মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে খন্দকার মোশতাক ও গংয়ের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য অর্জিত হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ণোদ্যমে শুরু হওয়ার পর মোশতাক যখন বুঝতে পারে পাকিস্তানের কবর রচিত হওয়াকে আর ঠেকানো যাবে না, তখন সে নতুন কৌশলে সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। লক্ষ্য, ফেডারেশন, কনফেডারেশন বা অন্য যে কোন ব্যবস্থার মাধ্যমে পাকিস্তান রক্ষার শেষ চেষ্টা করা। মোশতাক যুক্তি তোলেন- আমরা কি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে জীবিত ফেরত চাই, নাকি স্বাধীন বাংলাদেশ চাই। ভয়ানক ধুরন্ধর ও দুরভিসন্ধিমূলক কথা। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়া অবধারিত। কিন্তু বিচক্ষণ ও ধীমান তাজউদ্দীনের দৃঢ়তা ও পাল্টা কৌশলে মোশতাক সেদিন পিছু হটতে বাধ্য হয়।
মোশতাকের ধুরন্ধতার জবাবে তাজউদ্দীন বললেন- ‘আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ চাই এবং বঙ্গবন্ধুকেও জীবিত ফেরত চাই।’ একাত্তরে তাজউদ্দীনের দুই লক্ষ্যই অর্জিত হয়। কিন্তু সে সময়ে পিছু হটলেও মোশতাক যে বসে ছিল না তার প্রমাণ পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। পঁচাত্তরে স্বল্প সময়ের কারণে বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তান বানানোর প্রকল্পে মোশতাক তেমন কিছু করতে পারে না। কিন্তু মোশতাকের হাত ধরে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান। রাজনীতিতে ইসলাম, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার ও ধর্মীয় রাজনীতির কবল থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত রাখা ছিল আমাদের দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম মৌলিক লক্ষ্য (ফান্ডামেন্টাল)।
স্বাধীনতার পর এই মৌলিক আদর্শকে সাংবিধানিক রক্ষাকবচ দেয়া হয় বাহাত্তরের সংবিধানের ১২ ও ৩৮ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে। একই উদ্দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শ হিসেবে সংযোজিত হয়। কিন্তু ১৯৭৮ সালে সামরিক ঘোষণার মাধ্যমে জিয়াউর রহমান সংবিধানের এসব অনুচ্ছেদ ও মৌলিক আদর্শকে বাতিল করে দেন। ফলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের সংগ্রাম ও একাত্তরের ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শগত সব অর্জন অফিসিয়ালি বাতিল হয়ে গেল। তাতে রাষ্ট্রের নামটি বাংলাদেশ থাকল বটে এবং দৃশ্যত দুটি আলাদা দেশ হলেও একাডেমিক্যালি ও বস্তুত. সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ আরেকটি পাকিস্তানের রূপ ধারণ করল। একাডেমিক্যালি ও সাংবিধানিক জায়গা থেকে ব্যবহারিক ক্ষেত্রেও আরেকটি পাকিস্তান বানানোর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে স্বাধীনতার পর নিষিদ্ধ ঘোষিত মুসলিম লীগ, জামায়াতসহ সব স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলকে পুনরায় রাজনীতি করার অনুমতি দেয়া হলো। একই সময়ে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলনের নেতা গোলাম আযমকে ১৯৭৮ সালে জিয়া সরকার পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসার অনুমতি দিল। গোলাম আযম কিন্তু বাংলাদেশে আসার আগে পূর্ব পাকিস্তানের পুনরুদ্ধার আন্দোলন বাতিল করলেন না। তখন সরকারের পক্ষ থেকে কি শর্ত দেয়া উচিত ছিল না যে, বাংলাদেশে প্রবেশ করতে হলে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলন তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল করতে হবে।
