ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সংসদে সম্পূরক বাজেট পাস

অতিরিক্ত ১৯ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা ব্যয়ের অনুমতি

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ৮ জুন ২০১৬

অতিরিক্ত ১৯ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা ব্যয়ের অনুমতি

সংসদ রিপোর্টার ॥ জাতীয় সংসদে মঙ্গলবার বিদায়ী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট কণ্ঠভোটে পাস হয়েছে। এ বাজেট পাসের মধ্য দিয়ে জাতীয় সংসদ ৩৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে অতিরিক্ত ১৯ হাজার ৮০৩ কোটি ৬২ লাখ ৮৮ হাজার টাকা ব্যয় করার অনুমতি দিয়েছে। এই অর্থ অনুমোদনের জন্য ৩১টি মঞ্জুরি দাবি উত্থাপন করা হয়। এসব দাবির মধ্যে ৬টির ওপর আনীত ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর আলোচনা হয়। বাকি মঞ্জুরি দাবিগুলো সরাসরি ভোটে প্রদান করা হয়। অবশ্য সব ছাঁটাই প্রস্তাবগুলোই কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। এরপর অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে সম্পূরক বাজেটটি কণ্ঠভোটে পাস হয়। চলতি বছরের মূল বাজেট ছিল ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার। কিন্তু বছর শেষে ২৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তাদের নির্ধারিত বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করতে পারেনি। অন্যদিকে ৩৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বরাদ্দের অতিরিক্ত ১৯ হাজার ৮০৩ কোটি ৬২ লাখ ৮৮ হাজার টাকা ব্যয় করেছে। সাংবিধানিক নিয়মানুসারে যেসব মন্ত্রণালয় বা বিভাগ বাজেটের বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করতে পারেনি তাদের হ্রাসকৃত বরাদ্দের জন্য সংসদের অনুমতির কোন প্রয়োজন হয় না। কিন্তু যেসব মন্ত্রণালয় বা বিভাগ অতিরিক্ত ব্যয় করেছে কেবল তাদের বরাদ্দই সংসদের অনুমতির প্রয়োজন হয়। এরই প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে এই সম্পূরক বাজেট পাস হয়। বছর শেষ হওয়ার আগে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অনুকূলে দেয়া বরাদ্দ কাটছাঁট করার ফলে চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের আকার দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬৪ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা। মূল বাজেট থেকে সংশোধিত বাজেটের ব্যয় হ্রাস পেয়েছে ৩০ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা। মঙ্গলবার সকাল সোয়া দশটায় ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়ার সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশন শুরু হয়। প্রশ্নোত্তর পর্ব টেবিলে উত্থাপনের পর সম্পূরক বাজেটের ওপর আনীত ছাঁটাই প্রস্তাব এবং বাজেট বরাদ্দের আলোচনা শুরু হয়। সম্পূরক বাজেটের ওপর মোট ৩১টি দাবির বিপরীতে মোট ১৯২টি ছাঁটাই প্রস্তাব আনা হয়। এর মধ্যে ৬টি মঞ্জুরি দাবির বিপরীতে আনীত ছাঁটাই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। সেগুলো হলোÑ অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র, স্থানীয় সরকার, শিক্ষা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। ব্যয় বরাদ্দের বিরোধিতা করে ছাঁটাই প্রস্তাব এনে আলোচনায় অংশ নেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী, জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম, নুরুল ইসলাম ওমর ও নূরুল ইসলাম মিলন। তবে তাদের সবগুলো ছাঁটাই প্রস্তাবই কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। সম্পূরক বাজেটের আওতায় ৩১টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বিপরীতে ১৯ হাজার ৮০৩ কোটি ৬২ লাখ ৮৮ হাজার টাকার বরাদ্দ অনুমোদন করা হয়। এর মধ্যে সর্বাধিক ৩ হাজার ৫৭৬ কোটি ২৭ লাখ ৬৩ হাজার টাকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে বরাদ্দ অনুমোদন করা হয়েছে। সবচেয়ে কম ৪৭ লাখ ৯১ হাজার বরাদ্দ অনুমোদন পেয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে বরাদ্দের বিরোধিতা ॥ এ খাতে অর্থমন্ত্রী ২৩৮ কোটির টাকার সম্পূরক বরাদ্দের দাবি উত্থাপন করলে তার বিরোধিতা করে ছাঁটাই প্রস্তাবকারীরা বলেন, গত সাত বছরে শুধু ব্যাংকিং খাতে ৩০ হাজার কোটি টাকা হরিলুট হয়েছে। প্রায় পৌনে তিন লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৮শ’ কোটি টাকার রিজার্ভ চুরি হয়ে গেলে। শোনা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তাও নাকি জড়িত। জনগণের টাকা লুট হচ্ছে, কিন্তু জড়িতদের কিছুই হচ্ছে না। ব্যাংকিং খাত যদি পঙ্গু হয়ে যায় তবে সর্বনাশ হবে। এজন্য আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে একটি কমিশন গঠনের মাধ্যমে সংস্কার করা দরকার। ব্যাংকিং খাতের ওপর জনগণের এখন কোন আস্থা নেই। পুঁজিবাজারেও বিনিয়োগকারীরা পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছে, অনেকে আত্মহত্যা করছে। জবাবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করেই এই সম্পূরক বাজেট আনা হয়েছে। তবে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে এমন কিছু ঘটেনি যাতে করে পুরো এই প্রতিষ্ঠানকেই ধুয়ে মুছে ফেলে দিতে হবে। তিনি বলেন, এখানে অনেক দোষ-ত্রুটি হয়েছে বটে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। কেউ কেউ বলছেন- এটি পুকুর চুরি নয়, সাগর চুরি হয়েছে। তাদের সঙ্গে আমিও বলতে চাই, পুকুর চুরি নয়, সাগর চুরি হয়েছে। কিন্তু আমরা কিন্তু বসে নেই। সুদের হার সুনির্দিষ্ট করার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে তিনি বলেন, আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে অর্থনীতির স্বাস্থ্যকে চাঙ্গা করা, সুদের হার নির্ধারণ করা নয়। সুদের হার নির্ধারণ করে যারা ব্যবসায়ী, ঋণ প্রদানকারী, বিনিয়োগকারীরা। