদ দিচ্ছে। পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা হবে কিনা, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা কোন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার রাজনীতিতে বিশ্বাসী নই। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে পাকিস্তানের ভূমিকাই প্রমাণ করে দ-প্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি, তাদের সঙ্গে গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনে জড়িত ছিল। আসলে যারা পাকিস্তানের বাসমতি চাল খেয়েই বেহুঁশ হয়ে যায়, তারাই মূলত পাকিস্তানের এজেন্ট।
×