ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া আসছে লক্ষাধিক আলেমের

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৬ জুন ২০১৬

জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া আসছে লক্ষাধিক আলেমের

বিভাষ বাড়ৈ ॥ ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে চলা জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে দেশে প্রথমবারের মতো লক্ষাধিক আলেমের ফতোয়া আসছে। আগামী ১৮ জুন ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে জঙ্গী-সন্ত্রাসী কর্মকা-ের বিরুদ্ধে দেশের এক লাখেরও বেশি বিশিষ্ট আলেমের স্বাক্ষরিত ফতোয়া জারি করবেন কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহর ইমাম ও খতিব আল্লামা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ। বিশিষ্ট আলেমরা বলেছেন, সন্ত্রাসী ও জঙ্গী কর্মকা-কে ইসলাম সমর্থন করে না। আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর উস্কানিতে একটি চক্র দেশের তরুণদের বিপথগামী করছে। দেশের সব আলেম সম্মিলিতভাবে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিলে, ধর্মের সঙ্গে জঙ্গীবাদের যে সম্পর্ক নেই, তা বিশ্বের কাছে স্পষ্ট হবে। জঙ্গীদের বিরুদ্ধে বিশাল এ কর্মযজ্ঞের বিষয়ে এর অন্যতম সংগঠন আল্লামা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ বলেছেন, ফতোয়া জারি হলে দেশের কোন মানুষকে ভুল বুঝিয়ে জঙ্গীবাদের পক্ষে নেয়ার পথও বন্ধ হবে। ফতোয়ার সমর্থনে দেশজুড়ে এক লাখ ইসলামী আলেমদের স্বাক্ষর ইতোমধ্যেই সংগ্রহ করেছেন। বিষয়গুলো সংকলনের কাজ চলছে। আগামী ১৮ তারিখে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এটি প্রকাশ করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি জানান, ফতোয়া জারির পর এটি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেয়া হবে। ফতোয়া জারিতে রাষ্ট্রীয় অনুমোদনের প্রয়োজন না হলেও প্রয়োগের জন্য রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যের প্রয়োজন আছে। ফতোয়া জারির কাজের সঙ্গে জড়িত আলেমরা জানিয়েছেন, গত ২ জানুয়ারি তিন শতাধিক আলেমের একটি সম্মেলনে সারাদেশে আলাদা আলাদা দলের মাধ্যমে কাজ ভাগ করে দেয়া হয়। বিভিন্ন মাদ্রাসার আলেমের কাছে গিয়ে ফতোয়া জারির বিষয়বস্তু উত্থাপন করে তাদের সমর্থনে স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয়। লাখো আলেমের স্বাক্ষর সংগ্রহের পর বাকি কাজও শেষের পর্যায়ে জানিয়ে দেশের এ বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ বলেন, জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ফতোয়ায় স্বাক্ষর করেছেন উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় দেওবন্দ মাদ্রাসা ও দেশের অন্যতম হাটহাজারী মাদ্রাসার মুফতিগণ। জঙ্গীবাদের কবল থেকে দেশ ও সত্যিকারের ইসলামকে রক্ষা করতে হবে। জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে আলেমদের নিয়ে দেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানসহ অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মতবিনিময়ও করা হবে। এছাড়া এ কার্যক্রমে অংশ নিতে দেশের মসজিদ-মাদ্রাসা, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের প্রতিও আহ্বান জানিয়ে চিঠি দেয়া হবে। আলেমদের নিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী মানববন্ধন, মহাসমাবেশের পরিকল্পনাও রয়েছে। জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়া আলেমরা তাদের কাজের বিষয়ে বলছেন, গত বছরের নবেম্বরে আইএস ও জঙ্গীবাদবিরোধী যাবতীয় কর্মকা-ের বিরুদ্ধে ভারতের এক হাজার ইমাম, মুফতি এবং ইসলামী চিন্তাবিদের স্বাক্ষর করা একটি ফতোয়া প্রকাশ করা হয়। ওই ফতোয়া জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছেও পাঠিয়েছিলেন তারা। ওই ফতোয়ায় বলা হয়, ‘ইসলাম সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আর আইএস সন্ত্রাসকে উস্কে দিচ্ছে। বিভিন্ন মুসলিম দেশেও ১৫ খ-ের ফতোয়াটি পাঠানো হয়েছিল। অন্য দেশের আলেমদেরও এভাবে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করার আহ্বানও জানানো হয়েছিল তখন। জানা গেছে, গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর পুলিশ সদর দফতরে আয়োজিত ‘ইসলামের দৃষ্টিতে জঙ্গীবাদ : বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে দেশের আলেমদের ফতোয়া দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলেন আল্লামা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ। সে পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই শুরু হয়েছিল জঙ্গীবাদবিরোধী ফতোয়ায় স্বাক্ষর সংগ্রহ কার্যক্রম। ওই সভায় পুলিশের মহাপরির্দশক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় নেতাদের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। জঙ্গীবাদবিরোধী ফতোয়ায় এক লাখ মুফতি ও ওলামায়ে কেরামের ফতোয়ার জন্য ১১টি প্রশ্ন নির্ধারণ করা হয়। এ বিষয়ে একমত পোষণ করে একটি অভিন্ন ফতোয়ায় স্বাক্ষর নেয়া হয় আলেমদের। সারাদেশ থেকে ফতোয়ায় আলেমদের স্বাক্ষর সংগ্রহের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে একটি সমন্বয় কমিটি করা হয়। এ কমিটিতে আছেনÑ মাওলানা আবদুর রহীম, মাওলানা এমদাদুল কাসেমী, মাওলানা সদরুদ্দিন মাকনূন। এছাড়া প্রতি জেলায় ‘দায়িত্বশীল’ নিয়োগ করা হয়। তারা কাজের প্রয়োজনে কমিটিতে নতুন ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করেন। ফতোয়ায় স্বাক্ষরের জন্য ১১টি প্রশ্নের জবাবে ওলামায়ে কেরাম তাদের অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। একমত পোষণ করে ফতোয়ায় স্বাক্ষর করেন। সন্ত্রাস ঠেকাতে কোরান ও হাদিসের বিভিন্ন বক্তব্যের আলোকেই ফতোয়াগুলো চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রশ্ন ছিলÑ শান্তির ধর্ম ইসলাম কি সন্ত্রাস ও আতঙ্কবাদের কর্মকা-কে সমর্থন করে? নবী ও রাসূল বিশেষ করে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইসলাম কায়েম করার পথে কি হিংস্রতা ও বর্বর নির্মমতার অবস্থান ছিল? ইসলামে জিহাদ ও সন্ত্রাস কি একই বিষয়? জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসের পথ কি বেহেশতের পথ না জাহান্নামের পথ? আত্মঘাতী মৃত্যু কি শহীদী মৃত্যু বলে গণ্য হবে? আত্মহত্যা ও আত্মঘাতের বিষয়ে ইসলামের মত কী? গণহত্যা কি ইসলামে বৈধ? শিশু, নারী, বৃদ্ধ নির্বিচারে হত্যা কি ইসলাম সমর্থন করে? ইবাদতরত মানুষ হত্যা করা কি ধরনের অপরাধ? এ ধরনের সন্ত্রাসী ও জঙ্গীবাদীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা ইসলামের দৃষ্টিতে কর্তব্য কি-না? সবশেষে আছেÑ গির্জা, মন্দির, প্যাগোডা ইত্যাদি অমুসলিম উপাসনালয়ে হামলা জায়েজ কি-না? আলেম সমাজের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে ইসলামী চিন্তাবিদরা বলছেন, এটা খুব ভাল উদ্যোগ। এতে পরিষ্কার হবে- দেশের আলেমরা জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। ফলে মসজিদ-মাদ্রাসার সঙ্গে জঙ্গীবাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলে আর কোন অপপ্রচারের সুযোগ পাবে না। পাশাপাশি দেশের কোন মানুষকে ভুল বুঝিয়ে জঙ্গীবাদের পক্ষে নেয়ার পথও বন্ধ হবে। তবে সরকার