ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

জি-৭ সম্মেলনে শেখ হাসিনার ভূমিকা

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ৬ জুন ২০১৬

জি-৭ সম্মেলনে শেখ হাসিনার ভূমিকা

(শেষাংশ) এ ছাড়া জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ভিত্তিতে তিনি বাংলাদেশের অনুকূলে ৬ বিলিয়ন ডলার পরিমাণ আনুষ্ঠানিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি লাভে সমর্থ হন। একই সময় জাপানী শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে তিনি বাংলাদেশকে জাপানী বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ, উন্মুক্ত ও লাগসই দেশ হিসেবে প্রতিভাত করেন। এই প্রক্রিয়ায় বাঙালী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জাপানী ব্যবসায়ীদের কার্যক্ষম আলোচনা অনুষ্ঠিত করার জন্য তিনি কার্যকর ভূমিকা রাখেন। তিনি এই সময় টোকিওতে বাংলাদেশের স্থায়ী দূতাবাস নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেন। তিনি এই সম্মেলনে উপস্থিত জোট-৭ এর অন্য নেতৃবৃন্দ যথা যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রোডো, জার্মানির চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মের্কেল ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামার সঙ্গে সন্ত্রাস দমন, উন্নয়নশীল দেশে উন্নত বিশ্ব হতে অধিকতর বিনিয়োগ সঞ্চালন এবং বিশ্বব্যাপী মুক্তবাণিজ্যের প্রসারণের ওপর ফলপ্রসূ আলোচনা করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অন্যান্য দেশে প্রবৃদ্ধির শ্লথ গতি সত্ত্বেও বাংলাদেশের লক্ষণীয় প্রবৃদ্ধির স্বীকৃতি দেন এবং সাম্প্রতিক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের অধিকতর প্রবৃদ্ধি ও ১৯৪৫ সালের পর সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ কর্মসংস্থান অর্জন এবং এ ব্যাপারে তার সরকারের গৃহীত নীতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পৃথিবীব্যাপী সন্ত্রাস রোধে সকল দেশের সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন যে সাম্প্রতিক বছরে ইউরোপমুখী অভিবাসনের চাপ সৃষ্টি করেছে তার প্রতি মের্কেল শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করান। নেতৃবৃন্দ পৃথিবীব্যাপী সন্ত্রাস দমনে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রযুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ঐকমত্যে পৌঁছেন। ১৯৭২ সালের মার্চে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর মুখ্য সচিব রুহুল কুদ্দুসের নেতৃত্বে আমি সর্বপ্রথম বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে জাপান সরকারের আমন্ত্রণে সে দেশ সফর করি। ওই সময় জাপানের তরফ থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে যথাপ্রয়োজন সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এরপর বঙ্গবন্ধু যখন আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭৩ সালে জাপান সফর করেন তখন থেকে বাংলাদেশে জাপানের উন্নয়ন ও অর্থায়ন সহায়তার আন্তঃপ্রবাহ ঘটতে থাকে। যমুনা নদীর ওপর সড়ক ও রেল সেতু নির্মাণের জন্য সহায়তা দেয়ার বিষয়ে জাপান তখন বঙ্গবন্ধুকে প্রতিশ্রুতি দেয়। নতুন করে এমন সহায়তার অন্তঃপ্রবাহের অনুকূলে জেনারেল জিয়া কর্তৃক বেআইনীভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার পর আর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়নি। জেনারেল জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনকাল ১৯৯৫-এর ৩০ জুন পর্যন্ত নতুন করে বাংলাদেশের অনুকূলে কোন সহায়তা নিয়ে জাপান এগিয়ে আসেনি। কেবল আগের দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সহায়তা দিয়ে এসেছে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারের সময় জাপান থেকে আনুষ্ঠানিক সহায়তার নতুন মাত্রা ও অবয়ব বৃদ্ধি পায়। ২০০১-২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রচ্ছন্ন স্বৈরশাসনের সময় জাপান থেকে নতুন কোন সহায়তার প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশে জাপান ক্রমান্বয়ে