ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের সফল মঞ্চায়ন

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ৯ জুন ২০১৬

হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের সফল মঞ্চায়ন

শব্দ ফুরিয়ে যাওয়া কিংবা বলার মতো কথা খুঁজে না পাওয়া একজন সৃজনশীল কবির পক্ষে কত মর্মবেদনার তা নিয়েই তিন তিনটি ক্যাটাগরিতে কানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ইটারনিটি এ্যান্ড এ ডে। নিঃসঙ্গতার শেষ সীমানায় পৌঁছে সত্তরোর্র্ধ গ্রীস কবি আলেকজান্ডার সমুদ্রের জলে ডুবে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয় রাতের গভীরতা পেরিয়ে নব সূর্যের উদয়কালে। কিন্তু অবুঝ শিশু পথ ভুলে স্বদেশ আলবেনীয় থেকে পথ হারিয়ে গ্রীসে এসে পড়লে গ্রীস কবি জীবনের ভিন্ন অর্থ খুঁজে পায় শিশুটিকে তার ঘরে ফিরিয়ে দিতে যেয়ে। অপরদিকে সম্পাদক আর প্রকাশকদের বিবেচনার অভাবে বিকশিত হয়েও প্রকাশিত হতে না পারা কবি মতিন উদ্দিন যখন কাল্পনিক এক উজবেকিস্তানের কবি নদ্দিউ নতিম নামের মধ্যে দিয়ে বিকশিত-প্রকাশিত এবং স্বীকৃতির দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয় তখন কমল নামের এক শিশুর প্রাণ রক্ষার জন্যে কবির আত্মদানের প্রেক্ষাপটে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘কে কথা কয়’। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে, কবি-নাট্যকার-নির্দেশক ও অভিনেতা আসাদুল ইসলামের নাট্যরূপ ও নির্দেশনায়, ম্যাড থিয়েটারের প্রথম প্রযোজিত নাটক ‘নদ্দিউ নতিম’ মঞ্চস্থ হলো গত ৫ জুন শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে। প্রহসনের হলাহলে কোনভাবেই যখন মতিন উদ্দিন কবির স্বীকৃতি পেল না, পত্রিকা কবিতা ছাপল না, বই প্রকাশিত হলো না তখন প্রহসনকারীদের মেধাশূন্যতা চিনিয়ে দিতে এবং নিজের প্রতি অভিমানে নিজের সব রচনা প্রকাশ করতে থাকল উজবেক কবি নদ্দিউ নতিম ছদ্মনামে। বিদেশী কবি বলে নদ্দিউ নতিম আদৃত হলো সর্বমহলে কিন্তু স্বদেশী প্রেমিক মতিন উদ্দিন প্রেয়সী স্কলার নিশুর থেকে সরে দাঁড়াল নিজের অযোগ্যতাকে মেনে নিয়ে। বিয়েতে বসার সুযোগও এল কিন্তু কাব্যাকাশ পানে চেয়ে চেয়ে বাসর শয্যা আর তার হলো না। অর্থ সংস্থানের জন্যে চাকরি জুটল অটিস্টিক শিশু কমলের হাউস টিউটর হিসেবে কিন্তু বয়সের বিস্তর ব্যবধানের মতোই বাবা-মায়ের ডিভোর্সকালে কমলের মনোজগতে ঘাত-প্রতিঘাতে মতিন উদ্দিনের জীবনে