ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কিংবদন্তির মহাপ্রয়াণ

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ৮ জুন ২০১৬

কিংবদন্তির মহাপ্রয়াণ

তাঁর কোন সম্রাজ্য ছিল না, তবু তিনি ছিলেন সম্রাট। হেভিওয়েট বক্সিংয়ের অবিসংবাদিত সম্রাট তিনি। সর্বকালের সেরা মুষ্টিযোদ্ধা ছিলেন। এক নামে সারা বিশ্ব তাঁকে চেনে। তিনি মোহাম্মদ আলী। বর্ণাঢ্য খেলোয়াড়ি জীবন ছিল তাঁর। খেলোয়াড়ি জীবনে অনেক বড় বড় লড়াইয়ে রিংয়ে নেমেছেন, দর্শক মাতিয়েছেন। জিতেছেনও। কিন্তু জীবনের শেষ লড়াইয়ে জিততে পারলেন না। হেরে গেলেন, হারতে হলো। যে লড়াইয়ে একদিন সবাইকে হারতেই হয়। মোহাম্মদ আলীও হেরে গেলেন। মৃত্যু তাঁকে ইহলোক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল পরলোকে। চলে গেলেন না ফেরার দেশে। যেখান থেকে কেউ কোনদিন ফিরে আসেনি। তিনিও আর কোনদিন আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না। আগামী বৃহস্পতিবারে একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানের পর শুক্রবারে কেএফসির ইমাম সেন্টারে স্মৃতিচারণ, শোক সভা ও লুইসভিলের রাস্তায় মোহাম্মদ আলীর লেখা ব্যুলেভার্ড ঘুরয়ে আনার পর শেষে জানাজার পর তাঁর জন্মস্থান লুইসভিলে মুসলিম রীতি অনুসারে কেভহিল কবরস্থানে দাফন করা হবে। জন্মস্থানে দাফনের এমন ভাগ্য খুব কম মানুষেরই হয়। মোহাম্মদ আলীর হবে। এই লুইসভিলেই জন্ম, এখানেই বেড়ে ওঠা আর এখানেই তিনি ক্যাসিয়াস মার্সোলাস ক্লে থেকে মোহাম্মদ আলী হওয়া সব মিলিয়ে এটাই ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় স্থান। সেই প্রিয়স্থানে শেষ নিদ্রায় শায়িত হওয়া কম ভাগ্যের নয়। তিনি ছিলেন গণমানুষের প্রতিনিধি। আর তাই তাঁর শেষকৃত্যে আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন থেকে শুরু করে সর্বশ্রেণীর, সর্ববর্ণের মানুষ উপস্থিত থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। এই লুইসভিলে তাঁর জীবদ্দশায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাঁকে নিয়ে মিউজিয়াম ‘মোহাম্মদ আলী সেন্টার’। দাফনের আগে সর্বসাধারণের শেষ শ্রদ্ধা জানানোর সুয়োগ দেয়া হবে। দীর্ঘদিন ধরে ‘পারকিন্স’ রোগে ভুগছিলেন বক্সার দ্য গ্রেট মোহাম্মদ আলী। পারকিন্স রোগ প্রতিরোধে তহবিল গঠনেও তাঁর অনবদ্য ভূমিকা ছিল। গত এপ্রিলেও তহবিল গঠনের জন্য একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন। যদিও তখন তিনি নিজেই পারকিন্স রোগে আক্রান্ত। গত বৃহস্পতিবারে পারকিন্সের সঙ্গে প্রচ- শ্বাসকষ্ট নিয়ে ৭৪ বছর বয়সে মোহাম্মদ আলী আমেরিকার এ্যারিজোনার ফিনিক্স হাসপাতালে ভর্তি হন। তবে ডাক্তারদের চিকিৎসার জন্য খুব বেশি সময় দেননি। পরদিন শুক্রবারে সারা বিশ্বকে কাঁদিয়ে ইহলোকের সকল মায়া ছেড়ে চলে যান পরপারে। মৃত্যুর সময়ে তাঁর পরিবারের লোকেরা