ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপির আদলে লোগো পরিবর্তন করল জামায়াত

প্রকাশিত: ০৬:১১, ৮ জুন ২০১৬

বিএনপির আদলে লোগো পরিবর্তন করল জামায়াত

বিভাষ বাড়ৈ ॥ হঠাৎ করেই নিজেদের প্রতিষ্ঠাকালীন লোগো পরিবর্তন করে ফেলেছে দলগতভাবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। নিজেদের প্রতিষ্ঠাকালীন ‘আক্বিমুদ্দিন’ (দীন প্রতিষ্ঠা কর) লেখা লোগো পাল্টে বিএনপির আদলে জামায়াত তার লোগোতে লাল সবুজের রঙের ব্যবহার শুরু করেছে। হুবহু বিএনপির লোগোর মতো ওপর লাল ও নিচে সবুজ রঙের মাঝে দলের নাম লিখে মঙ্গলবার নতুন লোগো নিয়ে আলোচনায় এসেছে স্বাধীনতাবিরোধী দলটি। এদিকে এ কর্মকা-ের মাধ্যমে একদিকে উগ্রবাদী দলটি পাকিস্তান জামায়াতের চেহারা লুকিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপকৌশল নিয়েছে, বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ঘটনাকে ভ-ামি অভিহিত করে তারা বলছেন, জামায়াত বাহ্যিক চেহারা পাল্টে সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চাচ্ছে তারা বাংলাদেশকে ভালবাসে! যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও নিবন্ধন বাতিলের সঙ্গে সঙ্গেই দলটি নিয়ে নানা আলোচনা সামনে চলে এসেছিল। আলোচনার আরেকটি বিষয় হলো দল নিষিদ্ধ হলে নতুন নামে নতুন চেহারা নিয়ে রাজনীতি করার চেষ্টা করবে জামায়াত। এসব ইস্যুতে দলের ভেতর দুটি পক্ষও সক্রিয় অনেকদিন ধরে। অনেকেই চাচ্ছেন মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে যুদ্ধাপরাধীদের বাদ দিয়ে নতুন করে দল গঠন করতে। অনেক দিন ধরে এ নিয়ে দুুটি পক্ষ সক্রিয় থাকলেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোন পরিবর্তন আসেনি। তবে দলটি যে পাকিস্তান জামায়াতের একটি শাখা তার প্রমাণ দিচ্ছিল তাদের দলের লোগোই। কারণ পাকিস্তান জামায়াত ও বাংলাদেশের জামায়াতের লোগো ছিল একই রকমের। এ নিয়ে অনেক বিতর্ক সমালোচনার প্রেক্ষাপটে এক পর্যায়ে বছর দুয়েক আগে ‘জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশ’ নাম পাল্টে লেখা হয় ‘বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী’। নাম পরিবর্তন হলেও লোগো ছিল একই। এর মাঝে নিবন্ধনও বাতিল হয়ে যায়। ফলে এই মুহূর্তে দলের ব্যানারে রাজনীতি করার কোন সুযোগ নেই দলটির। একই সঙ্গে চলছে নিষিদ্ধ করার প্রস্তুতি। এ অবস্থার মাঝেই সম্প্রতি রাজধানীতে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা অবিলম্বে দেশের স্বার্থে জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি তোলেন। ওই বৈঠকেই বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই জামায়াত পাকিস্তান জামায়াতের শাখা। এখানে পাকিস্তানের জন্য কাজ করছে দলটি। এরা নতুন দল করে হোক বা অন্য কোন নামে হোক কোনভাবে তৎপরতা চলতে দেয়া যাবে না। সরকারকে এদের কর্মকা-ের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেয়ারও পরামর্শ আসে বিশেষজ্ঞদের ওই বৈঠকে। জানা গেছে, মঙ্গলবার দুপুরে দলের কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতির মধ্য দিয়ে হঠাৎই জামায়াতের লোগো পরিবর্তনের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। লোগো পরিবর্তন নিয়ে কোন কথা বলেনি দলটি। কেবল বিবৃতির প্যাডে নতুন লোগো ব্যবহার করা হয়। এ বিষয়ে জানতে চেয়ে প্রচার বিভাগের দায়িত্বশীল কাউকেই পাওয়া যায়নি। মেইলে যোগাযোগ করা হলেও সারা দেয়নি কেউ। তবে কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য মাওলানা হাবিবুর রহমান বলেন, দলের নিবন্ধন তো নির্বাচন কমিশনে স্থগিত রয়েছে। ফলে আগের লোগো আমরা ব্যবহার করতে পারছি না। এ কারণে নতুন লোগো। কিন্তু এই লোগো পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত কবে নেওয়া হয়েছে, এ নিয়ে কোন উত্তর দেননি এই নেতা। বলেন, এটা নীতিনির্ধারকরা জানেন। জামায়াতের এই লোগো পরিবর্তনে নতুন নামে আত্মপ্রকাশের বিষয়টি আলোচনায় আসবে বলে মনে করেন জামায়াতের ঢাকা মহানগরীর অনেক কর্মী। তাদেরই ভাষ্য, হঠাৎ করেই এই লোগো পরিবর্তন। দলটির কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা যাইনুল আবেদিন বলেন, আমি এসব বিষয়ে জানি না। দল নতুন নাম নিয়ে আসবে কি না তাও জানি না। মঙ্গলবার দুপুরে গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে লোগো পরিবর্তন নিয়ে কোন কথা ছিল না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বক্তব্যের বরাত দিয়ে গত ৬ জুন বিবিসিতে প্রচারিত ‘সম্প্রতি সংঘটিত হত্যাকা-ের জন্য জামায়াত-শিবির দায়ী’ এমন প্রতিবেদনের প্রতিবাদ জানানো হয় বিবৃতিতে। বিবৃতিতে জামায়াতের নির্বাহী পরিষদ সদস্য হামিদুর রহমান আযাদ দাবি করেন, যারা ছাত্রশিবির ছিল তারাই হুজি, তারাই জেএমবি ও তারাই আনসারুল্লাহ বাংলাটিম হওয়ার প্রশ্নই আসে না। কোন হত্যাকা-ের সঙ্গেই জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের সম্পর্ক নেই। বিবৃতিতে দেখা গেছে, জামায়াতের আগের লোগোয় আরবীতে ‘আক্বিমুদ্দীন’ লেখা ছিল। গম্বুজের ভেতরে আল্লাহু শব্দের মধ্যে ‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীক ছিল। এই দাঁড়িপাল্লাই দলটির নির্বাচনী প্রতীক। আগের প্যাডে কালো রঙে দলের নাম থাকলেও নতুন প্যাডে লাল অক্ষরে নাম ব্যাকগ্রাউন্ড করা হয়েছে। পাশাপাশি প্যাডের ওপর সবুজ রঙে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী লেখা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে জামায়াতের কয়েক নেতার মোবাইলে কল করা হলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি। এরপর জামায়াত ঘরানার বাংলাদেশ মসজিদ মিশনের সেক্রেটারি ড. মাওলানা খলিলুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা জামায়াতের বিষয়। আমি বলতে পারব না। জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিব মোঃ সিরাজুল ইসলাম বলেন, তাদের লোগো পরিবর্তন করার বিষয়ে আমাদের করণীয় নেই। হাইকোর্টের নির্দেশে তাদের রেজিস্ট্রেশন স্থগিত রয়েছে। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন বাদে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। তো তারা আবার রেজিস্ট্রেশন করার আবেদন করলে এই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হবে। আদারওয়াইজ আমাদের কিছু করার নেই। এদিকে এ কর্মকা-ের মাধ্যমে একদিকে উগ্রবাদী এ দলটি পাকিস্তান জামায়াতের চেহারা লুকিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপকৌশল নিয়েছে, বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ঘটনাকে ভ-ামিও অভিহিত করেছেন তারা। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলছিলেন, এটা একটা ভ-ামি। মানুষের সঙ্গে প্রতারণা। জামায়াত বাহ্যিক চেহারা পাল্টে সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চাচ্ছে তারা এখন আগের মতো নেই। বাংলাদেশের জামায়াত আসলে পাকিস্তান জামায়াতের একটা শাখা। তাদের লোগো ও পাকিস্তান জামায়াতের লোগোও এক। এখন সেই লোগো পাল্টে চেহারা লুকানোর বৃথা চেষ্টা করছে দলগতভাবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দলটি। অন্যদিকে জামায়াতের বিভিন্ন সূত্রে কথা বলে জানা গেছে, নিষিদ্ধ হলে প্রয়োজনে নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করবে জামায়াত। নতুন এই দলের সম্ভাব্য নাম ঠিক করা হয়েছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি)। নতুন দল হলেও গোপনে জামায়াতেরই সাংগঠনিক কাঠামো থাকবে। নতুন দলে জামায়াতের ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী নেতাদের ঠাঁই হবে না। জামায়াতের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, শীঘ্রই তাদের দল নিষিদ্ধ হতে পারে ধরে নিয়ে সম্প্রতি দলের নীতিনির্ধারকরা নতুন দল গঠন করার সিদ্ধান্ত অনেকটাই চূড়ান্ত করেছেন। ইতোমধ্যে বিডিপি নামে নতুন দল গঠনের কথা মাঠপর্যায়ের বিভিন্ন সাংগঠনিক ইউনিটের সভায় বলা শুরু করেছেন দায়িত্বশীল নেতারা। নতুন দল গঠনের পাশাপাশি দলটি পরিচালনার জন্য শীর্ষস্থানীয় সম্ভাব্য দুজন নেতার নামও মোটামুটি ঠিক করা হয়েছে। নতুন দল বিডিপির সভাপতি হতে পারেন জামায়াতের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান। তিনি পেশায় একজন চিকিৎসক। তাঁর বয়স ষাটের কাছাকাছি। আর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও দলের সাবেক সাংসদ হামিদুর রহমান আযাদকে ভাবা হচ্ছে। এ ছাড়া অন্যান্য পদের নেতাদের দায়িত্ব বণ্টনের কাজ চলছে বলে জানা গেছে। সূত্রগুলো বলছে, দলের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদকে মূল দলে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। শফিকুর রহমান বিডিপির সভাপতি হলে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল হতে পারেন দলের ঢাকা মহানগর কমিটির আমির রফিকুল ইসলাম খান। তিনি শফিকুর রহমানের প্রায় সমবয়সী। এরপরও তাকে কেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল পদে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তা পরিষ্কার নয়। এ নিয়ে দলে বিভিন্ন ধরনের কথা আছে। যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে আদালত যদি জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে, সে আশঙ্কা থেকে নতুন দল করছেন নীতিনির্ধারকরা। কিন্তু মূল দল জামায়াত বিলুপ্ত করা হচ্ছে না। ফলে নতুন দলে জামায়াতেরই কর্তৃত্ব ও প্রভাব থাকবে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির এসব বিষয়ে বলছিলেন, জামায়াত যে নতুন নাম নিয়ে রাজনীতি করতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। মিসরেও এভাবেই তারা ক্ষমতায় গিয়েছিল। তিনি বলেন, সরকারের কাছে তাদের দাবি বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া। যেখানে ধর্মের নামে রাজনীতি করা যাবে না। তিনি আরও বলেন, জামায়াত নতুন নামে এলেও দেখতে হবে, তাদের রাজনৈতিক দর্শন কী হয়। ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনবার নিষিদ্ধ হয় জামায়াত। এর মধ্যে ১৯৫৯ ও ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রতিষ্ঠার পর অন্য সব ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে জামায়াতও নিষিদ্ধ হয়। সাত বছর পর জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৯ সালের ২৫ মে আবার প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ পায় জামায়াত।
×