মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ও নিজস্ব সংবাদদাতা, নাটোর ॥ একই দিন মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দেশের দুই প্রান্তে প্রায় একই কায়দায় দুটি হত্যাকা- ঘটে। চট্টগ্রামে সকাল সাড়ে ছয়টায় মাহমুদা খাতুন মিতু (৩২) নামে পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীকে প্রথমে ছুরিকাহত ও পরে গুলি করে হত্যা করা হয়। অন্যদিকে দেশের অপর প্রান্ত নাটোরে খ্রীস্টান ব্যবসায়ী সুনীল ড্যানিয়েল গোমেজকে (৬৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সুনীল গোমেজকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে এভাবে বিভিন্ন ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কয়েক ব্যক্তিকে আগে হত্যা করা হয়েছে। তবে চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীর হত্যাকা-টির ধরন একই হলেও পরিবারের ওপর আঘাত এই প্রথম। দেশে ইতোমধ্যে জঙ্গীদের হাতে যারা নিহত হয়েছেন এ দুটি হত্যাকা-ের ধরন একই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইতোমধ্যেই বলেছেন, এ কাজ জঙ্গীদের। হত্যাকা-ের ধরন দেখে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন হত্যার স্টাইল বলে দিচ্ছে কাজ জঙ্গীদের।
শনিবার সকালে চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্র জিইসি মোড় এলাকায় নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন পুলিশের উর্ধতন এক কর্মকর্তার স্ত্রী। তার নাম মাহমুদা খাতুন মিতু (৩২)। তিনি রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা ও দেশে জঙ্গী দমন তৎপরতায় বিশেষ সাফল্যের অধিকারী এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী। বাবুল আক্তার সিএমপির অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার থেকে পদোন্নতি পেয়ে সম্প্রতি এসপি হয়েছেন। রবিবার পুলিশ সদর দফতরে যোগ দেয়ার প্রাক্কালে তার স্ত্রীর মর্মান্তিক এ ঘটনা ঘটে। মোটরসাইকেল যোগে আসা তিন সন্ত্রাসী তাকে প্রথমে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। এরপর এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত ও পরে গুলি করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায়। ঘটনার পর আশপাশের লোকজন মাহমুদা খাতুন মিতুকে উদ্ধার করে চমেক হাসপাতালে নিয়ে যান। কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। খবর পেয়ে বাবুল আক্তার পুলিশের বিশেষ ব্যবস্থায় হেলিকপ্টারযোগে সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে চট্টগ্রামে এসে পৌঁছান এবং মর্গে রাখা তার প্রিয় স্ত্রীর লাশ দেখে মূর্ছা যান। এ সময় সিএমপির কমিশনার ও উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তা এবং চট্টগ্রামের রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন শ্রেণীর নেতৃবৃন্দসহ শুভাকাক্সক্ষীদের অনেকে উপস্থিত ছিলেন। এ সময় চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় বাইতুল ইজ্জতে বিজিবির সদস্যদের একটি সমাপনী কুচকাওয়াজে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। অনুষ্ঠান শেষে তিনি বাবুল আক্তারের বাসায় যান এবং তাকে সান্ত¡না দেন। এছাড়াও খবর পেয়ে ঢাকা থেকে ছুটে আসেন অতিরিক্ত আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারি এবং পিবিআইর (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার। দুপুর ২টায় সিএমপির দামপাড়া পুলিশ লাইনে মরহুমার জানাজা শেষে লাশ দাফন করার উদ্দেশ্যে ঢাকার পথে রওয়ানা হয়ে যায়। ঢাকায় নেয়ার পর তার দাফন কোথায় হবে তা নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে বলে পারিবারিক সূত্রে জানানো হয়েছে। অপরদিকে, ঘটনার জন্য মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে পাঁচলাইশ থানার ওসি জনকণ্ঠকে জানান, ধারণা করা হচ্ছে পুলিশ বাদী হয়ে মামলাটি করা হবে।