স্বাভাবিকতা এল না। অবশেষে কমল যখন জানতে পারল তার জন্ম স্বীকৃতি মিথ্যা তখন বিল্ডিংয়ের কার্নিশ থেকে কমল ঝাপিয়ে পড়ে মরতে গেলে কবি মতিন উদ্দিন নিজের জীবন উৎসর্গ করে কমলকে বাঁচিয়ে রাখতে। সূর্যের উদয়কালে আত্মাহুতি দেয়া মতিন উদ্দিনের তৃপ্তি এটুকুই। কমলের মা মুনা জানল মতিন উদ্দিন রূপে ভুলেনি বলেই অরূপেই তার অবগাহন। আর রইল পার্থিব জগতে প্রতিষ্ঠিত কাল্পনিক কবি নদ্দিউ নতিম যে অন্তত জানে শূন্যে তার পূর্ণতা তার সৃজন ও নির্মাণের কারিগর জীবন বৈষম্যে অবহেলিত কিন্তু শিল্পলোকে উদ্যাপিত কবি মতিন উদ্দিন। আর এখানেই শেষ হয় হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের নাট্যরূপ নাটক নদ্দিউ নতিম। উপন্যাস এবং নাট্যরূপ দুটোই এত পরিপূরক যে কোন কিছুই কারও বুঝতে অসুবিধা হয় না। এই উপন্যাস নাট্যরূপ দেয়ার ক্ষেত্রে আসাদুল ইসলাম একদিকে যেমন অটিস্টিক শিশুদের মনোজগতকে সকলের সামনে ভিন্ন মাত্রায় আনলেন, সংবেদনশীল করলেন ঠিক তেমনি কি পরিমাণ মনোবৈকল্য নিয়ে অনেকের যাপিত জীবন তাও বোঝাতে পারলেন। নাট্যরূপের একটাই সীমাবদ্ধতা ডিসেøশিয়া রোগের সাদৃশ্যভাবে নাটকটির নামকরণ করা। এটি একদিকে যেমন উচ্চারণের জন্যে কঠিন পথপরিক্রমায় তথা মিস কমিউনিকেশন তেমনি কবির প্রতি সম্পাদক-প্রকাশকের মতোই নাট্যরূপের প্রতি নাট্যরূপকারের উদাসীন প্রহসন। আসাদুল ইসলাম নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেন, কবিরা কখনও হারে না তা সে সৃজনে কিংবা যাপিত জীবনে। নাট্যসৃজনে নির্দেশক আসাদুল ইসলামের বড় দক্ষতা তিনি চমৎকার একটা পা-ুলিপির ওপর ভিত্তি করে অভিনয় নির্ভর একটি প্রযোজনা দর্শকদের উপহার দিতে পেরেছেন। ইমপ্রোভাইজেশন বাড় বাড়ন্ত আর কোরিওগ্রাফি-ডিরেক্টোরিয়াল লম্ফঝম্ফের তলে চাপা পড়ে দর্শকদের যখন নাভিশ্বাস ওঠবার দশা তখন এ নাটকে জীবন খুঁজে পাওয়া যায়, বঞ্চনার মর্মমূল ছুঁয়ে আবেগ জাগ্রত হয় আর ন্যূনতম সেট-লাইট-মিউজিকের আবহে তেজদীপ্ত তিন অভিনেতা-অভিনেত্রীকে চিনিয়ে দেয়। অভিনয় আর স্ক্রিপ্টের বর্তমান খরারকালে এ যে কত বড় প্রাপ্তি সে প্রশংসা করতে যেয়ে থামতে হয় দুটি কারণে। প্রথমত, নাটকের শুরুর সময়ে দর্শকদের বসিয়ে বাধ্যতামূলক বক্তৃতা শোনাবার অবসান হওয়া দরকার এখনই। দই পাততে দরকার হয় নির্জনতা, কিছুতেই কোলাহল মিুখরতা নয়। দ্বিতীয়ত, অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে নাট্যরূপের পরিধি যেমন আছে তেমনই থাকার