ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সিরিয়া থেকে সরছে না রাশিয়া

প্রকাশিত: ০৭:১৬, ৮ জুন ২০১৬

সিরিয়া থেকে সরছে না রাশিয়া

গোটা সিরিয়ায় রাশিয়ার সেনা স্থাপনাগুলোয় শোভা পাচ্ছে পুতিনের ছবি সংবলিত পোস্টার। তাতে লেখা : ‘রুশ সশস্ত্র বাহিনী বিশ্ব নিরাপত্তার রক্ষক।’ রাশিয়ার সিরিয়া মিশনের পেছনে এমন একটা ধারণাই সবার সামনে তুলে ধরা হয়। গত বছর সিরিয়ায় হস্তক্ষেপের সময় রাশিয়া দেশবাসীর সামনে টিভির পর্দায় নিজের এমন এক ভাবমূর্তি তুলে ধরাই শুধু চেষ্টা করেনি, নিজেকে একটা বৈশ্বিক শক্তি হিসেবেও পুনর্প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পেয়েছে এবং রাশিয়ার স্বার্থ হিসাবের মধ্যে নিতে পাশ্চাত্যকে বাধ্য করেছে। তাই গত মার্চ মাসে পুতিন যখন ঘোষণা করলেন যে রাশিয়ার সিরিয়া মিশন অর্জিত হওয়ায় রুশ বাহিনীর মূল অংশ এখন সিরিয়া থেকে চলে যেতে পারে তখন তিনি আসলে আংশিক সত্য বলছিলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক সময় রাশিয়াকে আঞ্চলিক শক্তি বলে উল্লেখ করতেন। সেই রাশিয়াকে আজ মোটেই আঞ্চলিক শক্তি বলে মনে হচ্ছে না- বরং তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। সিরিয়ায় শান্তির যে কোন পথ মস্কোর সঙ্গে যুক্ত। একমাত্র রাশিয়া ও আমেরিকাই সিরিয়ার যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে- যদিও তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ ও লক্ষ্য সম্পূর্ণ আলাদা। যাই হোক, সিরিয়া থেকে রাশিয়ার সৈন্য সরিয়ে নেয়ার যত কথাই শোনা যাক না কেন বাস্তবে সেই প্রত্যাহার শেষ পর্যন্ত হয়নি। সিরিয়া থেকে রুশ সৈন্য উঠিয়ে নেয়ার অর্থ সেখানে রুশ প্রভাব পরিত্যাগ করা এবং সিরিয়াকে প্রেসিডেন্ট বাশারের অপর মিত্র ইরানের হাতে তুলে দেয়া। সেটা নিশ্চয়ই রাশিয়ার কাম্য হতে পারে না। তাই সৈন্য প্রত্যাহার না করে পুতিন বরং সিরিয়ায় রুশ সৈন্য সংখ্যা কাটছাঁট করেছেন। তাই মার্চ মাসে পুতিন সিরিয়া থেকে রুশ বাহিনীর মূল অংশ সরিয়ে নেয়ার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন সেটি আসলে রুশ বাহিনীর উপস্থিতিকে পাকাপোক্ত করার একটা কৌশলমাত্র। রুশ সশস্ত্রবাহিনী কিছু যুদ্ধবিমান স্বদেশে ফিরিয়ে নিয়েছে সত্য। তবে সেই সঙ্গে সিরিয়ার একগুঁয়ে প্রেসিডেন্ট বাশারকে এই সঙ্কেতও দিয়ে দেয়া হয়েছে যে এটাকে যেন পাকাপোক্ত ব্যবস্থা হিসেবে ধরে নেয়া হয়। সিরিয়ায় রুশ পদাতিক বাহিনীর উপস্থিতি এখনও বিপুল। সিরিয়ার লাকাতিয়া বন্দরের কাছে খমেইমিন বিমান ঘাঁটিতে সর্বক্ষণ জঙ্গী ও বোমারু বিমান ওঠানামার গর্জন ধ্বনি। নিবিড় বিমান সমর্থন দেয়ার জন্য মস্কো থেকে নতুন এ্যাটাক হেলিকপ্টার এসেছে। চার শ’টি শক্তিশালী বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র পূর্ব ভূ-মধ্যসাগরে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যূহ বজায় রেখেছে। এই প্রতিরক্ষা ব্যূহের দ্বারা ন্যাটোকেও ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে। রণাঙ্গনে রাশিয়ার