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, বড় পুত্র চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র মাহির মাহমুদ আক্তারকে (৭) স্কুলগামী বাসে তুলে দেয়ার জন্য মা মাহমুদা খাতুন জিইসি মোড়ের ইক্যুইটি সেন্ট্রিয়াম ভবন থেকে বের হয়ে প্রায় এক শ’ গজ হেঁটে যাওয়ার পরই নৃশংস এ ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীদের সূত্রে জানা গেছে, ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে ৬টা পেরিয়ে গেছে। এ সময় বিপরীত দিক থেকে মোটরসাইকেল যোগে আগত তিন দুর্বৃত্ত মাহমুদা খাতুনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। এরপর শুরু হয় এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত। এ সময় মাহমুদা খাতুন চিৎকার শুরু করলে সন্ত্রাসীদের একজন তার চোয়ালের বাম সাইডে পিস্তল দিয়ে গুলি করে। নিমিষেই মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে যায়। এ সময় মায়ের এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে মাহির দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে দৌড়ে অদূরে বাস ভবনে গিয়ে সিকিউরিটি সদস্যদের এবং ফ্ল্যাটের লোকজনকে ঘটনা অবহিত করে। এরপরই একযোগে সকলে সেখানে উপস্থিত হয়। তখন হতভাগী মাহমুদা খাতুন আর বেঁচে নেই।
ঘটনাস্থলের আশপাশ ঘুরে দেখা গেছে, সিএমপির চারটি সিসি ক্যামেরা জিইসি মোড়ে এই বাবুল আক্তারই স্বপর্যবেক্ষণে ও তত্ত্বাবধানে সিসিএলের মাধ্যমে সর্বপ্রথম স্থাপন করেছিলেন। ঘটনার দিনে এই সিসি ক্যামেরাগুলো ছিল না। কারণ ওই এলাকায় অতি সম্প্রতি বিলবোর্ড উচ্ছেদ কার্যক্রম চলে। এ সময় এসব সিসি ক্যামেরাও উধাও হয়ে যায়। উল্লেখ্য, বাবুল আক্তার বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষণে ও প্রায় তিন বছর হাটহাজারী এবং এক বছর কক্সবাজার দায়িত্ব পালনকালে সিএমপির তত্ত্বাবধানের অভাবে এসব সিসি ক্যামেরা সরিয়ে নিয়েছে বিলবোর্ড উচ্ছেদের কারণে। কিন্তু এরপর থেকে এসব ক্যামেরার স্থান কোথায় হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এদিকে, বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে পুলিশ সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহে নেমেছে। তবে ঘটনাস্থলের মাত্র তিন গজ আগে সাঁটানো রয়েছে পশ্চিমমুখ করা ওয়েল ফুডের সিসি ক্যামেরা। ঘটনাস্থলের অপরপ্রান্তে প্রায় ২০ গজ দূরে রয়েছে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিমমুখ করা আরেকটি সিসি ক্যামেরা। ঘটনার ফুটেজ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিসি ক্যামেরায়। আর হামলাকারীদের সঠিক চিত্র পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ওয়েল ফুডের সিসি ক্যামেরা। কারণ হামলাকারীরা পশ্চিম দিক থেকে প্রবেশ করে ঘটনা ঘটিয়ে পূর্বদিকে পালিয়ে গেছে।
ঘটনাস্থলে গিয়ে জানা গেছে, সকাল সাড়ে ৬টায় মাহমুদা খাতুন মিতু ৭ডি নম্বর ফ্ল্যাট থেকে বের হন পুত্র মাহিরকে নিয়ে। প্রতিদিন বাবুল আক্তারের রানার পুলিশ কনস্টেবল সাদ্দাম মাহিরকে নিয়ে জিইসি মোড়ে স্কুলবাসে উঠিয়ে দিয়ে থাকে। কিন্তু রবিবার মা মিতু নিজেই ছেলেকে নিয়ে রওয়ানা দেন। এ শিশুকে নিয়ে জিইসি মোড়ে ৬টা ৪০ মিনিটে স্কুলের নির্ধারিত বাসে তুলে দিতে যান। কিন্তু রবিবার মিতু নিজেই ছেলেকে নিয়ে রওয়ানা দেন। মাত্র এক শ’ গজ না যেতেই বৈশাখী রেস্টুরেন্টের নির্মাণাধীন ভবনের সামনেই দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাত ও গুলির শিকার হন। মোটরসাইকেল যোগে আসা সন্ত্রাসীরা প্রথমে মিতুকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। এরপর পিঠে ও হাতে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে। একপর্যায়ে সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ পিস্তল দিয়ে মিতুর কপালে বাম দিকে ঠেকিয়ে সরাসরি গুলিতে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। ঘটনার সময় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মাহির দ্রুত পালিয়ে যায়। নিজেদের ভবনের নিচে গিয়ে কান্নাকাটি শুরু করলে সিকিউরিটি গার্ড ও ভবনের লোকজনের জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, তার মাকে কারা যেন মেরে ফেলছে। ঘটনা শুনে ভবন থেকেই কয়েকজন দ্রুত অকুস্থলে পৌঁছে দেখেন মিতুর নিথর দেহ রাস্তায় পড়ে রয়েছে।
