ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

গাড়ি ও চালকের লাইসেন্স নেই ;###;ট্রাফিক আইন জানে না, রাস্তাও চেনে না

পুরো রাজধানী যেন রিক্সার দখলে ॥ ঈদে বাড়তি আয়ের আশায় রিক্সার স্রোত

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৮ জুন ২০১৬

পুরো রাজধানী যেন রিক্সার দখলে ॥ ঈদে বাড়তি আয়ের আশায় রিক্সার স্রোত

রাজন ভট্টাচার্য ॥ দলে দলে রিক্সা চালকরা ঢুকছেন রাজধানীতে। ঈদ সামনে রেখে বাড়তি আয়ের আশায় নিম্ন আয়ের মানুষের এই স্রোত। রাজপথ থেকে অলি-গলি পর্যন্ত তিন চাকার এই বাহনে এখন ঠাসা। কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীর আশপাশসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা চালকদের কেউই ট্রাফিক আইন জানেন না। নেই ড্রাইভিং ও রিক্সার লাইসেন্স। রাস্তা চেনেন না এমন চালকের সংখ্যাও অনেক। ফলে যানজটও বেড়েছে। বেড়েছে নাগরিক দুর্ভোগ। পরিস্থিতি এমন যে, জরুরী হর্ন বাজিয়ে এ্যাম্বুলেন্স যেতে চাইলেও মাঝরাস্তা দিয়ে রিক্সা চলে। চালকের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। এমন বাস্তবতায় সামনের দিকে আরও বাড়বে রিক্সার চাপ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীতে তালিকাভুক্ত রিক্সার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৭৯ হাজার। অবৈধ রিক্সার সংখ্যা প্রায় ১০ লাখের কাছাকাছি। বিপুল সংখ্যক অনুমোদনহীন রিক্সা চলছে বছরের পর বছর। অথচ এ নিয়ে কারও কোন মাথা ব্যথা নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অনেক সময় মানবিক কারণে রিক্সা চালকদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যেতে চায় না। এদিকে ঈদ সামনে রেখে রিক্সা ভাড়া বেড়েছে কয়েকগুন। ২০ টাকার ভাড়া হয়েছে ৬০ টাকা পর্যন্ত। এ নিয়ে সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে ক্ষোভের শেষ নেই। পরিবহন সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দিনে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ স্থায়ী বসবাসের জন্য রাজধানীতে আসে। এর মধ্যে উদ্বাস্তুর সংখ্যা বেশি। এর একটা বড় অংশ একেবারেই সহায় সম্বলহীন। তাদের জন্য সবচেয়ে সহজ উপার্জনের পথ হলো রিক্সা চালানো। অল্প টাকাতেই ভাড়া নিয়ে চালানো যায়। এমন বাস্তবতায় সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ হলো, নির্দিষ্ট সংখ্যক রিক্সার নিবন্ধন দেয়া এবং চালকদের লাইসেন্স নিশ্চিত করা। তাহলে সিটি কর্পোরেশনের আয় বাড়বে। অন্যদিকে চালকদের বাড়বে দায়িত্বশীলতা। কমবে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও যানজট। ট্রাফিক আইন সম্পর্কে বাড়বে সচেতনতা। জানতে চাইলে তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ কমিশনার রাজীব দাস জনকণ্ঠকে বলেন, রমজান উপলক্ষে মৌসুমী পরিবহন চালকসহ ব্যবসায়ীদের বিষয়টি মাথায় রেখেই ঈদ ব্যবস্থাপনার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। তিনি জানান, প্রতি বছরের মতো এ বছরও রিক্সার সংখ্যা বাড়বে এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এ বছর আমরা এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছি। এ বিষয়ে বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। যেন কোন অবস্থাতেই মৌসুমী রিক্সা চালকরা রাজধানীতে প্রবেশ করতে না পারেন। তিনি বলেন, বাড়তি গাড়ির চাপে যানজট বাড়ে। অনেক সময় ভিআইপি ও ভিভিআইপি সড়কেও চলে রিক্সা। এ নিয়ে বিড়ম্বনার শেষ থাকে না। তাছাড়া অদক্ষ চালকরা ট্রাফিক আইন কানুন কিছুই জানেন না। এতে আরও সমস্যা বাড়ে। তাই আমরা চেষ্টা করছি অন্যবারের তুলনায় মৌসুমী গাড়ির চাপ কমানোর জন্য। আশা করি এ বছর আমরা ইতিবাচক ফল পাব। ঢাকামুখী মানুষের ভিড় ॥ গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, নরসিংদী, ময়মনসিংহ, জামালপুর, মানিকগঞ্জসহ রাজধানীর আশপাশের জেলা থেকে সবচেয়ে বেশি রিক্সাচালক এখন ঢাকায়। সবাই মৌসুমী চালক। রমজানের প্রথম দিনে দিনভর ঢাকার রাস্তায় যানবাহনের ব্যাপক ভিড় লক্ষ করা গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রিক্সার দৌরাত্ম্য। মতিঝিল, কমলাপুর, রাজারবাগ, মালিবাগ, খিলগাঁও, তালতলা, বাসাবো, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, শান্তিনগর, মৌচাক, রামপুরা, বাড্ডা, নতুনবাজার, গুলশান, মীরপুর, ধানম-ি, জিগাতলা, মোহাম্মদপুর, সাইন্সল্যাব, নিউ মার্কেট, হাতিরপুল, টিএসসি, চাঁদনি চক, নীলক্ষেত, পুরনো ঢাকা, টিকাটুলি, লক্ষ্মীবাজার, মহাখালিসহ বিভিন্ন সড়কে রিক্সা আর রিক্সা। যেন রিক্সার দখলে গোটা রাজধানী। নরসিংদী থেকে আসা রিক্সাচালক হুমায়ূন জানান, গত এক সপ্তাহ আগে তিনি ঢাকায় এসেছেন। উঠেছেন মগবাজার এলাকায়। যে গ্যারেজ থেকে রিক্সাচালন থাকেন সেখানেই। প্রতিদিন ১০০ টাকায় রিক্সা ভাড়া নেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চালান। এই প্রথমবার ঢাকা এলেন। চেনা জানা নেই। তাতে কি। সহজ পথ। মগবাজার মোড় থেকে ভেতরের গলি পর্যন্ত দিনভর ভাড়া তোলেন। এতেই দিনে আয় হাজার টাকার বেশি। তিনি জানান, গ্যারেজ জুড়ে এখন মৌসুমী চালকদের ছড়াছড়ি। অভাব রিক্সার। এ কারণে অনেকেই গাড়ি পাচ্ছেন না। রাতদিন মিলিয়ে গাড়ি দেয়া হচ্ছে চালকদের। চারখারপুল এলাকায় রিক্সা চালান ফিরোজ। তিনি জানালেন, গত ১৫ দিন হলো পটুয়াখালী থেকে ঢাকা এসেছেন বাড়তি আয়ের আশায়। কিন্তু রাস্তা চেনা নেই। তাই আয় কম হচ্ছে। একই কথা বললেন, মাদারটেক এলাকার রিক্সাচালক মিজান। ২০ দিন আগেই ঢাকা এসেছেন তিনি। জানালেন, ছয় জনের সংসার। এনজিও থেকে লোন নেয়ার পর ব্যবসায় লোকসান হয়েছে। দেনা ছাড়িয়েছে এক লাখ টাকার বেশি। তাই ঈদ পর্যন্ত এক লাখ টাকা আয়ের লক্ষ্য নিয়ে বড় ছেলেসহ রিক্সা চালাচ্ছেন। সকাল থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ করেন। মাঝখানে দুই ঘণ্টার বিরতি মাত্র। জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক জনকণ্ঠকে বলেন, রাজধানীতে যানজটের অন্যতম কারণ প্রায় ১০ লাখ রিক্সা এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু গণপরিবহন কম হওয়ার কারণে রিক্সার বিকল্পও নেই। তাই চালকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স নিশ্চিত করার পাশাপাশি অযান্ত্রিক পরিবহন রিক্সার আরও কিছু লাইসেন্স দেয়ার দাবি জানান তিনি। ট্রাফিক পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, নিয়ন্ত্রণহীন রাজধানীর রিক্সা। লাইসেন্স না থাকা, ইচ্ছামতো চলাচলসহ পার্কিং, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় কোন কিছুতেই জবাবদিহিতা নেই। এক কথায় বলতে গেলে বেপরোয়া এই পরিবহনের চালকরা। রাজধানীতে তালিকাভুক্ত রিক্সার সংখ্যা সাড়ে ৭৯ হাজার। এর মধ্যে ২৮ হাজার ৮৩০টি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অধীনে। বাকি রিক্সাগুলো দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সিটি কর্পোরেশনসহ বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় বলা হচ্ছে বছরে রাজধানীতে ৩০ হাজারের বেশি নতুন রিক্সা যোগ হচ্ছে। অথচ বিগত প্রায় ৩০ বছরের বেশি সময় রিক্সার লাইসেন্স বন্ধ রেখেছে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, লাইসেন্স প্রাপ্ত একই নম্বর প্লেট ব্যবহার করে অবৈধভাবে চলছে প্রায় ৫০টি রিক্সা। ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে অনেকে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। রাজধানীতে বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় দুই কোটি। এর মধ্যে প্রায় ৫০ লাখের বেশি মানুষ রিক্সার ওপর নির্ভর করে চলছে। মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগের কম মানুষ চলেন নিজস্ব পরিবহনে। বাস ও মিনিবাসে ২৫ ভাগ। সিএনজি ও ট্যাক্সিক্যাবে ৫ ভাগ। নিম্ন, মধ্যবিত্তসহ সব পর্যায়ের ৬০ ভাগ মানুষ নিয়মিত রিক্সায় যাতায়াত করে। বাংলাদেশ রিক্সা ভ্যান মালিক শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ নেতারা বলছেন, ১৯৮৬ সালের পর নতুন কোন রিক্সার লাইসেন্স দেয়নি ডিসিসি। ১০ বছর আগে রাজধানীতে ৪৩ হাজার রিক্সা ও ভ্যানের লাইসেন্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও আজও তা ঝুলে আছে।
×