১৯৭৮ সালে পুনর্জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত তাদের কার্যকলাপ পর্যালোচনা করলে কি মনে হয় না যে, জামায়াত পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যেই এ যাবত কাজ করে আসছে। তাদের পুনর্জন্ম হয়েছে ১৯৭৮ সালে বিএনপির হাত ধরে এবং লক্ষ্য অর্জনের পথে এ যাবতকালের অর্জনে তারা বিএনপিকে পেয়েছে প্রধান অবলম্বন হিসেবে। বাংলাদেশের জন্য ভয়ঙ্কর নিরাপত্তার ঝুঁকি সৃষ্টি করে কেবল পাকিস্তানের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ২০০১-২০০৬ মেয়াদে ক্ষমতায় বসে তারা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য অস্ত্র-গোলাবারুদ পাচার করতে থাকে, যার এক চালান দশ ট্রাক অস্ত্র দৈবক্রমে ধরা পড়ে ২০০৪ সালের ২ এপ্রিল চট্টগ্রামে। তারপর বিএনপি নেতা সাকা চৌধুরী ও জামায়াত নেতাদের ফাঁসির দ- কার্যকরের পর পাকিস্তানের আচরণ দেখে কি মনে হয় না যেÑ এরা এতদিন বাংলাদেশী নাগরিকের ছদ্মবেশে প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের স্বার্থ উদ্ধারের জন্যই কাজ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় সেই দুরাশা আজ যখন চিরদিনের জন্য স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তখন পাকিস্তান কূটনৈতিক ও আন্তঃদেশীয় সম্পর্কের সব শিষ্টাচার ভঙ্গ করে উন্মাদের মতো আচরণ করছে। দ্বিতীয় সামরিক শাসক এরশাদ তার পূর্বসূরির সবকিছু তো অটুট রাখছেনই, বরং আরও একধাপ এগিয়ে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিধান সংযোজন করে সবকিছুকে উল্টে-পাল্টে পাকিস্তানী চেতনা থেকে রাষ্ট্রকে বের করার পথে মহাসঙ্কট সৃষ্টি করে গেছেন। এখান থেকে বের হওয়ার কোন পথ এখন আর কেউ বলতে পারছেন না। তবে সম্প্রতি পত্রিকায় একটি কলাম লেখার মাধ্যমে মোশতাকী কায়দায় ধুরন্ধর ও দুরভিসন্ধিমূলক একটি প্রস্তাব করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিনিয়র অধ্যাপক। বুদ্ধিজীবী বলেও তার পরিচিতি আছে, তিনি নিজেকে নিরপেক্ষ বলে দাবি করেন। তার লেখার ভেতরে তিনি প্রস্তাব করেছেন : সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্মের বিধান ও ধর্মনিরপেক্ষতা দুটোই বাদ দেয়া হোক। তাহলে নাকি রাজনৈতিক সংঘাত বন্ধ হয়ে যাবে। আপাতদৃষ্টিতে অনেকের কাছে মনে হতে পারে এর থেকে নিরীহ ও নিরপেক্ষ কথা আর হতে পারে না। কিন্তু তিনি চতুরভাবে ধর্মের মূল বাণীকে উপেক্ষা করেছেন। যার যার ধর্ম তার তার কাছে সবকিছুর উর্ধে। ধর্মের সঙ্গে ইহজাগতিক কোনকিছুর তুলনা করলে তাতে ধর্ম ছোট হয়ে যায়, ধর্মের অবমাননা হয়। এ কারণেই মনীষীরা বলছেন, রাজনীতি ইহজাগতিক বিষয় হওয়ায় তার সঙ্গে ধর্মকে জড়ানো উচিত নয়। রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে ধর্মের ব্যবহার যারা করেন তাদের কাছে ধর্ম নয়, রাজনৈতিক স্বার্থই বড়।
কলাম লেখক ওই বুদ্ধিজীবীর প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মৌলিক আদর্শ বাতিল হয়ে যায় এবং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রাণ অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার নির্ঘাত মৃত্যু ঘটে। তাতে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের পথ অনেকখানি পরিষ্কার হয়ে যায়। সুতরাং কলামিস্ট বুদ্ধিজীবীর প্রস্তাব নতুন হলেও আসলে এটা নতুন কিছু নয়। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মোশতাক কর্তৃক শুরু করা ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় নতুন একটি রূপ মাত্র। এসব বুদ্ধিজীবী আরেকটু শক্তি সঞ্চয় করতে পারলে বলা শুরু করবেনÑ ‘স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে যেহেতু দুই বড় দলের মধ্যে দ্বিমত, ঝগড়া, সংঘাত আছে; তাই জিয়াউর রহমান ও শেখ মুজিবুর রহমান দু’জনের নামই বাদ দেয়া হোক। তারপর বিএনপির সুপ্রিমো তো ঘোষণা দিয়েছেন তার পিতা জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। একদিন হয়ত বলবে, তৌহিদী জনতাকে নিয়ে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান।
আমাদের এসব বুদ্ধিজীবী তার জন্য অপেক্ষা করছেন কি-না কি জানি। কারণ, তারা সবকিছুকে সমান সমান করতে চায়। একই ধারাবাহিকতায় একই সূত্রে গাঁথা আরেকটি নব্য সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে লেখাটি শেষ করব। বিগত দিনের তিক্ত অভিজ্ঞতায় সকল মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশের বৃহত্তর মানুষের দাবির মুখে বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হওয়া মৌলিক ইস্যু, ইতিহাস ও সুনির্দিষ্ট সত্যের বিকৃতি রোধে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এখানেও জামায়াত-বিএনপি তো আছেই, তাদের সঙ্গে একই শ্রেণীর কিছু নিরপেক্ষধারী কলামিস্ট, লেখক, বুদ্ধিজীবী বলা শুরু করেছেন, এমন আইন হলে নাকি মুক্তচিন্তা, ইতিহাসচর্চা, বাকস্বাধীনতা রহিত হবে। মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক বিষয় যেমনÑ ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের পহেলা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অভূতপূর্ব অসহযোগ আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা, একাত্তরের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, রাজাকার, আলবদর, জামায়াতের সক্রিয় সহযোগিতায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস, এগুলোর মাহাত্ম্য ও ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নায়ক-মহানায়কদের উজ্জ্বল প্রেরণাদায়ী অবদানকে সঠিক ও অবিকৃত রেখে ইতিহাসচর্চায় তো কোন আইন বাধা হতে পারে না। বিগত দিনে এগুলোর মাহাত্ম্য ও নেতা-মহানেতাদের উজ্জ্বল অবদানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উপেক্ষা, আড়াল, বিকৃত এবং অস্বীকার করা হয়েছে বলেই তো আজ আইন প্রণয়নের দাবি উঠেছে। আজ বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে যে কঠিন সংঘাত ও মৌলিক বিষয়ে ঐক্যের অভাব, তার মূল কারণ এখানেই নিহিত। বিগত দিনে রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাসের ফসল বাংলাদেশের সীমাহীন ক্ষতি করেছে, যা কোনদিন পূরণ হওয়ার নয়। আর ক্ষতি হতে দেয়া যায় না, তাই আইন হওয়া আবশ্যক এবং এই প্রস্তাবিত আইনকে সাংবিধানিক রক্ষাকবচ দেয়া উচিত। প-িত জওহরলাল নেহরু একবার বলেছিলেন, দুই শ’ বছর শাসন করে ইংরেজ ভারতবর্ষের যত না ক্ষতি করেছে, তার থেকে শতগুণ বেশি ক্ষতি তারা করেছে উপমহাদেশের ইতিহাস বিকৃত করে। সভ্যতা চর্চা ও তা রক্ষা করার মাপকাঠিতে এখনও ইউরোপকেই প্রথম কাতারে রাখা হয়। ইউরোপের প্রায় এক ডজনের মতো দেশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গণহত্যা অস্বীকার ও বিকৃতির বিরুদ্ধে কঠোর আইন আছে। সম্প্রতি একজন কলামিস্ট লিখেছেন, আমেরিকায় স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস রয়েছে, সেখানে এমন আইনের দরকার হলো না, আমাদের কেন দরকার হবে। এই কলামিস্ট যে কথাটি লুকিয়েছেন তাহলোÑ আমেরিকার আড়াই শ’ বছরের ইতিহাসে একবারের জন্য একজন ব্যক্তিও তাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি, বিকৃত করেনি। আমেরিকার ফাউন্ডিং ফাদার নিয়েও কোনদিন কেউ প্রশ্ন তোলেনি। সুতরাং, আজ যারা রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা দুটোকেই বাদ দেয়ার কথা বলছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি রোধ আইনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তারা ছদ্মবেশে প্রকৃতপক্ষে খন্দকার মোশতাকের শুরু করা ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় নব্য রূপের ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়েছেন।
লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক