ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দাউদ হায়দার

সব ঝামেলার মূলে আলী

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ৮ জুন ২০১৬

সব ঝামেলার মূলে আলী

একজন মার্কিন সাংবাদিকের প্রতিবেদনে পড়েছিলুম (বছর চারেক আগে) বাংলাদেশে দ্রষ্টব্য বিষয় মাত্র তিনটি, বিশেষত রাজধানী ঢাকায়। এক. রাস্তাঘাটে পিলপিল করছে মানুষ। দুই. যানজট। তিন. রিকশা। সাংবাদিকের দেখা এবং লেখা কতটা সত্যি, জানি নে। হতেও পারে। কোন বন্ধুজন বা পরিচিত কেউ এলে, এরকমই শুনি। বিশ্বাসও করতে হয়। দিনকালে সবকিছু বদলায়। কালের যাত্রার ধ্বনি ঠিকমতো শুনতে পাইনে। কি করে শুনব। শেষ গিয়েছিলুম ঢাকায় (১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৮)। লোকে লোকারণ্য নয়। গাড়ির সংখ্যাও কম। রিকশা অবশ্য বেশি। মধ্যবিত্তের একমাত্র যানবাহন। মালিবাগ-মৌচাক মার্কেট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে সাকুল্যে পনেরো মিনিট। ফাঁকা-ফাঁকা রাস্তা। গাছগাছালিও আছে বেশ। ধুলোধোঁয়া অসহনীয় নয়। তরুণী-যুবতী-নারীরা বোরকা হিজাব পরে ইতঃস্তত ঘুরঘুর করে না। অন্তত চোখে পড়ে না খুব। সবই কালের যাত্রার ধ্বনি। তখনও পাসপোর্ট বাজেয়াফত করেননি জিয়াউর রহমান সরকার (বাজেয়াফত ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯)। ঢাকায় তথা বাংলাদেশে যাতায়াতে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। মোল্লা, ফতোয়াবাজরা মুরতাদ, কল্লা চাই বলে, ঝা-া উঁচিয়ে রাস্তাঘাটে আস্ফালন করে না। বলিহারি সাহস তখনো হয়নি। দিব্যি ঘুরছি ঢাকায়, হেঁটে বা রিকশায় আত্মীয়স্বজন, বন্ধুদের বাড়ি যাচ্ছি। আড্ডা দিয়ে রাতে ফিরছি। চিত্ত যেথা ভয়শূন্য। ঢাকায় গিয়েছি ১৮ ফেব্রুয়ারি (১৯৭৮), সকালের ফ্লাইটে, কলকাতা থেকে। উদ্দেশ্য, মোহাম্মদ আলী সপরিবারে ঢাকায় আসছেন, সরকারী অতিথি। সপ্তাহব্যাপী বাংলাদেশ সফর করবেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় রিপোর্ট করতে হবে। আনন্দবাজারের সাংবাদিক হিসেবেই যাওয়া। রিপোর্ট করার মূল দায় শঙ্করলাল ভট্টাচার্যের, বাহুল্য আমি। সূত্রধরও বলতে পারেন। শঙ্করলাল ভট্টাচার্য ঢাকার রাস্তাঘাট চেনেন না। আলীর কী কী কর্মসূচী, দিনব্যাপী, সপ্তাহব্যাপী অজানা। সরকারী দফতর থেকে সফরসূচী সংগ্রহ করলুম সহজেই। জীবনে ছবি তুলিনি কিন্তু আনন্দবাজারের ফটোগ্রাফার হিসেবে গিয়েছি। যে বন্ধুর ক্যামেরা দেয়ার কথা, জানান, সাটার খারাপ হয়ে গেছে। ক্যামেরা ছাড়াই ফটোগ্রাফার, চিত্রসাংবাদিক। যেহেতু ঢাকা শহর, আমার শহর, সংবাদপত্রের রিপোর্টার, ফটোগ্রাফার অনেকেই পরিচিত। বিচিত্রা, গণকণ্ঠে সাংবাদিক ছিলুম। দৈনিক সংবাদ-এ সাহিত্য সম্পাদক ছিলুম। সংবাদের ফটোগ্রাফারকে ভারতীয় দুই শ’ রুপী দিয়ে বললুম, মোহাম্মদ আলীর দুটি ছবি চাই। দিয়েছেন। আনন্দবাজারে ছাপা হলো একটি। ফটোগ্রাফার হিসেবে আমার নাম। সাংবাদিক এবং ফটোগ্রাফার মহলে কি করে রটিত, বলতে অপারগ। সরকারী দফতরের নিজস্ব প্রেস ফটোগ্রাফার কামরুল হুদা, পরিচিত। ওঁর স্ত্রী বীণা, পাবনার, আরও পরিচিত। কামরুল বললেন, আমি এক্সক্লুসিভ ছবি দিতে পারি। ঠিক হলো, এক্সক্লুসিভ ছবি দিলে, দুটো ছবির জন্যে একশ’ ডলার (টাকা তো আমার নয়, গৌরী