ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ওসমানীতে দেড় শ’ গুলি জব্দ ॥ হিথরোর নিরাপত্তাও প্রশ্নবিদ্ধ!

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৬ জুন ২০১৬

ওসমানীতে দেড় শ’ গুলি জব্দ ॥ হিথরোর নিরাপত্তাও প্রশ্নবিদ্ধ!

আজাদ সুলায়মান ॥ লন্ডন থেকে আসা যাত্রী আব্দুস সবুরকে সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরে ১৫০ রাউন্ড গুলিসহ আটকের ঘটনায় তোলপাড় চলছে। এতে হিথরো বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। গোয়েন্দাদের পাশাপাশি এভিয়েশন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরাও বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন- নিñিদ্র নিরাপত্তার দাবিদার হিথরো বিমাববন্দর দিয়ে বার বার কি করে একই ব্যক্তি একই কায়দায় গুলি আনার সুযোগ পেল। যুক্তরাজ্য তুচ্ছ অজুহাত দেখিয়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ইস্যুতে বিমানের সরাসরি লন্ডন ফ্লাইটের কার্গোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এখনও সে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার বিষয়টি আমলেই নিচ্ছে না যুক্তরাজ্য। অথচ হিথরো বিমানবন্দর দিয়ে নির্বিঘ্নে সবুরের মতো ব্যক্তি ১৫০শ’ গুলি নিয়ে চলে আসেন সিলেটে। এদিকে আটক সবুরকে রবিবার জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। ওসমানী বিমানবন্দর থানায় দায়ের এ মামলার একমাত্র আসামি হিসেবে সবুরকে পাঁচ দিনের রিমান্ড চেয়ে পাঠানো হলে আদালত শুনানি না করে তাকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। শনিবার সকালে লন্ডন থেকে আসা বিজি-০০২ ফ্লাইট থেকে সবুরকে আটক করে শুল্ক গোয়েন্দার সদস্যরা। আগাম তথ্যের ভিত্তিতে তাকে আটকের পর লাগেজ চেক করা হয়। লাগেজে একটি জুতোর ভেতর থেকে বের করে আনা হয় এসব গুলি। স্কচটেপ দিয়ে কাপড়ে মুড়িয়ে তা জুতার ভেতরে লুকানো ছিল। এ সম্পর্কে শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক ডক্টর মইনুল খান জনকণ্ঠকে বলেন, এটা পাখি মারার গুলিই হোক, আর মানুষ মারার গুলি হোক- সেটা দিয়ে অপরাধ বিবেচনা করা যাবে না। এটা লুকিয়ে আনা হয়েছে সেটাই একটা অপরাধ। কর পরিশোধ যোগ্য আইটেমও লুকিয়ে আনাটা অপরাধ। সে ইমিগ্রেশন পেরিয়ে কাস্টমস হলে এসেও যদি ঘোষণা দিত- তার লাগেজে এ ধরনের গুলি রয়েছে, তাহলেও তার সম্পর্কে একটা ইতিবাচক ধারণা পাওয়া যেত। তিনি জানান, শটগানের এসব ছররা গুলি দিয়ে মানুষও মারা যায়। ইতালির তৈরি ২৫০ কার্টুস কল নামে এই গুলি দিয়ে সবুর কি করত সেটা তদন্তের বিষয়। সবুর বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক। সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সারোয়ার হোসেন বাদী হয়ে তার বিবুদ্ধে মামলাটি দায়ের করেন। এতে ৭৪ এর বিশেষ ক্ষমতা আইন ছাড়াও শুল্ক আইন ও অস্ত্র আইনে এজাহার লেখা হয়। ডক্টর মইনুল খান নিজেও বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, শাহ জালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে বার বার উদ্বেগ প্রকাশ করে একটার পর একটা শর্তারোপ করছে যুক্তরাজ্য-আর নিজ দেশের হিথরো বিমানবন্দর দিয়ে নির্বিঘেœ এত গুলি নিয়ে চলে এলো সবুর। এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। অথচ সবুর তাই প্রমাণ করে দিলেন হিথরোও অবস্থাও তথৈবচ। এদিকে আটকের পর পরই সবুর দাবি করেন-এগুলো পাখি শিকারির গুলি। তার নিজের লাইসেন্সকৃত কোন অস্ত্র না থাকলেও বড় ভাইয়ের বন্দুকে ব্যবহার করার জন্য এ দেড়শ গুলি আনা হয়েছে। তিনি আরও জানিয়েছেন, ২০১২ সালেও তিনি ২৫টি বুলেট এনেছিলেন হরিণ শিকারের জন্য। এবারও তিনি ভাইয়ের বন্দুকের লাইসেন্স দেখিয়ে হিথরো বিমানবন্দর অতিক্রম করেন। তিনি শুল্ক গোয়েন্দাকে জানিয়েছেনÑ তারা ৬ ভাইয়ের একজন ছাড়া সবাই ব্রিটিশ প্রবাসী। তার স্ত্রীও প্রায়ই যুক্তরাজ্য যাতায়াত করেন। সিলেটের বিরিয়ানীবাজার মাতিউরা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুস শহিদের ছেলে সবুর সম্পর্কে ওসমানী বিমানবন্দর থানার ওসি গৌসুল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, তার নিজের কোন অস্ত্র নেই। তবে তার বড় ভাইয়ের বন্দুক রয়েছে। পাখি শিকারের জন্যই শখের বশে এসব ছররা গুলি নিয়ে আসেন সবুর। তাকে রিমান্ডে আনা গেলে প্রকৃত তথ্য বের করা সম্ভব হতো। ওসমানী বিমানবন্দর থানার পুলিশ সূত্রে জানা যায়-সবুরের আত্মীয় স্বজন লন্ডনে বসবাস করেন। প্রতি বছরই তিনিও সেখানে যাতায়াত করে থাকেন। এর আগেও তিনি লন্ডন থেকে একই কায়দায় গুলি নিয়ে আসার অভিযোগ রয়েছে। এদিকে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন-হিথরো বিমানবন্দরে যে কায়দায় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে লাগেজ ও যাত্রীদের তল্লাশি করা হয়। বিমানবন্দরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই যাত্রীদের এক্সরে মেশিনে পুরো শরীর চেক করা হয়, পায়ের জুতো-মোজা পর্যন্ত খোলা হয়। তারপর চেক-ইন করার সময় বেল্টেই লাগেজ স্ক্যান করা হয। সে লাগেজ উড়োজাহাজের কার্গো হোলে নিয়ে যাওয়ার পর কুকুর দিয়ে আবারও পরীক্ষা করা হয়। এমন নিñিদ্র ও দুর্ভেদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাঝ দিয়েই লাগেজ তোলা হয় উড়োজাহাজে। প্রশ্ন ওঠাই তো স্বাভাবিক- সবুরের লাগেজে লুকানো গোলাবারুদ কেন কুকুরের ঘ্রাণে ধরা পড়েনি। স্ক্যানারের পরীক্ষায় কেন ডিটেক্ট করা সম্ভব হয়নি। তাহলে কি হিথরো বিমানবন্দরেও রয়ে গেছে নিরাপত্তার ভুল-ত্রুটি? জানতে চাইলে বিমানের চেয়ারম্যান এয়ারমার্শাল এনামুল বারী জনকণ্ঠকে বলেন, এটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের শুল্ক গোয়েন্দার কৃতিত্ব। হিথরোর গোয়েন্দারা যা না পেরেছে বাংলাদেশের শুল্ক গোয়েন্দারা সেটা ধরে প্রমাণ করছে তারা কতটা পেশাদার ও দক্ষ। হিথরোর মতো নিরাপদ বিমানবন্দরে যদি এমন সব গোলাবারুদ অনায়াসে পাচার করা সম্ভব হয়Ñ তাহলে তারা আমাদের শাহজালালের নিরাপত্তা নিয়ে এত প্রশ্ন কেন? শত সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও শাহজালালের নিরাপত্তা কখনোই কারোর জন্য হুমকিস্বরূপ না হলেও বিমানের কার্গো ফ্লাইটের ওপর নিষেধাজ্ঞা কেন? এখনও কেন সেটা প্রত্যাহার করা হচ্ছে না। লন্ডন থেকে হিথরো দিয়ে গোলাবারুদ পাচার হতে পারেÑ তাহলে তাদের পক্ষে অন্য দেশের বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার নৈতিকতা থাকে কোথায়। উল্লেখ্য, কোন ধরনের নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার ঘটনা ছাড়াই গত ৮ মার্চ হঠাৎ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করে শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। পরদিন ঢাকা থেকে বিমানের লন্ডন ফ্লাইটে সরাসরি কার্গো পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এমনকি নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত না করা হলে প্রয়োজনে যাত্রীবাহী ফ্লাইটও বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। তারপর জরুরী ভিত্তিতে ব্রিটিশ নিরাপত্তা কোম্পানি রেড লাইনকে শাহজালালের নিরাপত্তার কাজে মোতায়েন করা হয়। কিন্তু এখনও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বিমানের এক পরিচালক। এ সম্পর্কে ওই পরিচালক বলেন, সবুর তো প্রমাণ করে দিলেন হিথরো বিমানবন্দর দিয়ে গোলাবারুদ ও অস্ত্র নিরাপদে পাচার করা যায়। নিজের দেশের এত দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও শাহজালালের নিরাপত্তা নিয়েই কেন অহেতুক শর্তের বেড়াজালে বিমানে আটকে রাখা হয়েছে।
×