পাশেই ছিল। মেয়েরা পাশে বসে হাত ধরে থেকেছে। বাবাকে শেষ চুমু দিয়ে বিদায় জানিয়েছে। একটা সমৃদ্ধ জীবন ছিল মোহাম্মদ আলীর। বিশ্বের সর্বকালের সেরা বক্সার ছিলেন। রিংয়ে তার প্রজাপতিনৃত্য আজও অনেক বক্সিংপ্রেমীর মনে দোলা দেয়। মৌমাছির মতো তীব্রগতিতে প্রতিপক্ষকে হুল ফুটিয়ে ঘায়েল করায় তার সমকক্ষ কেউ ছিল না। আর রিংয়ে তো তাঁর মুখে খই ফুটত। কথার তিরে প্রতিপক্ষকে কাবু করে ফেলতেন অর্ধেকটা। তারপরও বলা যায়, তিনিই বক্সিংয়ের বুনো আদিমতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে বক্সিংকে একটি শিল্পসম্মত আধুনিক খেলায় রূপ দেন। সারা বিশ্বে জনপ্রিয় করে তোলেন। বক্সিংয়ের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, প্রতিপক্ষকে মারতে মারতে মেরে ফেলে শিরোপা জেতার ঘটনাও কম নয়। সেখান থেকে সরে আসেন মোহাম্মদ আলী। পরবর্তীকালে অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করে। তাঁর আত্মরক্ষার কৌশল, কোথায় কীভাবে খেলতে হবে সে জ্ঞান তাঁকে এতদূর নিয়ে আসে। মাত্র ১২ বছর বয়সে বক্সিংয়ের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন মোহাম্মদ আলী। তারও একটা গল্প আছে। সে গল্পে পরে আসছি। তিনিই একমাত্র বক্সার হিসেবে তিনটি হেভিওয়েট বক্সিংয়ের শিরোপা জয়ের অনন্য কৃতিত্ব লাভ করেন। তিনি সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে ১৯৬৪ সালে মাত্র ২২ বছর ৩৯ দিন বয়সে সনি লিস্টনকে হারিয়ে প্রথম বিশ্বহেভিওয়েট শিরোপা জিতে বক্সিংবিশ্বকে জানিয়ে দেন ‘আমিই বক্সিং সম্রাট’। যদিও ম্যাচের আগে আলী ঘোষণা দিয়েছিলেন, লিস্টনকে হারাতে তাঁর ৬ষ্ঠ রাউন্ডের বেশি লাগবে না। কাকতালীয়ভাবে ৬ষ্ঠ রাউন্ডের পর আর তাকে রিংয়ে নামতে হয়নি। ৬ষ্ঠ রাউন্ডের পর লিস্টন আর রিংয়ে আসেননি। ফলে আলীই যে বক্সিংয়ের নতুন সম্রাট সেটা প্রমাণ করতে খুব বেশি সময়ও লাগেনি। লিস্টনের বাড়ির সামনে গিয়েও চিৎকার করে বলেনÑ আমিই জিতব, তুমি নয়। বস্তুত সেটাই হয়েছিল। যদিও অনেকে মনে করেছিলেন, আলীর কাছে লিস্টনের পরাজয় একটি দুর্ঘটনামাত্র। তাদের মুখে ছাই দিয়ে ঠিক এক বছর পর ১৯৬৫ সালের ২৫ মে ফিরতি ম্যাচে লিস্টনকে হারাতে আলীর এক মিনিটও লাগেনি। প্রথম রাইন্ডেই কুপোকাৎ হন লিস্টন। এরপরও আলীর শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিতে অনেকে দ্বিধাগ্রস্ত হন। এরপর ১৯৬৫ থেকে ‘৬৭ সাল পর্যন্ত মোহাম্মদ আলীকে তাঁর শিরোপা ধরে রাখার জন্য ফ্রয়েড প্যাটারসন, জর্জ শুভালো, হেনরি কুপার, ব্রায়ান লন্ডন, কার্ল মিল্ডেনবার্গার, ক্লিভল্যান্ড উইলিয়ামস, অরনি টারেল ও জোরা ফোলোর বিপক্ষে ৮ বার রিংয়ে নামতে হয়। হেভিওয়েট বক্সার অরনি টারেল তো চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন, মোহাম্মদ আলীকে তিনি বিশ্বসেরার খেতাব জিততে দেবেন না। কিন্তু রিংয়ে নামার পর বজ্রমষ্টিতে কাঁপিয়ে দিয়ে পরাজিত করতে মোহাম্মদ আলীর ১৫ মিনিটও সময় লাগেনি। তার এই বেটার পারফর্মেন্সের পেছনে উচ্চতা একটা বড় ভূমিকা রেখেছিল। বক্সারদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশি লম্বা। এটা তাঁর বক্সিং জীবনে অনেক কাজে এসেছিল। ১৯৬৭ সালে ২৮ এপ্রিল বক্সিংয়ের ইতিহাসে ঘটে একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা। পরাজিত শক্তির চক্রান্তের জালে ধরা দিতে হয় আলীকে। এ সময়ে তাঁকে ভিয়েতনামের যুদ্ধে যেতে বলা হয়। ভিয়েতনামের নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করতে তাঁর বিবেকে বাধে। আর তাই তিনি যুদ্ধে যেতে সরাসরি অস্বীকার করেন। আর এই অপরাধে আলীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। বিনা অপরাধে সাড়ে তিন বছর কারাদ- খাটলেন। খুশি হলো পরাজিত শক্তি। আর আলীর জীবন থেকে ঝরে গেল বছরের সাড়ে তিনটি (২৫-২৮) স্বর্ণবছর। ফলে এ সময়ে বঞ্চিত হলেন অনেকগুলো শিরোপা লাভ করা থেকে। আলী জেল থেকে ছাড়া পাবার আগে বিশ্ব মুষ্টিযোদ্ধা সংস্থা একটি মিনি টুর্নামেন্টের আয়োজন করে। রিংয়ে না হারলেও নোংরা রাজনীতির খেলায় হেরে গেলেন মোহাম্মদ আলী। সে টুর্নামেন্টে আলীকে অংশগ্রহণের সুযোগ না দিয়ে কোন ম্যাচ ছাড়াই জো ফ্রেজিয়ারকে শিরোপাজয়ী ঘোষণা করা হয়। ১৯৭০ সালে মোহাম্মদ আলী কারাগার থেকে ছাড়া পান। ছাড়া পাবার পর তিনি জেরি কোয়ারিকে হারিয়ে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার উৎসব সেলিব্রেট করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে আমেরিকার মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত আলোড়নসৃষ্টিকারী ‘ফাইট অব দ্য সেঞ্চুরি (শতবর্ষের শ্রেষ্ঠ লড়াই)’র ১৫ রাউন্ডের লড়াইয়ে খুব অল্পের জন্য জো ফ্রেজিয়ারের কাছে হেরে যান মোহাম্মদ আলী। এ লড়াইয়ের আগ পর্যন্ত দুজনই ছিলেন অপরাজিত। এতে করে বেশ ভেঙে পড়েন তিনি। ফলে এ পরাজয়ের পর কেন নরটনের কাছেও হেরে যান। এ কারণে এরপর জর্জ ফোরম্যান বিশ্ব হেভিওয়েটের শিরোপা জেতায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে জো ফ্রেজিয়ারের বিরুদ্ধে ফিরতি ম্যাচের সুযোগ পেলেন না আলী। ফলে হারের প্রতিশোধ নেয়া হলো না। তবে হাল ছাড়লেন না। তিনি তো হাল ছাড়ার মানুষও নন। অপেক্ষায় থাকলেন। ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে কঙ্গোর (জায়ার) কিনসাসায় জর্জ ফোরম্যানকে নক আউটে পরাজিত করে শিরোপা পুনরুদ্ধার করেন মোহাম্মদ আলী। ২৬ বছরের মাসলম্যান জর্জ ফোম্যান তখন টপফর্মে। এর আগে টানা ৪০টি লড়াইয়ে অপরাজিত। আর তখন আলীর বয়স ৩২। এর আগে হারানো শিরোপা পুনরুদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে মাত্র একটি। আলী জিতলে ঠাঁই পাবেন ইতিহাসের পাতায়। পাল্লা বরাবরই ফোরম্যানের দিকেই ভারি ছিল। এমন একটা অবস্থায় রিংয়ে নামেন