সেনের, আনন্দবাজারের)। ১৯ তারিখে (ফেব্রুয়ারি) স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান আয়োজিত রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে আলীকে রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা, ভোজ। ভোজসভায় সরকারী চিত্রসাংবাদিক কামরুল হুদাও। আরও কয়েকজন। কামরুল হুদা দুটি দারুণ এক্সক্লুসিভ ছবি দিয়েছেন। একটি, আলী এবং বেগম খালেদা জিয়া, ক্যামেরার কারসাজিতে দু’জন এতই কাছাকাছি, যেন অধরে-অধরে মিলন। এই ছবি ছাপা হলো আনন্দবাজার পত্রিকা গ্রুপের সানডে সাপ্তাহিকে। ফটোগ্রাফার হিসেবে আমার নাম। ভাবিনি এই ছবির প্রতিক্রিয়া, আখেরে ‘কী দ- লেখা তব ভালে/মরমে মরিবে একা, দিকচক্রবালে।’ দিন তিনেক পরে শঙ্করলাল কলকাতায়। থেকে গেলুম ঢাকায়, দুই সপ্তাহ পরে ফিরবো। প্রকাশকদের দ্বারে হানা দিয়ে, হুমকি দিয়ে পাওনা টাকা আদায় করে স্ফূর্তিতে আছি। বিচিত্রার সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী ১০০০ টাকা অগ্রিম দিয়ে শর্ত, সাপ্তাহিক কলাম লিখতে হবে। ওই টাকায়, সই এবং সইয়ের বাবা-মা, বোনের জন্যে কেনাকাটি, অন্নদাশঙ্কর রায়ের জন্যে সুতির পাঞ্জাবি, লীলা রায়ের জন্যে জামদানি শাড়ি। কিছু বইও। তুলাআপা, ঝর্ণাআপা শার্ট, পাঞ্জাবি উপহার দিয়েছেন, ঝরাভাবী (রশীদ হায়দারের বিলাভেড স্ত্রী) সাত-সকালে উঠে দুই কিলো ইলিশ মাছ ভেজে (ল্যাজ ও মাথা রেখে দিয়ে), তিন কিলো গো মাংস ভুনা করে, প্লাস্টিকের বাক্সে ভরে দিয়ে অর্ডার, একাই খাবে, কাউকে দেবে না (স্মরণ করলে চোখে জল আসে এখন)। স্যুটকেসে ঢুকিয়ে তেজগাঁ বিমানবন্দরে হাজির। সকালের ফ্লাইট। সি-ওফ করতে গেছেন অগ্রজ জিয়া হায়দার। আমি গিয়েছি শুনেই চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছেন। অগ্রজদের সঙ্গেই, একাসনে, মদ-সিগ্রেট খাই। হায়দার ফ্যামিলি তথা জমিদার বাড়ির কালচার বলে কথা। তপন সিংহের বাঞ্ছারামের বাগান ছবিতে যেমন ডায়লগ, বংছের ছঙছ্কৃতি (বংশের সংস্কৃতি ) উদ্ধার করি!! ইমিগ্রেশন পেরিয়ে ওয়েটিং রুমে অপেক্ষমাণ, মনুভাই (গাজী শাহাবুদ্দীন আহমেদ, সচিত্র সন্ধানীর সম্পাদক।)-এর বোনও কলকাতায় যাচ্ছেন, জিজ্ঞেস করেন, কবে এলেন, বাড়িতে আসেননি কেন, ইত্যাদি। প্লেন ছাড়তে মিনিট কুড়ি বাকি। ইতোমধ্যে ব্যাগ ঢুকে গেছে প্লেনে। ইমিগ্রান্টসের এক অফিসার, বয়স তিরিশের বেশি, বললেন, স্যার, আমার সঙ্গে আসুন। পোড়-খাওয়া মানুষ, বুঝলুম বিপদসমূহ। অফিসার তাঁর ঘরে (সম্ভবত) নিয়ে যাওয়ার সময় আরও দু’জনের সঙ্গে কথা বলেন, একটু এড়িয়ে, আড়ালে। ওই ফাঁকে পলাতক। বেবি ট্যাক্সি নিয়ে ছুটছি, দেখি, সংসদ ভবনের আগে, চাইনিজ রেস্তরাঁর সামনে অগ্রজ জিয়া হায়দার, রিক্সা থেকে নামছেন। বেবিট্যাক্সি থেকে নেমে ঘটনা বললুম। শুনে, ওই বেবিট্যাক্সিতেই সোজা সিদ্ধেশ্বরী, আবদুল খালেকের বাড়িতে। আবদুল খালেক প্রাক্তন পুলিশ মহাকর্তা। ওঁর শ্বশুর প্রাক্তন মন্ত্রী (পূর্ব পাকিস্তানের)। আবদুল খালেক পুলিশ-কর্তা হলেও সাহিত্য-সংস্কৃতির দিশারী, ওঁর স্ত্রী সেলিনা লেখিকা, পুলিশ বিভাগের ডিডেকটিভ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত, আমার লেখাও ছেপেছেন, তো, আশ্রয় পেলুম। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই স্নেহ করেন। খালেক বললেন, ঘটনা কী, খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। ফোনে উপরমহলের সঙ্গে কথা বলে জানালেন, “গুরুতর কান্ড করেছ। ইন্ডিয়ার ‘সানডে ম্যাগাজিনে’ জিয়ার বৌর সঙ্গে মোহাম্মদ আলীর যে ছবি প্রকাশিত, তাই নিয়ে সমস্যা, স্বয়ং জিয়াউর রহমান ক্ষেপেছেন। কি করা যায় দেখছি।” খালেকভাই বললেন, ঘরের বাইরে যেও না, আমার এখানেই থাক। দুইদিন পরে চলে যাই, রাতের অন্ধকারে, লালমাটিয়ায়, ভাগিনেয়ী মাহবুবা আখতার (ডাকনাম আরা)-এর বাড়িতে। আরার বাড়ির সামনেই জিয়ার মন্ত্রী এনায়েতউল্লাহ খানের বাড়ি। এক সকালে মিন্টুভাই (এনায়েতউল্লাহ খান)-এর বাড়িতে গিয়ে নাস্তাও খাই। মিন্টুভাই হয়ত জানতেন না ঘটনা। বলেন, হলিডের জন্যে লিখবে। পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে, আসামি পলাতক। আবদুল খালেকই জানান, পুলিশের মহাকর্তা এখন আবুল খয়ের মুসলেহউদ্দীন, কবি-ছড়াকার, ওঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (অধ্যাপক)। বহুমান্য লেখক। জিয়া হায়দারের ঘনিষ্ঠ। জিয়া হায়দার ঘটনা জানিয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে অনুরোধ করেন আবুল খয়ের মুসলেহউদ্দীনকে বিষয়টি ম্যানেজ করতে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী রাজি হন। ফোন করেন আবুল খয়ের মুসলেহ উদ্দীনকে। তিনিও অসহায়। তিনদিন পরে রশীদ হায়দারকে জানান, প্রেসিডেন্ট (জিয়াউর রহমান) দিনকয়েকের জন্যে মধ্যপ্রাচ্য যাচ্ছেন, এর মধ্যেই কিছু করতে হবে। তিনি নির্দেশ দেন মাহবুব মুর্শেদকে। মুর্শেদ ওঁর ঘরে বসিয়ে, চায়ের অর্ডার দিয়ে, সানডের ছবি দেখিয়ে, মৃদুহাস্যে কথা, ধ্যেত, এই একটা ছবি হলো। এই নিয়ে এত সোরগোল, ১৯৭১-এ পাক-আর্মি জানজুয়ার সঙ্গে বেগম খালেদার ছবি হলেও না হয় জিয়ার গোস্বা হতো। আমার অগ্রজদ্বয় অনুজের জন্যে যা করেছেন, নানা বিপদে নিজেদের ছোট করে, ভাবলে, ধরণী দ্বিধা হয় না, বেঁচে আছি, মরমে মরি। বছর বারো আগে, মোহাম্মদ আলীর কন্যা লায়লা বার্লিনে এসেছেন ইউরোপের তরুণীদের বক্সিং প্রতিযোগিতার বিচারক হয়ে। ডয়েচে ভেলের জন্যে ওঁকে ইন্টারভিউয়ের আগে খোশগল্প, বলি, তোমার বাবা আমার সব ঝামেলার মূলে। কেন, কেন? তোমার বাবা ঢাকায় না গেলে কলকাতা থেকে ঢাকায় যেতুম না। গিয়ে কি বিপদ (সংক্ষেপে বলি)। ঝামেলা হতো না। কেন ওই ছবি ছেপেছিলে। সাংবাদিক, চিত্রসাংবাদিক সবসময় এক্সক্লুসিভ স্টোরি করে, দ্যাট ফটো ওয়াজ ইন্টারেস্টিং। সো, য়্যু হ্যাভ টু সাফার। এ্যাম সিওর, হানড্রেট পারসেন্ট সিওর, মাই ফাদার ওয়াজ নট ইন্টারেস্টেড এ্যাবাউট দ্যাট পিঙ্কি। না হোক, আলীর বাংলাদেশ সফরই আমার সব ঝামেলার মূলে। আলী না গেলে আনন্দবাজার পত্রিকার পক্ষ থেকে যেতুম না। ভাবি এখন, গিয়ে ঠিকই করেছিলুম হয়ত, জিয়ার রাগ মুক্তবুদ্ধির যে কেউ অসহ্য, আমার পাসপোর্ট, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বাতিল করবেনই। স্বৈরশাসক যা করে থাকেন, দেশে-দেশে। জিয়াউর রহমান আরও সরস। মোহাম্মদ আলীকে দোষ দেওয়া অন্যায়, তিনি নিমিত্ত। আলির কন্যা লায়লা বললেন, দ্যাটস ডিক্টেটর মাস্ট বী হরিবল। বললুম, এ্যাম সাফারিং। [email protected]
×