শুধু সড়কের অপরপ্রান্তের ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকা নিরিবিলি হোটেলটি খোলা ছিল। গুলির শব্দে হোটেল কর্মচারীরা ও গুটিকয়েক কাস্টমার ওপর থেকে ঘটনাটি দেখার চেষ্টা করছিলেন। এ সময় কর্মচারী আরিফ বাইরে তাকিয়ে দেখেন এক মহিলা রাস্তায় পড়ে আছেন। তিন যুবক একটু হেঁটে মোটরসাইকেলে উঠে চলে যায়। এদের মধ্যে চালক হেলমেট পরা ছিল। কারও চেহারা দেখতে পাননি। দুর্বৃত্তরা সবাই ছিল যুবক।
ঘটনার প্রায় ২০ থেকে ২৫ মিনিটের মধ্যে বিভিন্ন দিক থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আসতে শুরু করেন ঘটনাস্থলে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন সিএমপি কমিশনার, মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের এডিসি, পাঁচলাইশ থানা পুলিশ, বায়েজিদ থানার ওসি ছাড়াও নগরীর বিভিন্ন থানা ও সিএমপির কর্মকর্তারা। সকাল সোয়া ৭টা থেকে পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তা, সিআইডির কর্মকর্তারা যৌথভাবে ক্রাইম জোন ঘেরা দিয়ে জনসাধারণের প্রবেশ বন্ধ করে দেয়। সিআইডির পক্ষ থেকে হত্যাকা-ের বিভিন্ন চিহ্ন মার্কিং করে ক্রমশ ঘটনাস্থলকে তদন্তের স্বার্থে পর্যবেক্ষণ শুরু করা হয়। এর আগে সিআইডির পক্ষ থেকে একটি চাদরে ঢেকে দেয়া হয় মিতুর লাশ। ক্রাইম স্পট চিহ্নিত করার পর চাদরটি তুলে নেয়া হয় মিতুর মুখম-লের অংশ থেকে। এ সময় মিতুর মুখম-লের বাম পাশে কান ও চোখের মাঝামাঝি স্থানে গুলি প্রবেশের চিহ্ন প্রত্যক্ষ করা যায়। বাম বাহুতে বোরকা ছিঁড়ে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন দেখা যায়। এ সময় মিতুর সর্বাঙ্গ রক্তে ভেসে যায়। দেখা যায়, তার মাথার বাম পাশেই ব্যবহৃত একটি গুলির খোসা পড়ে রয়েছে। ক্রাইম সিনে সিআইডি এ খোসাটিও চিহ্নিত করেছে। মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের এডিসি মোক্তার হোসেন জানিয়েছেন, খোসাটি সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ বোর পিস্তলের। এছাড়াও আরও তিনটি অব্যবহৃত গুলি পাওয়া যায় নিহতের পাশে । পূর্ব-পশ্চিমমুখী হয়ে পড়ে থাকা মিতুর নিথর দেহটি সকাল সাড়ে ৮টায় তুলে নেয়া হয় পুলিশের এ্যাম্বুলেন্সে। সেখান থেকে সোজা চমেক হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক মিতুর দেহের ৮টি স্থানে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে বলে জানান। এর মধ্যে পিঠের পেছনে ছোরার ঘাই ছিল অনেকটা এল আকৃতির। দুটি ছুরিকাঘাত একেবারে মেরুদ-ের বাম এবং ডান দিক দিয়ে প্রবেশ করেছে। এ সময় বোরকা ও হিজাব পরিহিতা মিতুর নিথর দেহ দেখে অশ্রু ঠেকাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ উপস্থিত সকলে। ঘটনাস্থলে ছুটে এসেছিলেন ওই ভবনে বসবাসরত ফ্ল্যাটবাসীও। প্রত্যেকেরই একই কথা কয়েক বছরে প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভাল একটা সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন তিনি।
এদিকে, মিতুর স্বামী বাবুল আক্তার সিএমপির অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) থেকে পদোন্নতি পেয়ে এসপি পদে এটাচ্ড হন পুলিশ হেডকোয়ার্টারে। গত বৃহস্পতিবার তিনি চট্টগ্রাম থেকে বিদায় নিয়ে চলে যান ঢাকায়। স্ত্রী, এক শিশুপুত্র ও এক শিশুকন্যাকে রেখে যান চট্টগ্রামের বাসায়। রবিবার তার দাফতরিকভাবে হেডকোয়ার্টার্সে যোগদানের কথা ছিল। সকালে স্ত্রী ও পুত্র-কন্যাদের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। এর কিছুক্ষণ পরই তিনি জানতে পারেন তার স্ত্রীর দুঃখজনক ও মর্মান্তিক এ ঘটনার কথা। ঘটনা শুনে তিনি কয়েক দফায় জ্ঞান হারান বলে সহকর্মীরা জানান। এ অবস্থায় সেখানকার সহকর্মীরা চট্টগ্রামের উদ্দেশে হেলিকপ্টারে তুলে দেন। সকাল ১১টা ১০ মিনিটের দিকে এসপি বাবুল আক্তার চমেক হাসপাতালের জরুরী বিভাগে প্রবেশ করেন। কিন্তু কর্তব্যরত ডাক্তার তাৎক্ষণিক তাকে স্ত্রীর লাশ দেখতে দেননি। কিছুক্ষণ পর বাবুল আক্তারের মানসিক অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় স্ত্রীর লাশের কাছে। দুপুর ১২টার একটু পরে ময়নাতদন্ত শুরু হয় মিতুর নিথর দেহের।
