ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদের কেনাকাটা

দর্জি দোকান আর ফ্যাশন হাউসগুলোয় আগে ভাগেই ভিড়

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ৭ জুন ২০১৬

দর্জি দোকান আর ফ্যাশন হাউসগুলোয় আগে ভাগেই ভিড়

রহিম শেখ ॥ আমদানির মাল বেশ মজুদ আছে, তারপরও বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। পণ্যমূল্যের উর্ধগতিতে বাজারের চরিত্র এখন অনেকটাই পাল্টে গেছে। রমজান উপলক্ষে বাজারের এ চিত্র নগরবাসীর কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু অন্যবারের তুলনায় অনেকটা আগেভাগেই ঈদের কেনাকাটা শুরু হয়েছে। খুচরা বাজারে বিকিকিনি না জমলেও পাইকারি বাজার বেশ জমজমাট। পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, বিভিন্ন বিদেশী ব্র্যান্ড ও ভারতীয় হিন্দি সিরিয়ালের নামে এবারও জায়গা দখল করে নিয়েছে ঈদের নতুন পোশাক। কদর বাড়ছে দেশী পোশাকেরও। শবেবরাতের পর থেকেই সরব রাজধানীর দর্জির দোকানগুলো। শুধু পোশাক নয়, কিছুটা বাড়তি আয়ের আশায় নিম্ন আয়ের মানুষগুলোও ছুটছেন নগরীতে। মূলত রমজান ও ঈদ-উল-ফিতর সামনে রেখে হকার, ছোট ব্যবসায়ী, কেউ-বা রিক্সা চালক, আবার কেউ ভিক্ষুকের পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। সব শ্রেণী পেশার মানুষের মুনাফা বৃদ্ধির এই চেষ্টাই জানান দিচ্ছে উৎসব আসছে। আর এই উৎসব রঙিন করতে প্রবাসীরাও প্রতিদিনই অর্থ পাঠাচ্ছেন দেশে। উৎসবের বর্ণিল মাত্রা যোগ করতে বাজারে আসছে নতুন টাকা। এখন চলছে টাকা ছাপানোর কাজ। রমজানের মাঝামাঝিতে ব্যাংকগুলোতে নতুন চকচকে নোট সরবরাহ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেট, বিপণিবিতান, ফ্যাশনহাউস ও শপিংমল ঘুরে দেখা যায়, প্রতিবারের ন্যায় এবারও রোজা আসার আগে থেকেই ঈদ কেনাকাটা শুরু হয়ে গেছে। তাই ব্যবসায়ীদের ব্যস্ততাও বেড়েছে। দোকানে দোকানে নতুন পোশাক সাজাতে ব্যস্ত কর্মীরা। বিক্রেতারা জানিয়েছেন, নামকরা ব্র্যান্ড কিংবা ভারতীয় হিন্দি সিরিয়ালের নামে এবারও জায়গা দখল করছে ঈদের নতুন পোশাক। কেউ আত্মীয়-স্বজনদের উপহারের জন্য কেনাকাটা করছেন। কেউবা গ্রামে কিংবা বিদেশে দেশী পোশাক পাঠানোর জন্য আগেভাগে পোশাক কিনছেন। আবার অনেকেই নগরীর বিপণিবিতান বা দোকানগুলোতে ঘুরে বেড়ান- এবার ঈদে নতুন পোশাক বা জামা-কাপড় কী এলো তা দেখতে। বিশেষ করে তরুণী বা ধনিক শ্রেণীর গৃহিণীদের বেলায়ই এ রকম প্রবণতা বেশি দেখা যায় বেশি। কিন্তু এবার অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা আগেভাগেই ঈদ কেনাকাটা সারছেন। আসন্ন ঈদ উপলক্ষে এবারও কদর বাড়ছে দেশী পোশাকের। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার আমদানি করা পোশাক ও জুতার পরিবর্তে দেশী ব্র্যান্ডের চাহিদা বাড়বে। দেশী ফ্যাশন হাউসগুলোতে ঈদের নতুন পোশাক উঠতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে রাজধানীর নিউমার্কেটসহ ঠাসাঠাসি ভিড় চোখে পড়লেই যে কারও বুঝতে বাকি থাকবে না দরজায় কড়া নাড়ছে মাহে রমজান। এক মাস সিয়াম সাধনা শেষে মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-ফিতরের আনন্দে মেতে উঠবেন সবাই। তাইতো রমজান শুরুর আগেই কেনাকাটাসহ যাবতীয় প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছেন অনেকেই। রাজধানীর চাঁদনী চক মার্কেটের নিউইয়র্ক কালেকশনের স্বত্বাধিকারী নওশাদ আহমেদ বলেন, ক্রেতারা বেশ আগে থেকেই কেনাকাটা শুরু করেছেন এটা ঠিক, কিন্তু বেশিরভাগই ঘুরে ঘুরে ঈদ কালেকশন দেখছেন। মূল বাজার শুরু হবে রোজার প্রথম সপ্তাহ থেকে। তবে এখন যেমন শুরু হয়েছে এ ধারা অব্যাহত থাকলে এবার ব্যবসা ভাল হবে আশা করা যায়। রোজার অনেক আগেই রাজধানীর দর্জির দোকানগুলোতে শুরু হয়ে গেছে ঈদের বেচাকেনা। সঠিক মাপে পছন্দের পোশাক বানাতে অনেকেই ভিড় করছেন এসব দোকানে। অন্যদিকে সময়মত কাজ বুঝে দিতে রাতভোর কাজ করছেন কারিগররা। ১৫ রমজানের পর কোন অর্ডার বুকিং নেয়া হবে না বলেও জানান তারা। নিউমার্কেটের ফয়সাল টেক্সটাইলের বিক্রয়কর্মী পাপ্পু আহমেদ বলেন, সকাল থেকে ভালই বিক্রি হয়েছে, মূলত দামি পোশাকই বেশি। কারণ টেইলার্স অর্ডার নেয়া বন্ধ করার আগেই সাবাই ঈদের পোশাক বানিয়ে নিতে চায়। এছাড়াও ম্যাচিং করে গহনা কেনেন মেয়েরা। সে কারণে বেশ আগে থেকেই তারা কেনাকাটা শুরু করেছেন। দুই বান্ধবীকে নিয়ে ইডেন কলেজ শিক্ষার্থী লুৎফর নাহার চাঁদনী চকে এসেছেন ঈদের পোশাক কিনতে। এত আগেই কেন ঈদের বাজারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কয়েকদিন পরেই গ্রামের বাড়ি চলে যাব। কারণ, রমজানে ক্লাস বন্ধ থাকবে, তাই একটু আগেই ঈদের শপিং করতে এসেছি। একই প্রশ্নের জবাবে স্কুলশিক্ষিকা ফেরদৌসি খাতুন বলেন, রমজানের মাঝামাঝিতে মানুষের এত ভিড় হয় যে পা ফেলার জায়গা থাকে না, তাই একটু তাড়াতাড়িই এসেছি। আবার কিছুদিন পর থেকে টেইলার্সে পোশাক তৈরির অর্ডার নেয়া বন্ধ করে দেবে, তাই তাড়াতাড়ি কিনে ওইগুলো বানিয়ে নিতে চাই। ঈদ উপলক্ষে বাড়তি আয়, বাড়তি লাভের আশায় মানুষ এখন রাজধানীতে আসছেন। কাজের সন্ধানে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা স্রোতের মতো ছুটে আসছেন ঢাকায়। এদের বেশিরভাগই খেটেখাওয়া শ্রমিক। রাজধানীতে এরা এক মাসের অতিথি। ঈদের দু’একদিন আগে বা পরে এসব অতিথি আবার পাড়ি দেবেন আপন নিবাসে। ঢাকায় এসে তারা দোকানের কর্মচারী, হকার, রিক্সা চালানো ও কেউ কেউ ভিক্ষুকের পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। ঢাকায় আসছেন ছোটখাটো খুচরা ব্যবসায়ীরাও। নগরীর প্রতিটি পাইকারি মার্কেটে প্রতিদিনই ব্যবসায়ীদের আনাগোনা বাড়ছে। কেরানীগঞ্জ, ইসলামপুরসহ ঢাকার বড় বড় পাইকারি মার্কেট এখন কেনাকাটায় ব্যস্ত সময় পার করছে। এসব কারণে ঢাকায় প্রতিদিন জনসংখ্যার চাপ বাড়ছেই। জনসংখ্যার এই অতিরিক্ত চাপ ঈদের আগের দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। রমজান উপলক্ষে ফুটপাথগুলোতে ভিড় ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। দায় হয়ে পড়ছে ফুটপাথে চলাচলও। ইতোমধ্যে রাজধানীতে হকারদের সংখ্যাও দ্বিগুণ হয়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন হকার ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ ফুটপাথগুলো দখল করে বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজাচ্ছে। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসার কেন্দ্রস্থল গুলিস্তানের হকার্স মার্কেটগুলো এরই মধ্যে জমে উঠেছে। গুলিস্তানের ফুটপাথে ব্যবসা করেন জামালপুর এলাকার ফরিদ মিয়া। বাড়িতে তিন সন্তান নিয়ে ৫ সদস্যের সংসার। কৃষি কাজ করেই পরিবারের যাবতীয় খরচ বহন করেন। কিন্তু বর্ষার এ সময়টিতে গ্রামে তেমন কোন কাজ নেই। অন্যদের মতো ঈদ আয়োজন করতে না পারলেও দুটো ডাল-ভাত জোটাতেই ঢাকায় এসেছেন। মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরের ফুটপাথে রোজার শুরু থেকে পণ্যের পসরা সাজিয়েছেন সিরাজুল ইসলাম। গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব থানায়। বাড়িতে মা-বাবা, তিন বছরের কন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে সিরাজুলের সংসার। এলাকায় কাজের সংস্থান না থাকায় ঢাকায় এসেছেন। উঠেছেন ছোট বোনের বাসায়। বাচ্চাদের জামা-কাপড় নিয়ে ছোট্ট ভাসমান দোকানের পসরা সাজিয়েছেন। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, আইছি দুই এক মাসের জন্য। বেচাবিক্রি শেষ কইরা ঈদের দিন আবার বাড়ি যামু। পরিবারের সঙ্গে ঈদ করমু। ঈদ করতে অইলে মাইয়াডার জন্য জামা-কাপড় কেনা লাগবে। বুড়ো মা-বাবার জন্য কাপড় কেনা লাগবে। এ জন্য ঢাকায় আসছি। কিছুটা বাড়তি আয়ের আশায় গাইবান্ধা থেকে ঢাকায় এসেছেন ইয়াছিন মিয়া। বললেন, এলাকায় এখন তার কোন কাজ নেই। একমাস পর ঈদ। স্ত্রী, সন্তানদের জন্য ঈদে কিনতে হবে নতুন পোশাক। ঈদের বাড়তি আয় দিয়ে চলতে হবে আরও ক’মাস। আমদানি সত্ত্বেও বাড়ছে পণ্যের দাম ॥ এদিকে রোজার মাসে দ্রব্যমূল্য সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে সরকারী পর্যায়ের পাশাপাশি বেসরকারী পর্যায়েও নিত্যপণ্যের মজুদ বৃদ্ধিতে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। রোজার আগেই বেড়ে গেছে শাক-সবজি, পেঁয়াজ, মাছ ও মাংসের দাম। রমজান আসতে না আসতেই সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ছোলা ও চিনির দাম। এই রমজানে এই পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে বাজারে। সোমবার রাজধানীর সবচেয়ে বড় কাঁচামালের বাজার কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা যায়, রোজার ঠিক আগ মুহূর্তে ছোলার দাম কেজি প্রতি ১০ টাকা আর চিনির দাম কেজি প্রতি বেড়েছে ২ টাকা। দু’দিন আগেও ছোলার দাম ছিল ৯০ টাকা, চিনির দাম ছিল ৫৮ টাকা। সোমবার সকাল থেকে ছোলা বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়, চিনি ৬০ টাকায়। মসুর ডাল ১৪০ টাকা, মুগ ডাল ১১০ টাকা, পোলাউর চাল ১০১ টাকা, সয়াবিন তেল ৫ লিটার ৪৩৫-৪৫৫ টাকা (ব্র্যান্ড ভেদে), রাইস ব্রান অয়েল ৮ লিটার ৮৫০ টাকা, জিরা ৩৮০ টাকা কেজি, এলাচ ১ হাজার ৪শ’ থেকে ১ হাজার ৬শ’ টাকা, দারুচিনি সাড়ে ৩শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানান এ বিক্রেতা। আদা বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা কেজি, রসুন ২০০ টাকা, পিঁয়াজ দেশী ৪৫ টাকা, আলু ২৪ টাকা, টমেটো ৪০ টাকা, বাঁধাকপি পিস ৪০ টাকা, ফুলকপি পিস ৩৫ টাকা, ধনিয়া পাতা ২০০ টাকা কেজি, কাঁচামরিচ ৪০ টাকা, পটল ২০ টাকা, ঢেঁড়শ ৩০ টাকা, বেগুন ১০০ টাকা, শসা ৪০ টাকা, বরবটি ৪০ টাকা, করলা ৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ১৬২ টাকা, সোনালী (কক) ২২০ টাকা ও দেশি মুরগি ৪৫০ টাকা থেকে ৬শ’ টাকায় প্রতিটি বিক্রি হচ্ছে। হাঁসের ডিম ৩৫ টাকা হালি, দেশী মুরগির ডিম ৪৫ টাকা ও ফার্মের ডিম ৩২ টাকা হালি বিক্রি হচ্ছে।
×