কথা। অর্থাৎ আহমদ ফারুককে না চিনালে কমলের মানসিক ভাবটা ফোটে না অথবা লইয়ার মনোনয়নে মুনার আহ্বান না দেখালে মুনা চরিত্রের প্রতি করা হয় ইনজাস্টিস। এতদসত্ত্বেও নিশুর পরিণতির সংক্ষিপ্তকরণ কিংবা অন্যকোনভাবে সীমিত সময় কমানো গেলে অর্থাৎ একঘণ্টা বিশ থেকে ত্রিশ মিনিটের মধ্যে নাটকের সময়সীমায় বাঁধতে পারলে নাটকটা চলতে পারে ক্লান্তিহীনভাবে নিরবধি এবং নয়নাভিরাম তার অনুভূতি। অনুভূতি এত সতেজ এবং টাটকা হতে পারে যে, মঞ্চনাটকে তা অনেকদিন ধরে ডিরেক্টরদের ডিরেক্টোরিয়াল অত্যাচারে ভুলতেই যেন বসেছিল নাট্যানুরাগী দর্শকরা। এই অনুভূতি সৃজনে তিন অভিনেতা-অভিনেত্রী যেমনÑ ত্রিমাত্রিক ডাইমেনশানে। মতিন উদ্দিন চরিত্রে আসাদুল ইসলামের ব্যর্থ কবির যন্ত্রণা, প্রতিষ্ঠিত কবির প্রহেলিকা, সম্পাদক-প্রকাশকদের বৈরিতা, নিশুর প্রতি আর্দ্রতা, মুনার প্রতি মুগ্ধতা কিন্তু মুহূর্তেই গুটিয়ে নেয়া, কাব্য সৃজনের নিমগ্নতা, কমলের মনোজগতের সঙ্গে একাত্মতা, ভীতির অলিগলির বাসিন্দা সত্ত্বেও মূল সময়ে বীরত্বের রাজপথে বুক উঁচিয়ে হেঁটে চলা তথা বহুমাত্রিক চরিত্রে বৈচিত্র্যপূর্ণ রসাস্বাদনে কায়িক-বাচিক অভিনয়ের যে প্রচ-তা ধারণ ও উপস্থাপন করলেন অভিনেতা আসাদুল ইসলাম তা এক কথায় অনন্য এবং অভাবনীয়। অপরদিকে অর্থনৈতিকভাবে অভিজাত্য, রূপের কারণে সকলের কাছে আদৃত কিন্তু মতিন উদ্দিনের মতো এক অনামি কবির কাছে নিজে তুচ্ছ তথা অহংবোধ এবং অহংএর কার্যকারণ খুঁজে না পাওয়ার দাম্ভিকতা ফুটিয়ে তোলায় মুনারূপী অভিনেত্রী সোনিয়া হাসান তেজদীপ্ত-বলিষ্ঠ এবং আকর্ষণীয়। আর কমল চরিত্রের বিস্ময়কর মেধা, অবধ্য উচ্চারণ, বিবেচনার মৌলিকতা, সিদ্ধান্ত নেবার নিরপেক্ষতা এবং সৎ মানুষ মতিন উদ্দিনের খোঁজ পেয়ে আঁকড়ে ধরা প্রভৃতি অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে শিশু অভিনয় শিল্পী আর্য মেঘদূত কাব্যাকাশের মেঘদূত সাহিত্যের মতোই সুপ্রতিভায় প্রজ্বলিত। প্রশংসা করতে এসে নিজের মহিমা কীর্তন করা প্রতিনিধিদের পাল্লায় পড়ে পথ বিচ্যুত না হলে সুবচন নাট্যদলের রূপবতী নাটকে দৌড়াদৌড়ির মধ্যে দিয়ে যে আর্য মেঘদূতের হাতেখড়ি সেই আর্য মেঘদূত হতে পারে আমাদের নাট্যাঙ্গনের সু-অভিনয়ের খানিকটা নির্ভরতা। জীবনের কুহেলিকাময় পথ চলায় ক্লান্তির অবসানে শান্তির পরশ ছোয়ায় হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস আশ্রিত ম্যাড থিয়েটারের নাটক নদ্দিউ নতিম। -অপূর্ব কুমার কু-ু
×