দুপুর আড়াইটায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বাবুল আক্তারের স্ত্রী হত্যার ঘটনায় সমবেদনা প্রকাশ করতে ওআর নিজাম রোডের বাসায় যান। এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাতকানিয়ার বাইতুল ইজ্জতে বিজিবির একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেন। সেখান থেকে সড়কপথে আসেন বাবুল আক্তারের বাসায়। এর একটু আগে সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহারও উপস্থিত হন। সংবাদকর্মীরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিএমপি কমিশনারের বক্তব্য নিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেন, দুর্বৃত্তরা পুলিশের মনোবল ভেঙ্গে দিতে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে এভাবে পুলিশকে বাধা দেয়া যাবে না। কারণ জঙ্গী দমনে এবং দুর্বৃত্তদের খুঁজে বের করতে মহানগর গোয়েন্দা বিভাগসহ পুলিশের বেশ কয়েকটি টিম ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। এছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন টিম কাজ করছে এ হত্যার পেছনে কারা জড়িত খুঁজে বের করতে। সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার বলেন, বাবুল আক্তার জঙ্গী নিয়ে কাজ করছেন। উগ্র জঙ্গীবাদী গোষ্ঠী এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে। তাকে চলাফেরায় বার বার সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু বাবুল আক্তার ছিলেন অত্যন্ত সাহসী।
বিকেল ৩টা ১০ মিনিটে বাবুল আক্তারকে নিয়ে যাওয়া হয় দামপাড়া পুলিশ লাইন মাঠে। সাড়ে ৩টায় মিতুর লাশ নিয়ে আসা হয় ওই মাঠে। বিকেল পৌনে ৪টার দিকে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয় পুলিশ লাইন মাঠে। এ সময় সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন, এমএ লতিফ এমপি, মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ ও পুলিশ পরিবারের সদস্যরা জানাজায় অংশ নেন। বিকেলে জানাজা শেষে কেন্টাকি ফ্রিজার নামের মাইক্রোযোগে (চট্টমেট্টো-শ-১১-০৫৫৭) গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপার উদ্দেশে রওনা হয়। তবে লাশবাহী গাড়িটি মাঝপথে ঢাকায় তাদের কয়েক আত্মীয়কে নিয়ে পুনরায় ঝিনাইদহের উদ্দেশে যাত্রা করার কথা রয়েছে। দাফনের বিষয়টিও সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানা গেছে।
পাঁচলাইশ থানায় মামলা ॥ পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী হত্যাকা-ের ঘটনায় রবিবার রাত সাড়ে ১১টায় পুলিশ বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে। সিসিটিভির ফুটেজে যে তিনজনকে দেখা গেছে তাদেরসহ অজ্ঞাত কয়েকজনের নামে এই মামলা দায়ের করা হয়।
নিজস্ব সংবাদদাতা নাটোর থেকে জানান, অনেকটা একই কায়দায় নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়ায় সুনীল ড্যানিয়েল গোমেজ (৬৫) নামে এক খ্রীস্টান মুদি দোকানীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। রবিবার দুপুরে উপজেলার বনপাড়া খ্রীস্টান পল্লীতে এ হত্যাকা- ঘটে। নিহত সুনীল গোমেজ বনপাড়া খ্রীস্টান পল্লীর যোশেফ গোমেজের ছেলে। তবে, হত্যাকা-ের পরপরই প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এদিকে মুদি ব্যবসায়ী সুনীল গোমেজকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে জঙ্গী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। হত্যাকা-ের পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে হত্যার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে আইএস।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রবিবার সকাল ৮টার দিকে তিনি সাপ্তাহিক প্রার্থনার জন্য গির্জায় যান। প্রার্থনা শেষে সেখান থেকে বের হয়ে তিনি বনপাড়া বাজার হয়ে নিজ বাড়ি ফিরে আসেন এবং প্রতিদিনের মতো তার মুদিখানা খুলে বসেন। এরপর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা দোকানে এসে সুনীলের ঘাড়ে ধারাল অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে পালিয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় তার কোমর ও মাথা দোকানের বাইরের দিকে উপুড় অবস্থায় ঝুলে ছিল। এছাড়া দুটি হাতে তিনি টাকা ধরে ছিলেন। তবে হামলার সময় দোকানের বাইরে ও ভেতরের কোথায় ভাঙচুর বা হামলার কোন আলামত পাওয়া যায়নি। এছাড়া হত্যাকা-ের সময় তার ভাড়াটিয়ারা বাসায় ছিলেন না বলে স্থানীয়রা জানান।
নিহতের মেয়ে স্বপ্না গোমেজ জানান, আমার বাবা অত্যন্ত সহজ সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তার কোন শত্রুই থাকতে পারে না। সারাদিন দোকানে বেচাকেনা করতেন। অন্যের সঙ্গে কখনও বেশি কথা বলতেন না। দুপুরে ভাত খাবার সময় বাবাকে কে বা কারা কুপিয়ে মেরে ফেলেছে শুনে আমি তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলে দৌড়ে যাই। সেখানে গিয়ে বাবার মৃতদেহ দেখতে পাই। আমি আমার বাবার হত্যার বিচার চাই।
বনপাড়া মিশনের খ্রীস্টান ইনচার্জ জয়ন্তী পিউরিফিকেশন জানান, এর আগে সুনীল বনপাড়া মিশনে মালির কাজ করত। তিনি অত্যন্ত ভাল মানুষ ছিলেন। মালির চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরই তিনি মনোহারি দোকান পরিচালনা করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন।
স্থানীয় মর্জিনা বেগম জানান, দিনের বেলায় সুনীলের মতো একজন নিরীহ লোককে হত্যার ঘটনার পর আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি। এখানকার অনেক পরিবারের পুরুষরা জীবিকার তাগিদে বাইরে অবস্থান করছেন। এখন থেকে তো আর রাতেও ঠিকমতো ঘুমাতে পারব না। আমরা আামাদের জীবনের নিরাপত্তা চাই।
খ্রীস্টান পল্লীর বাসিন্দা বেনেডিক্ট গোমেজ জানান, তার মতো একজন সহজ সরল নিরীহ লোককে দিনে দুপুরে কেউ হত্যা করবে এটা আমরা কখনও ভাবতে পারি না। তাছাড়া হত্যাকা-ের সময় সুনীল গোমেজের ভাড়ে কেউ বাসায় ছিলেন না। এর আগে মোবাইলের মাধ্যমে সর্বহারা পরিচয়ে আমার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকার চাঁদা দাবি করে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। এ ঘটনায় আমি থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছিলাম।
ভাড়াটিয়া সুখী খাতুন জানান, হত্যাকা-ের সময় তিনি তার বাবার বাড়িতে এবং তার স্বামী সবুজ ট্রাক ড্রাইভারি হওয়ায় পেশাগত কারণে বাইরে অবস্থান করছিলেন। সুনীলের মৃত্যুর খবর শুনেই তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন।
নাটোরের সিআইডি ইনচার্জ সেকেন্দার আলী ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে জানান, হত্যাকা-ের ধরন দেখে প্রাথমিকভাবে যেটা মনে হচ্ছে, এটা জঙ্গী হামলার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। তবে হত্যাকা-টি অন্য কোন কারণে ঘটতে পারে।
নাটোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুন্সি সাহাবুদ্দীন জানান, সুনীল গোমেজকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে ঘাড়ে কুপিয়েই হত্যা করা হয়েছে। নিহতের দু’হাতেই টাকা ছিল। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে এ হত্যাকা- ঘটে থাকতে পারে। তবে কারা এই হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত সে বিষয়ে এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। স্থানীয় লোকজন কাউকে হত্যা করতে দেখেনি। হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় নিয়ে আনতে পুলিশ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
