ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চিরস্মরণীয় মোহাম্মদ আলী

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ৭ জুন ২০১৬

চিরস্মরণীয় মোহাম্মদ আলী

বাংলাদেশ ও বাঙালীদের নিকট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী অনেকটা ‘ঘরের লোকের’ মতো সুপরিচিত এবং ভালবাসার প্রতীকে পরিণত। কেননা, ১৯৭৮ সালের ১৯ মে তিনি সপরিবারে চারদিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তখন তিনি খ্যাতির শিখরে প্রায় সূর্যের মতো দেদীপ্যমান এবং বিশ্বব্যাপী রাজত্ব সৃষ্টিকারী মুষ্টিযোদ্ধা। সে সময় তার সমকক্ষ আর কেউ নেই। সুগভীর আত্মবিশ্বাস ও প্রত্যয়ের সঙ্গে মোহাম্মদ আলী নিজেই বলেছেন নিজের সম্পর্কে ‘আই এম দ্য গ্রেটেস্ট কিং অব দ্য ওয়ার্ল্ড।’ সুখ্যাতির মধ্যগগনে মোহাম্মদ আলীর সেই সফর ছিল তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্ববহ। বাংলাদেশের লাখ লাখ ভক্ত ও ক্রীড়ামোদির জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক। সে সময় তাকে সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে একখ- জমিসহ বাংলাদেশের নাগরিকত্বের সম্মানে ভূষিত করা হয়েছিল। মোহাম্মদ আলীও প্রতিদানে কৃতজ্ঞতাসহকারে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘বাংলাদেশ, আই লাভ ইউ।’ সেই অকুতোভয় বীর মুষ্টিযোদ্ধা একই সঙ্গে যুদ্ধবিরোধী, বর্ণবাদবিরোধী, মানবতাবাদী সর্বোপরি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদ মোহাম্মদ আলী শুক্রবার ৩ জুন চিরবিদায় নিয়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। দীর্ঘ ৩২ বছর ধরে ভুগছিলেন দুরারোগ্য পারকিনসন্স রোগে। তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৪২ সালের ১৭ জানুয়ারি কেন্টাকির লুইসভিলে এক দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারে। এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, মার্কিন শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের তথাকথিত শ্রেষ্ঠত্বের উন্নাসিক বর্ণবাদসুলভ ঘৃণ্য আচরণের শিকার পদে পদে হতে হয়েছে মোহাম্মদ আলীকেও। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি এর যোগ্য প্রত্যুত্তর দিয়েছেন মুষ্টিযুদ্ধের চ্যালেঞ্জ ও শাণিত বক্তব্যের মাধ্যমে। মৃত্যুর কিছুদিন আগেও অসুস্থ অবস্থায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবসম্পন্ন মুসলিমবিদ্বেষী ডোনাল্ড ট্রাম্পের তীব্র সমালোচনা করেন। এর আগে তিনি মার্কিন সামরিক বাহিনীর পক্ষে ভিয়েতনামে জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণে অসম্মতি জানিয়ে সাহসিকতার পরিচয় দেন। এর জন্য তাকে মার্কিন সরকারের রোষানলে পড়ে কারাবরণ করতে হয়। খেতাব পর্যন্ত কেড়ে নেয়া হয় তার। আর এখানেই তিনি অনন্য ও অসাধারণ এক সুমহান মানবিক উচ্চতায় অধিষ্ঠিত ও সমুজ্জ্বল। মোহাম্মদ আলীর পূর্ব নাম ছিল ক্ল্যাসিয়াস মারকেলাস ক্লে জুনিয়র। ১৯৬৪ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপে সনি লিস্টনকে পরাজিত করে তিনি বিশ্বব্যাপী হৈচৈ ফেলে দেন। বক্সিংয়ে তিনি তিনবার বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করেন। খেলোয়াড়ী জীবনে তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল জর্জ ফোরম্যান। ১৯৯৯ সালে বিবিসি স্পোর্টস তাকে ইলাসট্রেটেড স্পোর্টসম্যান অব দ্য সেঞ্চুরি তথা শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় হিসেবে ঘোষণা করে। ষাট-সত্তর দশক মিলে তিনি বিশ বছর রাজত্ব করেন বক্সিংয়ে। জীবনের ৬১টি লড়াইয়ের ৫৬টিতেই হন বিজয়ী। ১৯৭৮ সালে স্পিংসের কাছে পরাজিত হয়ে বিদায় নেন মুষ্টিযুদ্ধ থেকে। তবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লড়াই করে গেছেন বর্ণবাদবিরোধী, মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার রক্ষার সংগ্রামে। আর এ কারণেই মুষ্টিযুদ্ধের বাইরেও একজন মহৎ মানুষ হিসেবে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন মানবহৃদয়ে। বক্সিং রিংয়ে তিনি ছিলেন প্রজাপতির মতো নৃত্যতৎপর ও মৌমাছির মতো হুল ফোটাতে পারঙ্গম। মহান এই বীরের মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। মূলত তিনি অমর, মৃত্যুঞ্জয়।
×