এবং ফোরমানকে হারিয়ে শিরোপা পুনরুদ্ধার করেন মোহাম্মদ আলী। এই ম্যাচে আলী একটি ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন। সাধারণত বক্সাররা মারতেই বেশি পছন্দ করেন। কিন্তু আলী করলেন উল্টোটা। তিনি ফোরম্যানকে ঘুষি মারার সুযোগ করে দেন। ফলে ঘুষি খেয়ে আলী নয়, ঘুষি মারতে মারতে একসময় ফোরম্যানই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। ৮ম রাইন্ডে ফেরম্যান যখন অনেকটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েন আলী তখন তাঁর মোক্ষম আঘাতটি হেনে ফোরম্যানকে পরাজিত করেন। আর সেই সঙ্গে প্রায় এক দশক পর আলী তাঁর শিরোপা পুনরুদ্ধার করেন। এই ম্যাচটি বক্সিংয়ের ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা ম্যাচ হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে আছে। এর পরের বছর ১৯৭৫ সালে ম্যানিলায় জো ফ্রেজিয়ারের বিপক্ষে রিংয়ে নামেন মোহাম্মদ আলী। রিংয়ে নামার আগে তিনি কঙ্গোয় পরাজয়ের কথা ভোলেনানি। প্রতিশোধের আগুন জ্বলজ্বল করছিল তাঁর চোখে। এটিকেও অনেকে মুষ্টিযুদ্ধের ইতিহাসের অন্যতম সেরা আরেকটি ম্যাচ বলে মনে করেন। এ ম্যাচে আলীকে লড়তে হয় ১৪ রাউন্ড। প্রতিশোধের এ ম্যাচে চতুর্দশ রাউন্ডেই আলীর কাছে ধরাশায়ী হন জো ফ্রেজিয়ার। আর এরই সঙ্গে আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ায় শিরোপা জেতার এক অনবদ্য রেকর্ড গড়েন ‘বক্সার দ্য গ্রেট মোহাম্মদ আলী। তার আগে বা পরে এমন কৃতিত্ব আর কেউ দেখাতে পারেনি। এ জন্যই তিনি ‘আলী দ্য গ্রেট’। টানা ১০ বছর শিরোপা ধরে রাখার পর ১৯৭৮ সালে তামাম বক্সিংবিশ্বকে অবাক করে দিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে শিরোপা হারান তার থেকে ১০ বছরের ছোট বক্সার অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন লিয়ন স্পিনসকের কাছে। তবে সে শিরোপা পুনরুদ্ধার করতে তাঁর এক বছরও অপেক্ষা করতে হয়নি। আট মাসের মাথায় ফিরতি ম্যাচে লিয়ন স্পিনসকে হারিয়ে শিরোপা পুনরুদ্ধার করেন। তখন আলীর বয়স ৩৬। শিরোপা পুনরুদ্ধারের এই ম্যাচ দেখতে টেলিভিশনের সামনে সেদিন কোটি কোটি মানুষের উন্মুখ চোখ অপেক্ষা করছিল। এ জয়ের পর তিনি অবসরের ঘোষণা দিলেও ২ বছর পর ১৯৮০ সালের ২ অক্টোবর আবার তিনি রিংয়ে ফিরে আসেন ল্যারি হোমসের কাছ থেকে শিরোপা পুনরুদ্ধারের জন্য। হোমস ছিলেন আলীরই ছাত্র। তিনি চাননি আলীর বিপক্ষে লড়তে এবং তাকে সর্বসমক্ষে হারাতে। তারপরও না চাইলেও অনেক কিছু করতে হয়। সেটাই হলো। আলী রিংয়ে ফিরলেন। কিন্তু যা চেয়েছিলেন সেটা হলো না। জিততে পারলেন না। জয়ের মুকুটটা হোমসের মাথায়ই উঠল। কিংবদন্তি বক্সার মোহাম্মদ আলী জীবনের শেষবার রিংয়ে নামলেন ১৯৮১ সালের ১১ ডিসেম্বর। প্রতিপক্ষ ছিলেন ট্রেভর বারবিক। ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হলো বাহামায়। জীবনের শেষ লড়াইয়েও জিততে পারলেন না এই বক্সিং লিজেন্ড। চাঁদের কলঙ্কের মতো একটা দাগ নিয়ে জীবনের শেষ ম্যাচে বক্সিং রিং থেকে চিরতরে বিদায় নিলেন সর্বকালের সেরা হেভিওয়েট বক্সার মোহাম্মদ আলী দ্য গ্রেট। এবারে ফিরে আসি ক্যাসিয়াস থেকে মোহাম্মদ আলী হয়ে ওঠা এবং আলীর বক্সার হয়ে ওঠার গল্পে। ১৯৪২ সালের ১৭ জুন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকির এক সুন্দর শহর লুইসভিলের এক খ্রীস্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ক্যাসিয়াস মার্সোলাস ক্লে। তাঁর পিতা ক্যাসিয়াস সিনিয়র এবং মা ওডেসা। তাঁর পিতা ছিলেন একজন পেইন্টার। তাদের দুই ছেলের বড় ছিলেন আলী। ছেলেবেলায় তাঁকে আদর করে লুইসভিল লিপ নামে ডাকা হতো। ধর্ম সস্পর্কে ছেলেবেলা থেকেই তাঁর অনেক জ্ঞান ছিল। ইসলাম ধর্মের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৬৪ সালে সনি লিস্টনকে হারিয়ে প্রথমবার বিশ্ব হেভিওয়েট শিরোপা জয়ের ২ দিন পর সবাইকে চমকে করে দিয়ে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি তার ক্যাসিয়াস মার্সোলাস ক্লে নাম পরিবর্তন করে ‘মোহাম্মদ আলী’ নাম গ্রহণ করেন। তিনি একা নন, সঙ্গে তাঁর ছোট ভাই রুডলফও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ক্যাসিয়াস হন আলী আর রুডলফ হন রহমান। তিনি কেবল ইমলাম ধর্ম গ্রহণ করেই বসে থাকেননি। সারা বিশ্বে ইসলামের মহাত্মকে ছড়িয়ে দিতে জীবনভর কাজ করে গেছেন। মোহাম্মদ আলীর মুষ্টিযোদ্ধা হওয়ার নেপথ্যে একটা মজার ঘটনা আছে। ঘটনাটা এ রকম, আলী ও তাঁর ২ বছরের ছোট ভাই রহমান একই সঙ্গে স্কুল জীবন শুরু করেন। এ সময়ে তাদের বাবা ৬০ ডলার দিয়ে দুজনকে একটি বাইসাইকেল কিনে দেন। এতে করে দুই ভাই খুব খুশি হয়। একদিন দুই ভাই সাইকেলে চড়ে একটা এক্সজিবিশন দেখতে যায়। সাইকেলটি বাইরে রেখে তারা এক্সজিবিশন দেখে ফিরে এসে দেখে তাদের সাইকেলটি চুরি হয়ে গেছে। এতে করে তারা খুব ভেঙে পড়লেন। কাছে একজন পুলিশকে পেয়ে তাকে কমপ্লেন করলেন। পুলিশ চোরকে পেটানোর জন্য আলীকে বক্সার হবার পরামর্শ দিলেন। সেই থেকে আলী বক্সিং শেখার ব্রত গ্রহণ করে। তা থেকেই জন্ম নেয় পরবর্তীকালের বিশ্বসেরা বক্সার মোহাম্মদ আলী। ব্যক্তিগত জীবনে আলী ৪টি বিয়ে করেন। ১৯৬৪ সালের ১৪ আগস্ট তিনি প্রথম বিয়ে করেন সানজি রোইকে। তাদের দুই সন্তানের জন্মের পর ১৯৬৬ সালে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন খালিদা বেলিন্দা আলীকে। ৪ সন্তানের জন্মের পর তার সঙ্গেও ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ১৯৭৭ সালের ১৯ আগস্ট আলী আবার বিয়ে করেন ভেরোনিকা স্পোর্শো আলীকে। ১৯৮৬ সালে এ বিয়েও ভেঙে যায়। এ বছরই তিনি আবার বিয়ে করেন। তাঁর চতুর্থ স্ত্রীর নাম লনি উইলিয়ামস। এ বিয়েটাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে। আলীর চার পক্ষের সন্তানরা হচ্ছে- রাশিদা আলী, জামিলা আলী, মরিয়ম আলী, মিয়া আলী, খালীয়াহ আলী, হানা আলী, লায়লা আলী ও আসাদ আলী। মোহাম্মদ আলীর সন্তানদের মধ্যে তাঁর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন লায়লা আলী। তিনি বিশ্ব নারী হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতে পিতার মুখ উজ্জ্বল করেন। লায়লা আলী আমেরিকার বর্ষসেরা মহিলা ক্রিড়াবিদের সম্মানও লাভ করেন। তাঁর আরেক মেয়ে হানা আলী পিতার আত্মজীবনী ‘দ্য সোল অব এ্য বাটারফ্লাই’ এবং ‘মোর দ্যান এ হিরো লাইফ লেসন্স ফ্রম আলী’র লেখক। একজন খেলোয়াড় হিসেবেই নয়, একজন মানবদরদী মানুষ, মানবতাকর্মী হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্য। একাধারে একজন কবি হিসেবেও সুখ্যাতি কুড়ান। পালন করেছেন জাতিসংঘের শুভেচ্ছা দূতের দায়িত্বসহ অনেক বড় বড় দায়িত্ব। ইসলামকে সব মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য নিরলস কাজ করেছেন। ১৯৭১ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও তাঁর ছিল এক অনবদ্য অবদান। তিনি একাত্তরের যুদ্ধে মার্কিন নীতির সমালোচনা করেন এবং বিপক্ষে অবস্থান নেন। যদিও তার জন্য তাঁকে সরকারের বিষনজরে পড়তে হয়। ১৯৭৮ সালে মোহাম্মদ আলী তাঁর তৃতীয় স্ত্রী ভেরোনিকা স্পোর্শো আলীসহ বাংলাদেশে আসেন। বিমান বন্দরে তাঁকে জানানো হয় রাজকীয় অভ্যর্থনা। তাঁকে দেয়া হয় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব, বাংলাদেশের পাসপোর্ট। তিনি সর্বসমক্ষে বাংলাদেশের পতাকা ও পাসপোর্ট তুলে ধরে তাঁকে জানানো সম্মানের জবাব দেন। পরে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে তাঁকে একটি নাগরিক সংবর্ধনা দেয়া হয়। লাখে লাখে মানুষ সে নাগরিক সংবর্ধনায় যোগ দেয়। এ সফরে তিনি একটি একটি প্রদর্শনী মুষ্টিযুদ্ধেও অংশ নেন। আলীর ইচ্ছে অনুসারে তাঁর বিপক্ষে লড়েন ১২ বছরের এক শিশু মুষ্টিযোদ্ধা মো. গিয়াসউদ্দিন। যিনি এখনও বেঁচে আছেন। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের পাশে তাঁর নামে নির্মাণ করা হয় ‘মোহম্মদ আলী বক্সিং স্টেডিয়াম’। সে স্টেডিয়াম আজও আলীর স্মৃতিবহন করে যাচ্ছে। আলী যেখানেই গেছেন সেখানেই মিলেছে বিশাল সংবধনা ও পুরস্কার। ২০০৫ সালে পান আমেরিকার সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘প্রেডিডেন্সিয়াল পদক’সহ জীবনে অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন কিংবদন্তি এই বক্সার। মোহাম্মদ আলী আজ ইহলোকে নেই। নশ্বর এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন পরলোকে। তারপরও তিনি কোটি পাঠক-দর্শকের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন হাজার বছর। কেননা লিজেন্ডরা মরে না। মোহাম্মদ আলীদের মতো লিজেন্ডদের মৃত্যু নেই। লেখক : ক্রীড়ালেখক, কথাসাহিত্যিক ও সাহিত্য সংগঠক e-mail : [email protected]
×