সহায়তা বাড়াতে থাকে। ১৯৭৪ সালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরের সময় বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও বাণিজ্য প্রসারণে অধিকতর সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে প্রায় ২০০ জাপানী বিনিয়োগকারীকে বাংলাদেশ সফরে নিয়ে এসেছিলেন। যে ৬ বিলিয়ন ডলার পরিমাণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি শেখ হাসিনা জি-৭ সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে জাপান থেকে লাভ করেন তা সাম্প্রতিককালে জাপান থেকে প্রদত্ত সবচেয়ে বেশি পরিমাণ সহায়তার দ্যোতক। এ পরিমাণ সহায়তার অধিকতর তাৎপর্য এই যে, এর সিংহভাগ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সৃষ্টিতে প্রযুক্ত হবে এবং জাপান অনুসৃত প্রথা অনুযায়ী কার্যত অনুদানে রূপান্তরিত করবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে জাপান বাংলাদেশের সহায়ক দেশ হিসেবে নিজের ভূমিকা উজ্জ্বল করে রেখেছে। সকল উন্নয়নশীল দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মানবাধিকার সংরক্ষণ ও প্রসারণকারী শাসনের অনুকূলে জাপান তার আনুষ্ঠানিক সহায়তা অব্যাহতভাবে প্রযুক্ত করেছে। জি-৭ জোটের সম্মেলনকালীন এই প্রেক্ষিতে জাপান জননেত্রী শেখ হাসিনার অনুরোধে যে সহায়তা ও সমর্থন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা এ দেশের জন্য তাৎপর্যমূলক প্রাপ্তি। এই প্রাপ্তির জন্য সামগ্রিক কৃতিত্বের দাবিদার শেখ হাসিনা; আর এই দাবি উত্থাপন ও পূরণে সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক উপকরণ যুগিয়েছে তার নেতৃত্বে গণতন্ত্রের প্রতি সরকারের সংবিধান অনুযায়ী অবিচল আনুগত্য ও কার্যক্রম। ১৯৭২ সাল থেকে জাপান প্রকারান্তরে জানিয়ে এসেছে যে, গণতান্ত্রিক শাসন ও পরিবেশের বাইরে তারা বাংলাদেশ বা অন্য কোন দেশকে নতুন করে সহায়তা দিতে ইচ্ছুক নয়। জি-৭ এর এই সম্মেলন উপলক্ষে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক্ষেত্রে জাপান বাংলাদেশের প্রতি একই মনোভাব এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের অনুকূলে তাদের অবিচল ও দৃঢ় সমর্থন প্রকাশ করেছে। আশা করা যায়, বাংলাদেশ যথাযথ প্রকল্প প্রণয়ন ও নির্বাচন করে এই প্রতিশ্রুত সহায়তা ফলপ্রসূভাবে প্রযুক্ত করতে সমর্থ হবে। মাতারবাড়ীতে বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন, মহেশখালীতে গভীর সমুদ্র বন্দর প্রতিষ্ঠাকরণ এবং কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ এসব সহায়তায় বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। আমার মনে পড়ে ১৯৭২ সালে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ থেকে জাপান সফরের সময় আমি ও বঙ্গবন্ধুর মুখ্য সচিব রুহুল কুদ্দুস জাপানী পার্লামেন্টের স্পীকারকে বলেছিলাম যে, জাপান ও বাংলাদেশের পতাকা একই আদর্শের দ্যোতক; জাপানের পতাকায় শান্তির প্রতিফলক সাদা রঙের পটে মানব চেতনা, উদ্দীপনা ও উন্নয়নের নিশানা হিসেবে সূর্যকে স্থান দেয়া আছে। বাংলাদেশের পতাকায় তেমনি মানবিক অধিকার, গণতন্ত্র ও প্রগতির প্রতিফলক হিসেবে সূর্যকে স্থান দিয়ে এবং এর চারপাশ সবুজকে প্রবৃদ্ধির দ্যোতক হিসেবে ভাস্বর করা হয়েছে। জি-৭ এর সম্মেলনে অর্জিত সাফল্যের আলোকে জননেত্রী শেখ হাসিনার এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে যে, জাপান ও বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার অর্জন ও সংরক্ষণ এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে এবং এ লক্ষ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা প্রযুক্ত করার চিরায়ত প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ। এই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাংলাদেশ ও জাপানের দ্বিপক্ষীয় পদক্ষেপ এই দশকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সকল মানুষের প্রবৃদ্ধি, গণতন্ত্র, মানবাধিকার বিকশিত করার লক্ষ্যে সহযোগিতার নতুন দিগন্ত বিস্তৃত করবে বলে আশা করা যায়। লেখক : সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী
×