ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বন্ধ হচ্ছে না টার্গেট কিলিং

মূল অপরাধীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ৮ জুন ২০১৬

মূল অপরাধীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে

শংকর কুমার দে ॥ সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কোনভাবেই বন্ধ করতে পারছে না দেশের আতঙ্ক সৃষ্টিকারী টার্গেট কিলিং। দেশের বিভিন্ন স্থানে গত দেড় বছরে ৪৮টি জঙ্গী হামলায় টার্গেট কিলিং হয়েছেন অন্তত ৫১ জন। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি জঙ্গী হামলার ঘটনার অর্থাৎ ২৬টি ঘটনায় অর্ধেক টার্গেট কিলিংয়ের ২৮ জনের রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি তদন্তকারী পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা। একই কায়দায় মোটরসাইকেলযোগে এসে চাপাতি বা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে, গলা কেটে হত্যার পর গুলি করে হত্যাকা- নিশ্চিত করে নির্বিঘেœ পালিয়ে যাওয়ার পরও প্রকৃত খুনীরা চিহ্নিত হচ্ছে না- এমন টার্গেট কিলিংয়ের সংখ্যা বেড়েই চলছে। একের পর এক টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনার পর তদন্তকারী সংস্থা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে রহস্য উদ্ঘাটনের কথা বলে সন্দেহভাজনদের আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু টার্গেট কিলিং বন্ধ করা যাচ্ছে না। কেন টার্গেট কিলিং বন্ধ হচ্ছে না- সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এর কারণ খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দারাও। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। মঙ্গলবার ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নলডাঙা ইউনিয়নের মহিষারভাগাড় এলাকায় সনাতন ধর্মাবলম্বী ৭০ বছরের বৃদ্ধ এক পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলীকে গলা কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। সকাল নয়টার পর এলাকার একটি মাঠ দিয়ে বাইসাইকেলে করে যাওয়ার সময় তাঁকে হত্যা করা হয়। পুলিশ বলছে, গোপন সূত্রে তারা খবর পেয়েছেন, ঘটনাস্থল থেকে তিনজনকে মোটরসাইকেলে চলে যেতে দেখা গেছে। যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহে গত সোমবার চব্বিশ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে চারজনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এর আগের সোমবার যশোরে ফিলিং স্টেশনের ব্যবস্থাপক ওবায়দুর রহমান (৩২) ও যশোর এমএম কলেজের ছাত্র লিজন আহমেদ অপুকে (২৩) গলা কেটে হত্যা করার পর তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। এছাড়াও চুয়াডাঙ্গায় খুন হওয়া ক্লিনিক মালিক হলেন আলমডাঙ্গা উপজেলার তিওরবিলা গ্রামের নজরুল ইসলাম ওরফে নজু (৪০)। এর আগে টার্গেট কিলিংয়ের শিকারে পরিণত হয়েছে চট্টগ্রামে পুলিশের এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু ও নাটোরে খ্রীস্টান ব্যবসায়ী সুনীল গোমেজ। মাত্র চার দিনের ব্যবধানে এসব টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনায় উদ্বেগ ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তারা পর্যন্ত খুনীদের চিহ্নিত করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিরতি দিয়ে একের পর এক জঙ্গী হামলার ঘটনায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত সাধারণ মুদি দোকানি থেকে শুরু করে শিক্ষক, লেখক, প্রকাশক, ব্লগার, পুলিশ সদস্য, শিয়া অনুসারী, সমকামীদের অধিকারকর্মী, পীর ও ধর্মান্তরিত ব্যক্তিরা কেউই টার্গেট কিলিং থেকে বাদ যাচ্ছে না। জঙ্গী তৎপরতায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব না হওয়ায় একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গীদের আর্থিক নেটওয়ার্কের শিকড়ও পুরোপুরি চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারছে না। রবিবার পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুর হত্যার ঘটনার পর জড়িতদের গ্রেফতারের বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। রবিবার রাত থেকেই অঘোষিতভাবে রাজধানীসহ সারাদেশে জঙ্গীবিরোধী অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। জঙ্গীবিরোধী অভিযানে মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকায় দুই জঙ্গীর সঙ্গে পুলিশের বন্দুকযুদ্ধে দুই জঙ্গী ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, টার্গেট কিলিংয়ের ভয়াবহতায় চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী খুন হওয়ার ঘটনা সামনে রেখে সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে সোমবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপর্যায়ে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারক মহলেও। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জঙ্গীবিরোধী অভিযানে জিরো টলারেন্স দেখানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী খুনের ঘটনাটি তদন্তে পুলিশের সব ইউনিটের জন্য ‘ওপেন’ রাখা হয়। জঙ্গীবিরোধী কার্যক্রমে সারাদেশের সব থানার ওসিদের আরও সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়ার ব্যাপারে জোর তাগিদ দেয়া হয়। যেসব উগ্রপন্থী এরই মধ্যে জামিন পেয়েছেন, তাদের ব্যাপারে খোঁজ নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। জামায়াত-শিবিরকর্মীদের তৎপরতার ব্যাপারে প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব স্থাপনা ও বসবাসের জায়গায় নিরাপত্তা জোরদার করার কথাও বলা হয়েছে বলে জানা গেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পুলিশের রেকর্ড থেকে জানা গেছে, গত দেড় বছরে উগ্রপন্থীরা যেসব হত্যাকা-ে অংশ নেয় তার অধিকাংশ ঘটনার রহস্যের কোন কিনারা হয়নি। গত ৭ এপ্রিল সূত্রাপুরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদকে হত্যা করা হয়। দুই মাস পরও এ ঘটনায় জড়িত একজনকেও গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত ২৫ এপ্রিল কলাবাগানে ইউএসএআইডি কর্মকর্তা জুলহাস মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সিসিটিভির ফুটেজে পাঁচজনকে পালিয়ে যেতে দেখা গেছে। এ ঘটনায় শরিফুল ইসলাম শিহাব নামে পুলিশ সন্দেহভাজন একজনকে গ্রেফতার করলেও মূল আসামিরা এখনও ধরা পড়েনি। গত ৩০ এপ্রিল টাঙ্গাইলে হিন্দু দর্জি নিখিল চন্দ্র জোয়ার্দারকে হত্যা করা হয়। পুলিশ বলছে, ওই ঘটনায় জেএমবির সম্পৃক্ততা রয়েছে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ব্লগার অভিজিত রায় হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু মূল আসামিরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। এছাড়া গত বছরের ২ নবেম্বর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যার ঘটনায় একজনকেও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ টুটুলের ওপর হামলাকারীরা এখনও আইনের আওতায় আসেনি। ডিবি সূত্র জানায়, পুরস্কার ঘোষিত জঙ্গীদের মধ্যে শরিফুল এবিটি সংগঠনের সদস্যদের সামরিক ও আইটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিত। টিএসসিতে অভিজিত রায়, গোড়ানে নীলাদ্রি চ্যাটার্জী নিলয়, লালমাটিয়ায় আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ তিনজনকে হত্যাচেষ্টা ও সাভারে শান্ত-মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রিয়াদ মোর্শেদ বাবু হত্যা মামলার তদন্তে তার সরাসরি উপস্থিতি এবং নেতৃত্ব দেয়ার সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে। তাছাড়া ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা, তেজগাঁওয়ে ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নাজিমুদ্দিন সামাদ এবং কলাবাগানে জুলহাস মান্নান ও মাহবুব তনয় হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী শরিফুল। এখন প্রশ্ন হলোÑ শরিফুল কিভাবে নির্বিঘেœ এতগুলো হত্যাকা-ে অংশ নিয়ে এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে? এ ধরনের প্রশ্নের উল্টর মেলানো যাচ্ছে না বলেই একের পর এক টার্গেট কিলিং অব্যাহত আছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সম্প্রতি সন্দেহভাজন ছয় উগ্রপন্থীর ছবি ও নাম প্রকাশ করে তাদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করে। তারা হলো- এবিটির শীর্ষপর্যায়ের সংগঠক শরিফুল ওরফে সাকিব ওরফে শরিফ ওরফে সালেহ ওরফে আরিফ ওরফে হাদী-১ ও সেলিম ওরফে ইকবাল ওরফে মামুন ওরফে হাদী-২, সদস্য সিফাত ওরফে সামির ওরফে ইমরান, আবদুস সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু ওরফে সালমান ওরফে সাদ, শিহাব ওরফে সুমন ওরফে সাইফুল ও সাজ্জাদ ওরফে সজীব ওরফে সিয়াম ওরফে শামস। এখন পর্যন্ত তারাও ধরা পড়েনি। এমনকি কোন সাধারণ নাগরিক উগ্রপন্থীদের ব্যাপারে পুলিশকে তথ্য দিয়েছে বলে জানা যায়নি। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, টার্গেট কিলিং মোকাবেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্বলতা রয়েছে। এমনকি সব সংস্থার মধ্যে সমন্বয়েরও ঘাটতি রয়েছে। পুলিশের মধ্যে যারা জঙ্গী তৎপরতাসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছেন, তাদের নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। এসব পুলিশ কর্মকর্তার স্বজনদের নিরাপত্তার বিষয়টি নতুনভাবে চিন্তা করা জরুরী। কারণ টার্গেট কিলিং পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী হত্যার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও যে টার্গেটে পরিণত হয়েছে তাতে জঙ্গী তৎপরতায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এছাড়াও নিরীহ সহজ-সরল গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী ভিন্নধর্মাবলম্বী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের টার্গেট কিলিংয়ের নিশানায় পরিণত করার বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক।
×