বিশেষত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধর্মের নামে চলা জঙ্গীবাদী কর্মকা- বন্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ার দাবি জানিয়েছেন দেশের খ্যাতিমান আলেমরা। তারা এজন্য জামায়াত- হেফাজত নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসাগুলোতে নজরদারি বাড়াতেও পুলিশকে তাগিদ দিয়েছেন। আলহাজ মাওলানা ড. আ ন ম মাহবুবুর রহমান বলছিলেন, কিছু লোক বিদেশী টাকায় ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালাচ্ছে। মিলাদ মাহফিলকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কোরান-হাসিদের আলোকে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে হবে। জিহাদ ও জঙ্গীবাদের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তা তুলে ধরতে হবে। মাওলানা শাহ সুফি সৈয়দ মুহাম্মদ বাহাদুর শাহ বলেন, ইসলাম শান্তি, সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্যরে ধর্ম। একটি মহল বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেশে জঙ্গীবাদ সৃষ্টি করছে। তারাই ইসলামের শত্রু। ‘যারা পল্টনে বলেছেন, বাংলা হবে আফগান আমরা হব তালেবান’ তারাই হচ্ছেন অরিজিনাল জঙ্গী। চাঁদপুরের গাবতলা দরবার শরীফের পীর মাওলানা খাজা আরিফুর রহমান বলেন, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা জঙ্গী ও খারেজীদের চরিত্র। এজন্য মসজিদে জুমার খুতবায় জঙ্গীবাদবিরোধী বক্তব্য দিতে হবে। জঙ্গীবাদ দমন করতে হলে এ সংক্রান্ত কর্মসূচীর সঙ্গে আলেমদের সম্পৃক্ত করতে হবে। মাওলানা কামাল উদ্দিন আজহারী বলেন, একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানকে কখনও হত্যা করতে পারেন না। এটা কুফরি কাজ। বোমা মারা, গুলি করা, মুসলমান হয়ে আরেক মুসলমানকে হত্যা করা ইসলাম ধর্মের মূল চেতনার পরিপন্থী। অন্য ধর্মের লোকদেরও হত্যা করা ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলামে এগুলো জঘন্য অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। জঙ্গীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়ে মুফতি হালিম সিরাজী বলছিলেন, যারা বিদেশী, মসজিদ ও উপাসনালয়ে হামলা চালিয়ে নিরীহ মানুষদের হত্যা করেছে, তারা কোরান-হাদিস থেকে অনেক দূরের বাসিন্দা। তারা কখনও নিজেদের প্রকৃত মুসলমান হিসেবে দাবি করতে পারে না। অধ্যক্ষ মাওলানা কফিল উদ্দিন সরকার ছালেহীর মতে, ইসলাম কখনও অন্য কোন ধর্মাবলম্বীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণের নীতি সমর্থন করে না। বরং শ্রদ্ধা দেখানোর কথা বলা হয়েছে। ভিন্নধর্মাবলম্বী বিদেশী শক্তির অর্থ, অস্ত্র ও উত্থানে বিভ্রান্ত হয়ে বিপথগামী কিছু তরুণ ইসলামের নামে দেশে সন্ত্রাস ও অশান্তি সৃষ্টি করছে। ইসলামের শান্তির বাণী সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়ে মুসলমান নামধারী সন্ত্রাসীদের মুখোশ খুলে দিতে হবে। মানুষকে ভালবাসা দিয়ে পৃথিবীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানে জঙ্গীবাদের কোন স্থান নেই। জঙ্গীবাদী কার্যক্রমের জন্য বিএনপির রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতকে শক্ত হাতে মোকাবেলার পরামর্শ দিয়েছেন অনেক ইসলামী চিন্তাবিদ। সারাদেশের জামায়াত ও তাদের মদদপুষ্ট ইমামদের তালিকা তৈরির পরামর্শ দিয়ে আলেমরা বলছেন, যেসব ইমাম ইসলামের নামে জঙ্গীবাদের উস্কানি দিয়ে বক্তব্য দেন, তালিকা থাকলে তাদের শনাক্ত করা সম্ভব হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধী যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মুজাহিদের ফাঁসির পর যেসব মসজিদের ইমাম তার জন্য দোয়া ও কান্নাকাটি করেছেন, তাদের চিহ্নিত করতে হবে।
×