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের বিরোধিতা ॥ এ মন্ত্রণালয় খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দের দাবির বিরোধিতা করে জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র ৪ জন সংসদ সদস্যরা বলেন, এটি খুবই সেনসেটিভ বিভাগ। প্রতিবছর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ দেয়া হয়, কিন্তু এসব অর্থ কোন খাতে ব্যয় হয়, সঠিকভাবে ব্যয় হচ্ছে কি না- তা বিস্তারিতভাবে জানানো হয় না। জনগণের অধিকার রয়েছে এই খাতে বরাদ্দের টাকা স্বচ্ছভাবে ব্যয় হচ্ছে কি না। জবাবে সংসদকার্যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, সবাই বলেছেন এ খাতে বরাদ্দের ব্যাপারে আপত্তি নেই, প্রশ্ন তুলেছেন স্বচ্ছতার। আমি দৃঢ়কণ্ঠেভাবে বলতে চাই- প্রতিরক্ষা খাতে সব ব্যয় পরিপূর্ণভাবে অডিট করা হয়, এখানে স্বচ্ছতার কোন অভাব নেই। আমার আমাদের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যরা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে দেশের জন্য যে সম্মান বইয়ে আনছেন, তা সত্যিই অতুলনীয়। তাই ছাঁটাই প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ॥ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত বরাদ্দের বিরোধিতা করে ছাঁটাই প্রস্তাবকারীরা বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সম্পূর্ণ প্রশ্নবিদ্ধ। ইউপি নির্বাচনে যা হয়েছে তা সত্যিই দুঃখজনক। গ্রাম পুলিশরা অভুক্ত থাকছেন। কিন্তু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্বিকার থেকেছে। শতকরা ৩০-৩৫ ভাগ হ্রাসে টেন্ডারে কাজ হচ্ছে। এতে নিম্নমানের কাজ হচ্ছে। উপজেলায় যেসব থোক বরাদ্দ দেয়া হয়, এই বরাদ্দ পেতে নাকি ১০-১৫ ভাগ অর্থ ঘুষ দিতে হয়। জবাবে এলজিআরডিমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সময়মতো বরাদ্দ না দিলে খরচে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়, এদিক লক্ষ্য রেখে এবার সময়মতোই সব বরাদ্দ দিয়েছি। বিগত সময়ের তুলনায় ৩/৪ ভাগ বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। শতকরা ৫ ভাগের নিচে কোন টেন্ডার হলে তা কোনমতেই গ্রহণযোগ্য হবে না। এ ব্যাপারে আইন করা হচ্ছে। আইনটি চালু হলেই কেউ-ই তা আর করতে পারবে না। প্রত্যেকটি টেন্ডার সুচারুভাবে মূল্যায়ন করা হয়। আর স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে সরকার ব্যাপক উন্নয়নমূলক কর্মকা- হাতে নিয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দেরও বিরোধিতা ॥ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দের বিরোধিতা করে ছাঁটাই প্রস্তাবকারী সংসদ সদস্যরা বলেন, শিক্ষার্থীরা আজ আতঙ্কিত, ভুল প্রশ্ন, ভুলে ভরা বইয়ের কারণে। আবার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগও আছে। এমপিওভুক্তির অভাবে শিক্ষকরা মানবেতন জীবন-যাপন করছেন। আড়াই বছরে কয়টা স্কুল-কলেজকে এমপিওভুক্তি করেছে? একটাও করা হয়নি। মনে হয় সরকার শিক্ষাকে সম্প্রসারণ করতে চায় না। জবাবে শিক্ষামন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে প্রস্তাব উত্থাপনকারী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, এমপিওভুক্তির ব্যাপারে অনেকেই সোচ্চার, কিন্তু ভূঁইফোড় কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে তাদের ব্যাপারে কোন কথা বলেন না। ২৮ হাজারের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য যে আবেদন দেয়া হয়েছে তার এক-তৃতীয়াংশেই খামোখা। ৩-৪ জন শিক্ষক আর একজন ছাত্র নিয়েও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ ব্যাপারে সংসদ সদস্যরা সোচ্চার হন না কেন? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত বরাদ্দের বিরোধিতা ॥ এ খাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকার সম্পূরক বরাদ্দের দাবি জানালে তার বিরোধিতা করে ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপনকারীরা বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। প্রতিনিয়ত মানুষ খুন হচ্ছে, এমনকি পুলিশ কর্মকর্তার পরিবাররাও রেহাই পাচ্ছে না। এভাবে চললে জনগণ হতাশ হয়ে যাচ্ছে। কঠোরহস্তে এসব সন্ত্রাসীদের দমন হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়ন করতে সরকারকে আরও সতর্ক থাকতে হবে। জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা কোন অতিরিক্ত ব্যয় করছি না, শুধু যা প্রয়োজন তাই করছি। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ বাহিনীতে ৫০ হাজার লোকবল নিয়োগ ছাড়াও তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, বাসস্থান, যানবাহনসহ আধুনিকভাবে গড়ে তুলতে সব কিছুই করা হচ্ছে।
×