ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এসপির স্ত্রী ও খ্রীস্টান ব্যবসায়ীকে একই কায়দায় হত্যা

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৬ জুন ২০১৬

এসপির স্ত্রী ও খ্রীস্টান ব্যবসায়ীকে একই কায়দায় হত্যা

শংকর কুমার দে ॥ একই দিনে একই কায়দায় রবিবার মাত্র ছয় ঘণ্টার ব্যবধানে চট্টগ্রামের পুলিশের এসপির স্ত্রী ও খ্রীস্টান ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করেছে সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা, যা আবারও সেই জঙ্গীগোষ্ঠীর দিকেই সন্দেহ তীর। বিগত সাড়ে তিন বছরে একই কায়দায় এ পর্যন্ত ৩৯ জনকে খুন করেছে জঙ্গীগোষ্ঠী। এই ৩৯টি হত্যাকা-ের মধ্যে ২৫টির সঙ্গে সরাসরি জেএমবি জড়িত। অপর ৯টির সঙ্গে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) এবং বাকি ৩টির সঙ্গে অন্যান্য জঙ্গী ও সন্ত্রাসী সংগঠন জড়িত। এসব হত্যাকা- ও হামলার ঘটনায় গত সাড়ে তিন বছরে উগ্রপন্থী জঙ্গী সংগঠনগুলোর ১১৯ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এসব ঘটনার মধ্যে বেশিরভাগই ক্ষেত্রেই আইএস বা আল কায়েদা দায় স্বীকার করে বার্তা পাঠালেও তাদের জড়িত থাকার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দফতর ও গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানান, ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত গত সাড়ে তিন বছর ধরে জঙ্গীগোষ্ঠীর একই কায়দায় যে ৩৯ জনকে খুন করেছে তার মধ্যে রবিবার চট্টগ্রাম ও নাটোরের হত্যাকা-ের শিকার হওয়া দুই জনের নামও যুক্ত হয়েছে। জঙ্গীগোষ্ঠীর সদস্যরা বেছে বেছে প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, শিক্ষক, বিদেশী নাগরিক, মানবাধিকার কর্মী, ধর্মযাজক, ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যাকা- ঘটাচ্ছে একই কায়দায়। এই একই কায়দায় খুন করা হয়েছে চট্টগ্রামে পুলিশের এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু ও খ্রীস্টান ব্যবসায়ীর নাটোরে খ্রীস্টান ব্যবসায়ী সুনীল গোমেজকেও। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, জঙ্গীগোষ্ঠীর এসব হামলা ও গুপ্তহত্যার ঘটনায় দায়ের করা ২৪টি মামলারই রহস্যভেদ করতে পারেনি পুলিশ। মাসের পর মাস ধরে বিভিন্ন ইউনিটে এসব মামলা তদন্তনাধীন রয়েছে। বার বার পরিবর্তন হচ্ছেন তদন্ত কর্মকর্তাও। রবিবারের দুইটি হত্যাকা- নিয়ে ৩৯টি হত্যাকা-ের ঘটনায় দায়ের করা মামলার মধ্যে শুধু ব্লগার রাজীব হত্যার রায়ে দুই জনকে মৃত্যুদ- ও ছয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেয়া হয়েছে। রাজীব হত্যাকা- ছাড়াও অপর জঙ্গী হামলা ও গুপ্তহত্যার ঘটনার গত সাড়ে তিন বছরে উগ্রপন্থী জঙ্গী সংগঠনগুলোর ১১৯ জনকে গ্রেফতারের দাবি করেছেন পুলিশ। পুুলিশের তদন্ত রেকর্ড থেকে জানা গেছে, জঙ্গীগোষ্ঠীর এসব হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনার বেশিরভাগই মামলাগুলোরই কোন কূলকিনারা করা যায়নি, শনাক্ত হয়নি প্রকৃত খুনী যারা জঙ্গীগোষ্ঠীর সদস্য এবং এই ধরনের হত্যাকা-ের নেপথ্যের মূল হোতারাও রয়ে গেছে ধরাছোয়ার বাইরে। ফলে কিছুদিন তৎপরতা বন্ধ রেখে আবারও একই ধরনের খুনের পুনরাবৃত্তি ঘটানো হচ্ছে, যার মধ্যে এবার পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী হত্যাকা-ের ঘটনায় জঙ্গীগোষ্ঠীর হত্যাকা-ের তৎপরতায় নতুন মাত্রা যুক্ত হলো। প্রতিটি হামলার পর তদন্তের শুরুতেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে কোন কোন উগ্রপন্থী সংগঠনকে দায়ী করা হচ্ছে। দু’একজনকে ধরার খবরও দেয়া হচ্ছে। তারপর কয়েক দিন পরই কোথায় যেন তদন্ত মিলিয়ে যাচ্ছে, জঙ্গীগোষ্ঠীর খুনীরাও অধরা থেকে যাচ্ছে, আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে জঙ্গীগোষ্ঠী। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, বিগত সাড়ে তিন বছরে উগ্রপন্থী এসব জঙ্গী সংগঠনগুলোর হামলা ও গুপ্তহত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে যে ১১৯ জনকে গ্রেফতরের দাবি করা হয়েছে তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে ‘সন্দেহভাজন’ হিসেবে। এসব ঘটনায় প্রকৃত হামলাকারী কিংবা তাদের চক্রের শেকড় বা মূল খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ। আর এ কারণেই গ্রেফতারের পর পর্যাপ্ত তথ্য ও সাক্ষ্য-প্রমাণ না মেলায় ‘সন্দেহভাজন’ হিসেবে তাদের আদালতে সোপর্দ করা হচ্ছে। প্রকৃত খুনীরা চিহ্নিত ও ধরা না পড়ায় একই ধরনের খুনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। এতে বাড়ছে আতঙ্ক-উদ্বেগ। বাড়ছে বিদেশীদের চাপও। বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানানো অব্যাহত রেখেছে আমেরিকা, ইউরোপসহ পশ্চিমা দেশগুলো। ঘন ঘন বাংলাদেশ সফর করছেন এসব দেশের মন্ত্রী, প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। জঙ্গী দমনে একযোগে কাজ করারও কথা বলছে তারা। তারা আবার বার বারই বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব রয়েছে বলে দাবি করে আসছে। পুলিশের সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, রবিবার চট্টগ্রাম ও নাটোরের দুই হত্যাকা-সহ ৩৯টি হত্যাকা-ের মামলায় কেবল ব্লগার রাজীব হত্যাকা-ের ঘটনায় দুইজনের মৃত্যুদ- ও ছয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেয়া হয়েছে। অপর হত্যাকা-গুলোর মধ্যে ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন হত্যাচেষ্টা, ওয়াসিকুর রহমান বাবু হত্যা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক একেএম শফিউল ইসলাম হত্যা মামলা এবং হোসনি দালানে তাজিয়া মিছিলে হামলায় দুজন নিহতের ঘটনায় করা মামলায় আদালতে চার্জশীট দাখিল করেছে পুলিশ। আবার অনেক মামলায় আসামি গ্রেফতারের কথা বলা হলেও কেন চার্জশীট দাখিল করা যাচ্ছে না, কিংবা বিলম্ব হচ্ছে। আবার অনেক মামলায় সন্দেহভাজন আসামি গ্রেফতার করা হলেও জড়িতদের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না। আসামিদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহসহ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে সময় প্রয়োজন হয়। পুলিশের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বিগত সাড়ে তিন বছরে উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে যেসব হামলা ও হত্যাকা-ের মামলা হয়েছে তার মধ্যে ২০টি হয়েছে ২০১৫ সালে। ২০১৫ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে প্রকৌশলী খিজির খান, ইতালির নাগরিক সিজারি তাভেলা, রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি, এএসআই ইব্রাহিমকে হত্যা, খ্রীস্টান যাজক লুক সরকারকে হত্যাচেষ্টা, তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি জমায়েতে বোমা হামলা করা হয়। এর মধ্যে সিজারি তাভেলা হত্যায় বিএনপির সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার দাবি করলেও চার্জশীট দিতে পারেনি এখনও। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের ২ নবেম্বর রাজধানীর লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ তিনজনকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। একই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি বগার অভিজিত রায় হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন এক আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওই মামলায় আলামত পরীক্ষার জন্য এফবিআইর পরীক্ষাগারে নমুনা পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট পাওয়ার পর আসামি শনাক্ত ও মূল রহস্য উদ্ঘাটন হবে বলে তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। গত ৭ এপ্রিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন হত্যার ঘটনায় একজনকেও গ্রেফতার করা যায়নি। এছাড়া বগার অনন্ত বিজয় হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে চারজন, এএসআই ইব্রাহীম হত্যার ঘটনায় পাঁচজন, কনস্টেবল মুকুল হত্যায় পাঁচজন, যাজক লুক সরকার হত্যাচেষ্টায় ছয়জন, পঞ্চগড়ে মঠপ্রধান হত্যায় চারজন, কুড়িগ্রামে ধর্মান্তরিত খ্রীস্টান হোসেন আলী সরকারকে হত্যায় দু’জন, দিনাজপুরে ইসকন মন্দিরে হামলার ঘটনায় দু’জন, বগার নীলাদ্রি চ্যাটার্জি নিলয় হত্যায় পাঁচজন, বগুড়ায় শিয়া মসজিদে হামলায় পাঁচজন, জাপানি নাগরিক কোনিও হোশি হত্যায় চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে দাখিল করা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র উল্লেখ করেন, প্রকৃতপক্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, জঙ্গী নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণে গোয়েন্দাদের প্রশিক্ষণ নিয়ে। জঙ্গীবাদ নিয়ন্ত্রণে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা কর্মকর্তাদের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এমনও বলা হচ্ছে, পুলিশের চাইতে জঙ্গীরাও গুপ্তহত্যা ও হামলার ঘটনায় বেশি প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত, দক্ষ ও চৌকস। আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি শিল্পমন্ত্রী ও আমির হোসেন আমু গত মে মাসে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাশেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে যে ৩৭টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে ২৫টির সঙ্গে সরাসরি জেএমবি জড়িত। আর ৯টির সঙ্গে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) এবং বাকি ৩টির সঙ্গে অন্যান্য জঙ্গী ও সন্ত্রাসী সংগঠন জড়িত। এসব ঘটনায় আইএসের জড়িত থাকার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল রবিবার সকালে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার বায়তুল ইজ্জতে বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি) এর ট্রেনিং সেন্টার এ্যান্ড স্কুল প্যারেড গ্রাউন্ডে কুচকাওয়াজের অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রীর হত্যাকা-ের ঘটনায় জঙ্গী সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। তবে এ হত্যার পেছনে আরও কোন কারণ আছে কিনা তা গোয়েন্দারা খতিয়ে দেখবে।’ জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতুর হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সেজন্য সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
×