ভূমিকাই প্রধানত চোখে পড়ে। যখনই রুশ ও সিরীয় বাহিনীর যৌথ অভিযান চলে সে অভিযান চলে রাশিয়ার খবরদারিতে। সিরিয়ার বাহিনীর দিকে এক নজর দিলেই বোঝা যাবে কেন তারা রুশ বাহিনী কর্তৃত্বকে মেনে নিয়েছে। রুশ বাহিনী তাদের তুলনায় অনেক সুশৃঙ্খল ও উন্নত অস্ত্রপাতি সাজসরঞ্জামে সমৃদ্ধ। অন্যদিকে সিরীয়রা অগোছালো ও বিশৃঙ্খল। রুশ বিমান ঘাঁটিতে সম্প্রতি বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজের মহড়ায় রুশ সৈন্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ক্ষুদে সিরীয় ইউনিটটিকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট বাশার পরিপূরক শক্তি হিসেবে সিরীয় বাহিনীতে লেবাননী মিলিশিয়া বাহিনী হিজবুল্লাহর যোদ্ধা, বিদেশী আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং গু-া তুরস্কদের এনেছেন। সিরীয় চেক পয়েন্টগুলোতে জগাখিচুড়ি ও জীর্ণ পোশাকধারী অনিয়মিত সৈন্যদের নজরদারি ও তল্লাশি চালাতে দেখা যায়। সিরিয়ায় রাশিয়ার বোমা অভিযান বেশ বড় আকারে হয়েছে। তবে রাশিয়া আরও অনেক কিছুও করেছে। সম্প্রতি আইএসের কাছ থেকে পুনর্দখল করা পালমিরায় একটা ছোট আকারের ঘাঁটি স্থাপন করেছে রাশিয়া। বাহ্যত দেখানো হয়েছে যে ওই এলাকাকে মাইনমুক্ত করার কাজে নিয়োজিতদের জন্যই এই ঘাঁটি স্থাপন। রাশিয়ার বিশেষ বাহিনী গোয়েন্দাবৃত্তি ও টার্গেটিংয়ের কাজে জড়িত। রুশ প্রশিক্ষকরা সিরীয় সৈন্যদের ট্রেনিং দেয়। রুশ অফিসাররা স্থানীয় রাজনীতিতেও যুক্ত হয়ে পড়েছে যা যুদ্ধবিরতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। রুশ বাহিনী সিরিয়ায় দীর্ঘকালের জন্য থাকতে এসেছে। রুশ প্রতিরক্ষা দফতর সিরীয় অভিযানে অংশগ্রহণকারীদের কৃতিত্বের জন্য পদক দেয়ার সময় ১০ হাজার পদকের ফরমায়েশ দিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট পুতিন সিরিয়া অভিযানকে শুভ-অশুভের লড়াই হিসেবে দেখিয়েছেন। সেই শুভ-অশুভের লড়াইয়ে রুশ-সিরীয় বাহিনী প্রায়শই মডারেট বিদ্রোহীদের চরমপন্থী হিসেবে টার্গেট করেছে। বরাবরই বাশারের পরিকল্পনা ছিল বিশ্ববাসীর কাছে এটা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা যে তিনি তার দেশের বিক্ষুব্ধ নাগরিকদের বিরুদ্ধে নয় বরং জিহাদীদের বিরুদ্ধে লড়ছেন। বাস্তবে তিনি পরোক্ষভাবে আইএসের উত্থানে সাহায্য করেছেন এবং মডারেটদের হত্যা করে তার নিজেরই জনগণের একাংশকে চরপন্থীদের খপ্পরে ঠেলে দিয়েছেন। সিরিয়ার ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ এত বাড়ছে যে, প্রেসিডেন্ট বাশারের কিছু সমর্থকও ক্লান্ত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। পাশ্চাত্য মনে করে যে রাশিয়া সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যত কথা বলছে তা আসলে বাশারের স্বৈরাচারী সরকারকে সমর্থন করার একটা ধূম্রজাল মাত্র। সিরিয়া সমস্যা সুষ্ঠু রাজনৈতিক সমাধানে রাশিয়া কাজ করছে বলে ক্রেমলিন মত দাবিই করুক না কেন সেটা খুব কম লোকই আজ বিশ্বাস করে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×