হত্যার দায় স্বীকার করল আইএস ॥ নাটোরের বনপাড়ায় খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী ব্যবসায়ী সুনীল গোমেজকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে জঙ্গী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস। হত্যাকা-ের পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে হত্যার দায় স্বীকার করে আইএস বিবৃতি দিল। আইএসের প্রচার সংস্থা ‘আমাক’ অনলাইনে এক বিবৃতি প্রকাশ করে। বিবৃতিতে আইএস দাবি করেছে গত মাসে তারা বান্দরবানে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুকে হত্যার সঙ্গেও জড়িত ছিল। রবিবার দুপুর ১টার দিকে সুনীল গোমেজকে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে অবস্থানরত অবস্থাতেই কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নিহত সুনীল ওই এলাকার জোসেফ গোমেজের ছেলে। বনপাড়ার খ্রীস্টান পল্লীর বাসিন্দা ছিলেন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে, দেশে আইএসসহ বিদেশী জঙ্গী সংগঠনের অস্তিত্ব নেই।
মাগুরার বাড়িতে চলছে মাতম ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা, মাগুরা থেকে জানান, রবিবার সকালে চট্টগ্রামের এসপি বাবুল আখতারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু খুনের ঘটনায় এসপি বাবুল আক্তারের মাগুরা শহরের পৌরসভার পেছনে কাউন্সিল পাড়ায় পিতার বাড়িতে মাতম চলছে । পুত্রবধূর এই নির্মম হত্যার ঘটনায় এসপি বাবুল আক্তারের বাবা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াদুদ ও মা শাহিদা বেগম কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কেউই তাদের সান্ত¡না দিতে পারছেন না ।
হত্যাকা-ের খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনরা সমবেদনা জানাতে বাবুল আক্তারের পিতার বাড়িতে আসেন। মাগুরার পুলিশ সুপার একেএম এহসান উল্লাহ ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম তাদের বাসায় গিয়ে শোকাহত পিতা-মাতাকে সমবেদনা জানিয়েছেন। এ সময় হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
বাকরুদ্ধ মিতুর গ্রামের মানুষ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা বাউফল থেকে জানান, শোকাহত মাহমুদা খানম মিতুর গ্রামের বাড়ি বাউফলের পাকডালের মানুষ। তারা মিতুর নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন। রবিবার দুপুরে সরেজমিন পাকডাল গ্রামে নিহত মিতুর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, আত্মীয়-স্বজনরা বেদনাহত। মিতুর চাচাত চাচা জলিল মুন্সি কান্নাভেজা কণ্ঠে বললেন, মেয়েটা এভাবে মারা যাবে তা ভাবতেও পারিনি। আমি খুনীদের গ্রেফতার ও শাস্তি দাবি করছি।
মিতুর বাবা মোশারফ হোসেন মুন্সি ও মা ঢাকা বনশ্রী বাসায় থাকেন। গ্রামের বাড়িতে এক চাচা ও চাচি থাকেন। তারা দুইদিন আগে ডাক্তার দেখানোর জন্য বরিশালে গেছেন। ইউপির চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বলেন, ৫-৬ মাস আগে নিহত মিতুর সঙ্গে তার ঢাকার বনশ্রী বাবার বাসায় দেখা হয়েছিল। মিতুর ছোট বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে ওই বাসার গিয়ে ছিলেন তিনি। মেয়েটিকে এভাবে মেরে ফেলা হবে তা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না।
সুনীল গোমেজ হত্যার প্রতিবাদে নাটোরে বিক্ষোভ ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা, নাটোর, ৫ জুন ॥ জেলার বনপাড়ায় খ্রিস্টান পল্লীতে মুদি ব্যবসায়ী সুনীল গোমেজ হত্যার প্রতিবাদ, দোষীদের গ্রেফতার এবং নিরাপত্তার দাবিতে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছে বনপাড়া খ্রীস্টান সম্প্রদায়। বিকেল সাড়ে ৫টায় বনপাড়া বাজারে নাটোর-পাবনা মহাসড়ক অবরোধ করে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করে খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ।